ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

‘গ্র্যাজুয়েট চা ওয়ালা’ ৩ শিক্ষার্থী

মো. মোস্তাফিজুর রহমান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট   | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯২৪ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৩
‘গ্র্যাজুয়েট চা ওয়ালা’ ৩ শিক্ষার্থী

দিনাজপুর: স্কুল জীবন থেকে প্রতিটা শিক্ষার্থীর ইচ্ছে থাকে লেখাপড়া শেষ করে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার কিংবা অন্য ভালো কোনো চাকরি করার। শিক্ষা জীবনের শুরুর ইচ্ছেগুলো অনেক শিক্ষার্থীর পূরণ হয়।

আবার অনেকের হয় না। তাই বলে চাকরির আশায় বসে থাকলে তো জীবন চলে না। জীবিকার তাগিদে খুঁজতে হয় বিকল্প পথ। সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপ্লোমা শেষ করে বিকল্প পথ হিসেবে চায়ের দোকানকে বেছে নিয়েছেন দিনাজপুরের তিন শিক্ষার্থী। তারা সেই দোকানের নাম দিয়েছেন ‘গ্র্যাজুয়েট চা ওয়ালা’।

দিনাজপুর শহরের প্রাণকেন্দ্র গোর-শহীদ ময়দানে গেলে অন্যান্য খাবারের দোকানের মতো দেখা মিলবে ভাসমান এই চায়ের দোকানের। দিনাজপুর শহরের একটি বেরসকারি পলিটেকনিক থেকে পাশ করে বর্তমানে ইন্টার্ন করছেন গ্র্যাজুয়েট চা ওয়ালা দোকানের প্রধান উদ্যোক্তা সুরুজ্জামান ইসলাম সুজন ও তার সহপাঠী সাইফুল ইসলাম। আর মোজাহিদুল ইসলাম রানা পড়ছেন সপ্তম সেমিস্টারে। তাদের বাসা পঞ্চগড় জেলার দেবীগঞ্জ উপজেলায়।



দিনাজপুর গোর-শহীদ ময়দানে গিয়ে দেখা যায়, পোড়া মাটির ও প্লাস্টিকের কাপে পরিপাটি করে সাজানো চায়ের দোকানটি। ওই তিন শিক্ষার্থীর কেউ বা চা বানাচ্ছেন, কেউ চা পরিবেশন করছেন চায়ের অপক্ষেমান গ্রাহকদের কাছে। বিকেল ৪টার শুরু হয় তাদের চা বিক্রির কার্যক্রম যা চলে রাত ৯টা পর্যন্ত। বিকেল হতেই বিভিন্ন কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর পাশাপাশি পরিবার নিয়ে অনেকেই তাদের দোকানে চা খেতে। চায়ের মান কেমন গ্রাহকদের মতামত জানানোর জন্য কাগজে লিখে সেটা লিখে বোর্ডে আটকানোর ব্যবস্থা রাখা হয়েছে।

ওই দোকানে চা খেতে আসা অনেকের সঙ্গে কথা হলে তারা এ উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন।  

দিনাজপুরের শেখপুরা ইউনিয়নের বাসিন্দা জহুরুল ইসলাম বলেন, পরিবার নিয়ে আমি খেলাধুলা দেখতে আসছিলাম। এখানে চা খাওয়ার জন্য দাঁড়া হলে গ্র্যাজুয়েট চা ওয়ালা দোকাটা দেখতে পেয়ে আসি। পরে জানতে পারি তারা সবাই সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের শিক্ষার্থী। তারা যে চাকরির আশায় বসে না থেকে ছোট করে হলেও ব্যবসা শুরু করেছেন, এটা অবশ্যই প্রশংসার দাবিদার। আমিও নিজেও মাস্টার্স শেষ করে দীর্ঘদিন বেকার ছিলাম।  

দিনাজপুর সদরের বাসিন্দা সাকো রানী দেও বলেন, চাকরির কারণে সব সময় আসা হয় না। আজকে আমার স্বামীসহ এখানে ঘুরতে এসে এই চায়ের দোকানটা দেখতে পাই। আমাদের দেশে বর্তমানে চাকরি পাওয়া কষ্টকর। তারা ডিপ্লোমা শেষ করে চায়ের দোকান দিয়েছে। এ রকম অনেকেই আছে যারা পড়ালেখা শেষ করে বেকার হয়ে বসে আছে। এদের দেখে অনেক শিক্ষিত বেকার যুবক নিজে কিছু করতে উৎসাহিত হবে। তারা যে তাদের মেধাকে এখন থেকে ব্যবসায়িকভাবে কাজে লাগাচ্ছে এজন্য তারা অবশ্যই সামনে আরও এগিয়ে যেতে পারবে বলে আশা করি।  

দিনাজপুর সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী মাহমুদুল হাসান বলেন, আমার বন্ধুদের মাধ্যমে জানতে পারি গ্র্যাজুয়েট চা ওয়ালা দোকানের কথা। আজকে চা খেতে এসেছি। এ দোকানের চা অনেক ভালো লাগলো। আর ভাইয়াদের ব্যবহার অনেক ভালো। তাদের দেখে আমাদের মতো অনেকেই চাকরির আশায় বসে না থেকে কিছু করতে উৎসাহিত হবে।

দিনাজপুর এম আব্দুর রহিম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে কর্মরত নয়ামী দাস নামে একজন বলেন, দামের তুলানায় গ্র্যাজুয়েট চা ওয়ালা দোকানের চা অনেক বেশি টেস্টি (স্বাদ) লাগলো। তারা সবাই শিক্ষিত হয়ে এরকম একটা উদ্যোগ নিয়েছে, যেটা সবাই পারে না। কারণ অনেকেই বা অনেকের পরিবারের লোকজন চান না শিক্ষিত হয়ে ছোটখাটো দোকান বা ব্যবসা করবে। আসলে চাকরির পেছনে ছুটাছুটি না করে নিজে কিছু করা অবশ্যই ভালো।  

কথা হলে গ্র্যাজুয়েট চা ওয়ালা দোকানের স্বত্বাধিকারী সুরুজ্জামান ইসলাম সুজন বলেন, আসলে ভিন্ন কিছু করার চিন্তা-ভাবনা থেকে আমার এই দোকান করা। এই দোকান দিতে গিয়ে প্রথমে পরিবারের লোকজনের বাধার সম্মুখীন হতে হয়। আমরা সেই বাধা উপেক্ষা করেই দোকানটা দেই। অনেকেই দোকানের এমন নামের বিষয়ে জানতে চান কেন এই নাম। আসলে এ নাম দেওয়ার আসল উদ্দেশ্য হলো সমাজরে শিক্ষিত অন্যান্য বেকারদের একটা বার্তা দেওয়া যে সমাজের কোনো কাজই ছোট না। ভারত, নেপাল, চীনসহ পৃথিবীর অনেক দেশেই এমন ছোট ছোট দোকান আছে যেগুলো পরে বড় বড় ব্র্যান্ডে পরিণত হয়েছে।  

সুরুজ্জামান ইসলাম সুজন আরও বলেন, আমাদের সমাজের অনেকইে ভাবেন যে ফুচকা বিক্রি করা, ঝালমুড়ি বিক্রি করা বা অন্যান্য ছোটখাটো ব্যবসা করা শিক্ষিতদের কাজ নয়। আসলে কোনো কাজই ছোট না। আমি ২০২০ সালে এই পরিকল্পনাটা করি, কিন্ত করোনাসহ বিভিন্ন কারণে সেটা হয়ে উঠেনি। পরে ২০২২ সালের ১৮ নভেম্বর এই গ্র্যাজুয়েট চা ওয়ালা নামে দোকান টা শুরু করি। বর্তমানে আগের চেয়ে বর্তমানে অনেক বেশি সাড়া পাচ্ছি। প্রতিদিন প্রায় ৩০০-৪০০ কাপ চা বিক্রি হয়। আর শুক্রবার বা বিভিন্ন ছুটির দিনে কাস্টমার বেশি হওয়ায় প্রায় ৫০০ কাপ পর্যন্ত চা বিক্রি হয়। এই দোকান থেকে যেটা আয় হয় তা দিয়ে আমরা নিজেদের পড়ালেখার খরচ চালাতে পারি, মেস ভাড়া দেই। ভবিষ্যতে এই দোকানকে আরও অনেক দূর পর্যন্ত এগিয়ে নেওয়ার পরিকল্পনা আছে।  

তিনি বলেন, আমাদের দোকানে বেশ কয়েক ধরনের চা বিক্রি করে থাকি। এখানে প্রতি কাপ গ্র্যাজুয়েট স্পেশাল চা ১৫ টাকা, ক্লেকাপ চা ২০ টাকা, চকলেট চা ৩০ টাকা, হরলিক্স চা ৩০ টাকা, জাফরানি চা ৫০ টাকা করে বিক্রি হয়। এছাড়াও হটকফি ৪০ টাকা, কেপাচিনো কফি ৬০ টাকা ও ফ্রেঞ্চফ্রাই ৪০ টাকা করে বিক্রি হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৯২৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৪, ২০২৩
এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।