ঢাকা, সোমবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলন, হুমকির মুখে আশ্রয়ণের ঘর!

সোলায়মান হাজারী ডালিম, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯৩৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৩
অনিয়ন্ত্রিত বালু উত্তোলন, হুমকির মুখে আশ্রয়ণের ঘর!

ফেনী: ফেনী নদীর তীরে অবস্থিত ছাগলনাইয়া উপজেলাধীন শুভপুর ইউনিয়ের জয়চাঁদপুর ও সোনাপুরে চলছে দেদার অবৈধ বালু উত্তোলন। এর ফলে সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের ৪৫ পরিবারসহ দুই গ্রামের পাঁচ শতাধিক পরিবারের বাড়িঘর নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কা করছেন স্থানীয়রা।

 

ফেনী নদীর তীরঘেঁষা শুভপুর ইউনিয়নের দুই গ্রামের চর অবৈধভাবে কেটে নেওয়ার ফলে শত শত একর ফসলি জমি এখন নদী গর্ভে বিলীন হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।

স্থানীয়রা জানান, প্রকাশ্যে ১০/১৫টি ড্রেজার ও কাটার মেশিন ব্যবহার করে রাতে ও দিনে দেদার বালু উত্তোলন করে শুভপুর এলাকার বিস্তীর্ণ এলাকা ফেনী নদীতে মিশিয়ে দিয়েছে একটি বালু খেকো চক্র।  

অবৈধ বালু উত্তোলনে বাড়িঘর হারানোর শঙ্কায় দিন কাটানো জয়চাঁদপুরের বাসিন্দাদের অভিযোগ, চট্টগ্রামের মিরসরাই এলাকার মো. কামরুল, রাসেল ও ছাগলনাইয়ার মো. হারুনের নেতৃত্বে প্রতিদিন চরের জমি কেটে নেওয়া হচ্ছে।

এতে বাধা দিলে বালু উত্তোলনকারীরা গ্রামবাসীকে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকি দেয় বলেও অভিযোগ।  

স্থানীয় ইউপি সদস্য ও শুভপুর ইউনিয়ন পরিষদের প্যানেল চেয়ারম্যান আনোয়ার হোসেন জানান, করেরহাট ইউনিয়নের বালুকিয়া গ্রামের কামরুল ও রাসেলের নেতৃত্বে প্রতিদিন অবৈধভাবে শুভপুরের চর এলাকার জমি কেটে নিয়ে যাচ্ছে। বারবার বাধা দিলেও বালু উত্তোলন বন্ধ হচ্ছে না।

এদিকে, অবৈধ বালু উত্তোলনকারীদের হাত থেকে নিজেদের বাড়ি-ঘর ও ফসলি জমি রক্ষা করার দাবিতে নদীর তীরবর্তী চরে মানববন্ধন করেছে আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দাসহ আশপাশের অধিবাসীরা। মানববন্ধনে জয়চাঁদপুর ও সোনাপুর গ্রামের হাজারো মানুষ অংশ নেয়।  

আশ্রয়ণ প্রকল্পের বাসিন্দা জেবুন্নেছা (৫৫), দুলালী রানি দাস (৬৫), ফেরোজা বেগম, রিনা আক্তার (৪৫), আলতাব হোসেন (৫০) অসহায়ত্বের সুরে বলেন, ভিটে-মাটিহারা হয়ে আমরা সরকারের পক্ষ থেকে আশ্রয়ণে স্থান পেয়েছি। পারিবার নিয়ে দুঃখ কষ্টে দিন কাটাচ্ছিলাম। আমাদের আশ্রয়ণ প্রকল্পের পাশে ফেনী নদীর চর কেটে মিরসরাইয়ের লোকজন প্রতিদিন যেভাবে মাটি ও বালু কেটে নিচ্ছে, তাতে অল্প সময়ের মধ্যে আমাদের বসতঘর নদীতে বিলীন হয়ে যাবে।

তারা আরও বলেন, রাতের বেলায় অধিক হারে বালু উত্তোলনের ফলে আমাদের বসতঘর নদীতে চলে যাওয়ার ভয়ে রাতে শান্তিতে ঘুমাতে পারিনা।  

অন্যদিকে মানববন্ধনে অংশ নেওয়া স্থানীয় বাসিন্দারা বলেন, ফেনী নদীর তীরে চরের ফসলি জমিতে কৃষি কাজ করে আমাদের অধিকাংশ পরিবারের সংসার খরচ চলে। আলীনগর এলাকার লোকজন বালু উত্তোলন করে ফসলি জমির বিশাল অংশ কেটে নেওয়াতে আমরা কৃষি জমি হারিয়েছি। কৃষি জমি হারানোর পাশাপাশি নিজেদের বসতবাড়িও নদী গর্ভে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় দিন কাটছে আমাদের।

এ বিষয়ে শুভপুর ইউপি চেয়ারম্যান আজিজুর রহমান মজনু জানান, সরকার নদীর চর ইজারা দেয়নি। কিন্তু মিরসরাইয়ের বালু খেকো চক্র অবৈধভাবে ছাগলনাইয়ার শুভপুর এলাকার মাটি ও বালু উত্তোলন করে নিয়ে যাচ্ছে। এতে করে ফেনী নদীর তীরে বসবাসকারী শুভপুরের অন্তত দুই শতাধিক বাড়িঘর এখন হুমকির মুখে।  

এমনকি জয়চাঁদপুরে অবস্থিত সরকারি গুচ্ছগ্রামের ৪৫টি পরিবার বালু উত্তোলনের ফলে মারাত্মক হুমকির মুখে রয়েছে বলেও জানান তিনি।

অন্যদিকে চরের কৃষি জমি কেটে নেওয়ার ফলে কৃষিতে ব্যাপক ক্ষতি সাধন হবে উল্লেখ করে ছাগলনাইয়া উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. সাফকাত রিয়াদ বলেন, শুভপুরে ২৫ হেক্টর কৃষি জমি রয়েছে। এ কৃষি জমি কেটে নেওয়া হলে কৃষিখাতে মারাত্মক ক্ষতি হবে।

ফেনী নদীর তীরবর্তী শুভপুরে দেড়শ সনাতন ধর্মালম্বীর বসবাস। অবৈধ বালু উত্তোলনের ফলে বাড়িঘর হারানোর আশঙ্কায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোকজন।  

দুলালী রানী দাস ও জয়া রানী দাস জানান, ফেনী নদীর চরের কৃষি জমিতে শাক-সবজি চাষ করে আমাদের পরিবারের দৈনন্দিন খরচ ও সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ বহন করতে হয়। অবাধে নদীর চর কেটে মাটি ও বালু উত্তোলনের ফলে কৃষি জমিসহ ভিটে-মাটি নদীতে বিলীন হওয়ার আশঙ্কায় দিন কাটছে।

অন্যদিকে, তাদের শেষকৃত্য সম্পন্ন করার শ্মশানটিও বালু উত্তোলনের কারণে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে বলে অভিযোগ করেন সনাতন ধর্মালম্বীরা। অবৈধ বালু উত্তোলনের বিরুদ্ধে আইনগত পদক্ষেপ নেওয়ার দাবি জানান তারা।

এদিকে, ফেনী নদী থেকে ছাগলনাইয়া উপজেলার শুভপুর জয়চাঁদপুরে অবস্থিত সরকারি আশ্রয়ণ প্রকল্পের বর্তমান দূরত্ব ৪শ মিটারের কাছাকাছি। নদীর চর কেটে প্রতিদিন মাটি ও বালু উত্তোলনের ফলে দিন দিন নদী থেকে আশ্রয়ণে প্রকল্পের দূরত্ব ক্রমশ কমছে। এতে মারত্মক হুমকিতে রয়েছে আশ্রয়নের বাসিন্দারা।  

জানা গেছে, জয়চাঁদপুরের আশ্রয়ণে প্রথমে ৩০টি পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয় এবং মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপহার হিসেবে নতুন ১৫টি পরিবারকে সেখানে ঘর উপহার দেওয়া হয়।  

আশ্রয়ণের বাসিন্দা রমজান আলী (৬৫) বলেন, ভিটেমাটি ছিলো না আমাদের। সরকার আশ্রয়ণে পরিবার নিয়ে থাকার সুযোগ করে দিয়েছে। ফেনী নদীর চর কেটে আমাদের পুনরায় গৃহহীন করার অপচেষ্টা করছে মিরসরাইয়ের বালু খেকো চক্র। আশ্রয়ণের ঘরগুলো বালুখেকো চক্রের হাত থেকে বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর সহযোগিতা কামনা করছি।

এদিকে, অভিযুক্ত ব্যক্তি করেরহাট ইউনিয়নের কামরুল ইসলাম জানান, আমরা চুরি করে রাতে বালু উত্তোলন করি না। সরকার থেকে ইজারা নিয়ে দিনের বেলায় বালু উত্তোলন করছি।

তবে ফেনী নদীর শুভপুর এলাকার জয়চাঁদপুরের চরে বালু উত্তোলনে সরকারিভাবে ইজারা দেওয়া হয়নি বলে জানান ছাগলনাইয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মৌমিতা দাস তিনি বলেন, শুভপুরে অবৈধ বালু উত্তোলনের বিষয়টি অবগত হয়ে আমরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছি।  

ইউএনও বলেন, স্থানীয়দের অভিযোগ, মিরসরাইয়ের লোকজন অবৈধভাবে বালু উত্তোলন করছে। এ বিষয়ে আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে ব্যবস্থা নেব।

অবৈধভাবে বালু উত্তোলনের বিষয়টি জেনেছেন উল্লেখ করে ফেনীর জেলা প্রশাসক (ডিসি) আবু সেলিম মাহমুদ-উল হাসান জানান, যেহেতু চট্টগ্রামের লোকজন এ অবৈধ বালু উত্তোলনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। আমি চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসকের সঙ্গে আলোচনা করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।

বাংলাদেশ সময়: ১৮২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১০, ২০২৩
এসএইচডি/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।