ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

সাঙ্গ হলো অধীর অপেক্ষার

জাফর আহমদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৮৪৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২২
সাঙ্গ হলো অধীর অপেক্ষার

ঢাকা: শেষ হলো অধীর অপেক্ষার পালা। মেট্রোরেল নির্মাণের শুরু থেকে মিরপুরের রোকেয়া সরণির আশপাশের মানুষ তাদের দোকান-পাট বন্ধ, ব্যবসা কমে যাওয়া, চলাচলে দুর্ভোগ এবং আর্থিক ক্ষতি- সবকিছুই ভুলে গেল মেট্রোরেলের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে।

এসব বন্ধ দোকানের পাশে, ভবনের ছাদে ও গলির মুখে দাঁড়িয়ে ছবি তোলার মধ্য দিয়ে যেন উৎসব পালন করলেন সাধারণ মানুষ।

বুধবার (২৮ ডিসেম্বর) ১টা ৫২ মিনিটে উত্তরা থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মেট্রোরেলে চড়ে যাত্রা শুরু করে ২টা ৫ মিনিটে মিরপুর-১০ অতিক্রম করা পর্যন্ত মানুষজন বন্ধ দোকানের সামনে, পাশে ও গলির মুখে দাঁড়িয়ে থেকে ছবি তোলেন।

মেট্রোরেল উদ্বোধন উপলক্ষে রোকেয়া সরণির সব মার্কেট ২টা পর্যন্ত ছিল। তারপরও সবাই এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চড়া মেট্রোরেলের কোচটি দেখতে, স্বপ্নের উড়াল সড়ক চালু হওয়া দেখতে।  

সকাল থেকেই সড়কের ধারে আসতে শুরু করে জনসাধারণ। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের ভিড় আরও বাড়তে থাকে। কখন প্রধানমন্ত্রীকে বহন করা কোচটি মিরপুর অতিক্রম করবে, সেই অপেক্ষা যেন শেষ হয় না।

আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা মেট্রো রেলপথের দিকে তাকিয়ে আছেন। হাতে মোবাইল ফোনের ক্যামেরা রেডি। প্রধানমন্ত্রীকে বহন করা মেট্রোরেলের কোচটি আসার সঙ্গে সঙ্গে ছবি তুলে ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকবেন। এ ইতিহাস হলো দেশ মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশের, উড়াল সড়কের যুগে প্রবেশের, মাটি থেকে উপরে আরেক সড়ক দিয়ে গন্তব্যে ছুটে চলার যুগে প্রবেশের।

রোকেয়া সরণির গলির মুখে অপেক্ষারত রাহিদুল আসগরের চোখে-মুখে যেন এক বিস্ময়ের মুখোমুখি হওয়ার ব্যাকুলতা। ক্যামেরা হাতে দাঁড়িয়ে। যাবেন মতিঝিলে, দুই ঘণ্টা আগে বের হয়েছেন। রাস্তায় দাঁড়িয়ে মেট্রোরেল উদ্বোধনের কোচটি দেখে তারপর গন্তব্যে ছুটবেন।

খুব আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষায় থাকা রাহিদুল বাংলানিউজকে বলেন, অবশ্যই। দেশে মেট্রোরেল চলাচল শুরু হচ্ছে। সড়কের উপর দিয়ে চলাচল করবে রেল। এতদিন বাসে চড়ে পথে পথে থামা, মতিঝিলের আধা ঘণ্টার পথ যেতে হয় দুই ঘণ্টায়। মানুষের ধাক্কা-ধাক্কি ও যানজটে জান-মাল সবই ঝুঁকিতে থাকতো। এই অ্যানালগ যুগের অপেক্ষা শেষ। মেট্রোরেলের উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে শুরু হবে নতুন যুগের। এটা আনন্দের দিন, স্মরণীয় দিন। এটা উৎসবের বিষয়। এক নিশ্বাসে বললেন রাহিদ।

তরুণ-তরুণীদের আরও বেশি ছুঁয়ে গেছে মেট্রোরেল। সে কথাই জানালেন রাফসান সানি। সহপাঠিকে সঙ্গে করে রোকেয়া সরণির গলির মুখে অপেক্ষা করছেন। দুজনের হাতেই ক্যামেরা। উদ্বোধনী কোচটিকে ক্যামেরা বন্দি করতে চান তারা। দুজনই মোবাইল ক্যামেরা হাতে প্রস্তুত।

সানি বাংলানিউজকে বলেন, আমরা খুব এক্সাইটেড। এটা একটা সুন্দর দিন। আমরা মনে রাখবো। দেশ মেট্রোরেলের যুগে প্রবেশ করলো। স্বাধীন দেশ, মর্যাদাবান জাতির জন্য এটা আরও আগে প্রত্যাশা ছিল। তারপরও হচ্ছে, আমরা খুবই খুশি।

শুরু থেকে প্রায় পাঁচ বছরজুড়ে মিরপুরবাসীর জন্য দুর্ভোগ ও কষ্টের কারণ ছিল এই মেট্রোরেল নির্মাণ কার্যক্রম। এই দিনটির অপেক্ষায় সবকিছুই হাসি মুখে মেনে নিয়েছে মানুষ। শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া, মিরপুর-১০ নম্বর গোলচক্কর, ফায়ার স্টেশন ও সাড়ে এগারোর মত জায়গাগুলো ছিল একেকটি অন্ধকুপের মতো। তিন মাস আগেও ঘটেছে ঘরে ফেরার সময়গুলোতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা গাড়িতে বসে থাকার মতো ঘটনা। আজ সে সব ভুলে গেছে সবাই।  

সে কথাই জানালেন রোকেয়া সরণির টাইলসের শোরুম বেঙ্গল এজেন্সি ব্রাঞ্চ ম্যানেজার জয়দেব চন্দ্র দাস। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, আজকে আমরা খুশি। দেশে মেট্রোরেল চালু হচ্ছে। এটা আমাদের জন্য বড় পাওয়া। মেট্রোরেল তৈরির সময়ে রাস্তাঘাট সরু হয়ে যায়, গাড়ি চলাচল করতো কম। মানুষের চলাচলে অসুবিধা হতো। এই পাঁচ-ছয় বছর ব্যবসা বাণিজ্যে অনেক ক্ষতি হয়েছে। অনেকে লোকশান দিতে দিতে ব্যবসা ছেড়ে চলে গেছে। অনেকে কোনোমতে টিকে ছিল এই দিনটির আশায়। অবশেষে দিনটি এসেছে। আজকে আমরা খুবই খুশি।

সড়ক সংস্কার হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে এই এলাকার ব্যবসা বাণিজ্য ইতোমধ্যে ফিরতে শুরু করেছে। আজ মেট্রো উদ্বোধন হওয়ায়, ব্যবসা আগের অবস্থাতে ফিরে আসবে, যোগ করেন এই ব্যবসায়ী।

শেওড়াপাড়া, কাজীপাড়া ও সাড়ে এগারো মেট্রোস্ট্যান্ডের পাশের কিছু দোকান ও প্রতিষ্ঠান ঢেকে গেছে। এতে ধুঁকে ধুঁকে টিকে আছেন এ সব মার্কেটের দোকানদাররা। মেট্রোরেলে সুদিন দেখছেন তারাও!

মেট্রোরেল লাইনের খুঁটি বসানোর সময় সড়কের অর্ধেকটা ঢেকে রাখা হয় বেড়া দিয়ে। এর ফলে দুই পাশের সড়ক সরু হয়ে যায়। সড়কের পাশের মার্কেটের ওপর চাপ তৈরি হয়। ব্যবসা কমে যায়। অস্থায়ী দোকানগুলো বন্ধ হয়ে যায়। মার্কেটগুলোতে বিক্রি কমার কারণে চাকরি হারান অনেকেই। অবশ্য এর সঙ্গে কোভিডও কাজ করে অনুঘটকের। সড়ক স্বাভাবিক হয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে আবার ওই দোকানগুলোতে যোগ দিয়েছে নতুন লোক।

২০১৯ সালের চাকরি হারানো এহসান জানালেন সে কথাই। তিনি মিরপুরের সাড়ে এগারোতে চাকরি করতেন। মালিকের দোকানের বিক্রি কমে যাওয়ায় কর্মীদের ছাঁটাই করা হয়। মাঝে কয়েক বছর অন্য পেশার সঙ্গে থেকে আবার মিরপুর-১০ এ একটি শোরুমে চাকরি নিয়েছেন তিনি।

চাকরি চলে যাওয়ার ফলে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক দুর্ভোগ বেড়ে যায় তার। এত কিছুর পরও মেট্রো উদ্বোধনের আনন্দের সঙ্গে সামিল হয়েছেন এহসান। তিনি মেট্রোরেলের উঁচু পথের সঙ্গে দেশের মাথা উঁচু হওয়ার মিল দেখেন।

কিন্তু এই মাথা উঁচু কি কি ব্যবসা-বাণিজ্যকে সামনে এগিয়ে নিতে সহায়তা করবে? ক্ষতিপূরণে সহায়তা করবে?- এমন প্রশ্নে রোকেয়া সরণির ব্যবসায়ী জুয়েল এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী সফিকুল ইসলামের জবাব, অবশ্যই পারবে।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, রাস্তার ধারে এভাবে মার্কেট গড়ে ওঠা বিরল। আবার এই সড়কই রাজধানীর অর্ধকোটির বেশি মানুষের যাতায়াতের প্রধান অবলম্বন। মিরপুর-মতিঝিল সড়কটি দিন দিন মানুষের চলাচলের অনুপযোগি হয়ে উঠছিল। মার্কেটকে ঠিক রেখে সড়কের উপরে এ ধরণের যাতায়াতের ব্যবস্থা চিন্তা করা, একটি সুদূর প্রসারী ও সাহসী চিন্তা ছিল। যা আজকে প্রধানমন্ত্রীর উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে বাস্তবে রুপ পেল।

তাসবিহ হাতে সফিকুল ইসলাম বলেন, আল্লাহর কাছে সেই কৃতজ্ঞতা স্বীকার করছি যে, সরকার এত টাকা ব্যয়ে মানুষের জন্য উড়াল রেল সড়ক তৈরি করতে সক্ষম হলেন। এর কাজ চলাকালীন মানুষের চলাচল যেমন ঠিক রাখতে হয়েছে, তেমনি সড়ক কেন্দ্রিক মার্কেটের ব্যবসা বাণিজ্যও সচল রাখতে হয়েছে। এতে কিছু মানুষের ক্ষতি হলেও দেশের বৃহত্তর স্বার্থের কথা চিন্তা করে নিশ্চয়ই সে ক্ষতি হাসি মুখে মেনে নিচ্ছি।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০২২
জেডএ/এনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।