ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

জঙ্গি সংগঠনের টার্গেটে রোহিঙ্গারা

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২৩
জঙ্গি সংগঠনের টার্গেটে রোহিঙ্গারা কক্সবাজার জেলায় একটি রোহিঙ্গা ক্যাম্প। ফাইল ছবি

ঢাকা: ২০১৭ সালে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্যাতনে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে অনুপ্রবেশ করে কক্সবাজারের উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রয় নেয় ৯ লাখের বেশি রোহিঙ্গা। আশ্রয় নেওয়া ৯ লাখ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ৫ বছর পেরিয়ে এখন দাড়িয়েছে প্রায় ১১ লাখে।


 
বিভিন্ন সময় আন্তর্জাতিক মহল থেকে রোহিঙ্গাদের মিয়ানমারে প্রত্যাবর্তনে নানা আলোচনা শোনা গেলেও এখনো দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ দেখা যায়নি। এ অবস্থায় ক্যাম্পে বছরের পর বছর অবস্থান করা বাস্তুচ্যুত এই নাগরিকদের মাদক বাণিজ্য, খুনসহ নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ার খবর পাওয়া যাচ্ছে প্রায়ই।
 
সম্প্রতি নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার সামরিক শাখার প্রধান ও বোমা বিশেষজ্ঞের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান নতুন করে ভাবাচ্ছে সংশ্লিষ্টদের। সর্বশেষ নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের (হুজি) সদস্য সংগ্রহে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অর্থায়নের তথ্যও পেয়েছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
 
দেশের জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করছে আইনশৃ্ঙখলা বাহিনীর এমন একজন কর্মকর্তা বলছেন, সব জঙ্গি সংগঠনের টার্গেটে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী। তারা সংগঠনের সদস্য রিক্রুটে ক্যাম্পগুলোতে দীর্ঘদিন ধরেই নানা তৎপরতা চালাচ্ছে। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিটের সদস্যরা বিষয়টি নিয়ে ব্যপকভাবে কাজ করছে।
 
গত ২৩ জানুয়ারি ভোরে কক্সবাজারের কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প সংলগ্ন গহীন বনাঞ্চল এলাকায় অভিযান চালিয়ে নতুন জঙ্গি সংগঠন জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার অন্যতম শূরা সদস্য ও সামরিক শাখার প্রধান মাসুকুর রহমান ওরফে রনবীর ওরফে মাসুদ (৪৪) এবং সংগঠনের বোমা বিশেষজ্ঞ আবুল বাশার মৃধা ওরফে আলমকে (৪৪) গ্রেফতার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)।
 
কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তাদের অবস্থান শনাক্তের পর র‌্যাব অভিযান শুরু করে। এ সময় জঙ্গিরা র‌্যাব সদস্যদের লক্ষ্য করে গুলি ছুড়ে। একপর্যায়ে পার্শ্ববর্তী বনাঞ্চলে পালিয়ে গেলে সেখান থেকে রনবীর ও তার সহযোগী বাশারকে অস্ত্র, গোলাবারুদ ও নগদ টাকাসহ গ্রেফতার করা হয়।
 
র‌্যাব জানায়, এখন পর্যন্ত জামাতুল আনসার ফিল হিন্দাল শারক্বীয়ার ৩৮ জন বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা ও সক্রিয় সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এছাড়া, ২০২১ সাল থেকে এই জঙ্গি সংগঠনকে সহায়তা এবং সামরিক প্রশিক্ষণের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার দায়ে পাহাড়ী বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠন কেএনএফ-এর ১৪ জন নেতা ও সদস্যকে গ্রেফতার করা হয়েছে। যার ধারাবাহিকতায় গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে সংগঠনটির সামরিক শাখার প্রধান কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করছে জানা যায়। যার প্রেক্ষিতে সেখানে অভিযান চালিয়ে সামরিক শাখার প্রধানসহ দুইজনকে গ্রেফতার করা হয়।
 
রনবীর নতুন জঙ্গি সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাকালীন সদস্য। প্রথমদিকে সিলেট অঞ্চলে সংগঠনের দাওয়াতি ও প্রশিক্ষণ কার্যক্রমসহ সামরিক শাখার সদস্য নির্বাচন কার্যক্রম তত্বাবধান করতেন। এছাড়া, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগঠনের সদস্য রিক্রুটেও তার ভূমিকা ছিল। প্রায় ১ বছর আগে সংগঠনের সামরিক শাখা প্রধানের দায়িত্ব পাওয়া রনবীর রোহিঙ্গাদের টার্গেট করেই সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন কি-না এ বিষয়ে যাচাই-বাছাই করছে র‌্যাব।
 
র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, নতুন জঙ্গি সংগঠনের সামরিক শাখার প্রধান রনবীর দেশব্যাপী সদস্য ও অর্থ সংগ্রহ করছিলেন। সদস্য সংগ্রহ বা আত্মগোপনে থাকতে সে ক্যাম্পে অবস্থান করতে পারে। তবে আমরা এখন পর্যন্ত গ্রেফতারদের কাছ থেকে সরাসরি মিয়ানমারের বাস্তুচ্যুত নাগরিকদের সংগঠনে রিক্রুট করার কোনো তথ্য পাইনি। তবে তারা দেশব্যাপী রিক্রুট করেছে, বিভিন্ন জেলায় গিয়েছে। সেভাবে তাদের রিক্রুটমেন্টও চলমান রয়েছে।
 
গত ২৭ জানুয়ারি রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় অভিযান চালিয়ে হরকাতুল জিহাদের (হুজি) ৬ সদস্যকে গ্রেফতার করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিট (সিটিটিসি)।
 
গ্রেফতারদের মধ্যে মো. ফখরুল ইসলাম (৫৮) দেশে নেতৃত্বশূন্য হয়ে পড়া হুজিকে পুনরায় সংগঠিত করার চেষ্টা করছিলেন। যিনি আফগানিস্তানে ভারী অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ ও সরাসরি যুদ্ধে অংশ নেন। সে সময়কালে ফখরুল আলকায়েদা নেতা ওসামা বিন লাদেন ও মোল্লা ওমরের সঙ্গে একাধিকবার সাক্ষাৎও করেছেন।
 
সিটিটিসি জানায়, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী তথা সিটিটিসির জঙ্গি কার্যক্রম বিরোধী অপারেশন চলমান থাকায় এবং নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের মুফতি হান্নানসহ একাধিক নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি গ্রেফতার হওয়ায় হরকাতুল জিহাদ নেতৃত্বশূন্য হয়ে যায়। কিন্তু আফগানফেরত এই ফখরুল ইসলাম হুজির সদস্য সংগ্রহ ও অর্থ সংগ্রহ করা এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাওয়াতি কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছিল। যেকোনো সময় বাংলাদেশের গুরুপূর্ণ স্থাপনায় বড় ধরনের জঙ্গি হামলা পরিচালনার বিষয়ে সংগঠনের অন্যদের নিয়ে পরিকল্পনাও ছিল তার।
 
ফখরুল ও তার ছেলে সাইফুল ইসলাম অন্যান্য হুজি সদস্যদের নিয়ে একাধিকবার কক্সবাজার জেলায় অবস্থিত রোহিঙ্গা ক্যাম্পে অবস্থান করেন। রোহিঙ্গাদের সংগঠনে রিক্রুটের উদ্দেশ্যে মোটা অংকের টাকাও অনুদান দেন ফখরুল।
 
এ বিষয়ে সিটিটিসি প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে তারা একাধিকবার গিয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে সদস্য সংগ্রহের ক্ষেত্রে সফলও হয়েছে। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত আমরা দেশের এবং দেশের বাইরের বেশ কিছু নাম পেয়েছি। এছাড়া, রোহিঙ্গাদের জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ করতে বেশকিছু অর্থ সহায়তা দিয়েছে তারা। যার মাধ্যমে কিছু সদস্যকে হয়তো রিক্রুট করতে পেরেছে, আমরা এ বিষয়ে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করছি।
 
তিনি বলেন, আমরা জানতে পেরেছি তারা অর্থ সহায়তা দিয়েছে, তবে কী পরিমান অর্থ দিয়েছে তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি। রিমান্ডে তাদের কাছে আমরা অর্থের উৎসও জানার চেষ্টা করবো।
 
সূত্র জানায়, জঙ্গি সংগঠনগুলোর রোহিঙ্গাদের টার্গেটকে মাথায় রেখে রোহিঙ্গা ক্যাম্পকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করে যাচ্ছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিট ছাড়াও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা সমন্বিতভাবে কাজ করছে। রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে নজরদারি অব্যাহত রয়েছে এবং ভবিষ্যতে অবশ্যই নজরদারি আরও জোরদার করার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
 
সোমবার (৩০ জানুয়ারি) রাজশাহী মহানগরীর কাশিয়াডাঙ্গা কলেজ মাঠে অসহায় ও দুস্থ মানুষের মধ্যে শীতবস্ত্র বিতরণ শেষে সংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের মহাপরিচালক (ডিজি) এম খুরশীদ হোসেন বলেন, দেশের রোহিঙ্গারা এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারা সন্ত্রাসী ও জঙ্গি কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। ভুয়া পার্সপোট তৈরি করে বিদেশ পালিয়ে যাচ্ছে। তবে র‌্যাব এগুলো প্রতিরোধে কাজ করছে। যতই চেষ্টা করুক তাদের কোনো ধরনের অপকর্ম করতে দেওয়া হবে না। তাদের ব্যাপারে র‌্যাব সব সময়ই সতর্ক।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৫ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩১, ২০২২
পিএম/এসএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।