ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

জাতীয়

সুগন্ধা ট্রাজেডির এক বছর

পপির পথপানে চেয়ে আছে পরিবার

শফিকুল ইসলাম খোকন, উপজেলা করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০২২
পপির পথপানে চেয়ে আছে পরিবার ফজিলা আক্তার পপির মা-বাবা

পাথরঘাটা (বরগুনা): 'মোর মায় তিন হাজার টাকার কম্বল কিন্যা লঞ্চে উঠছিলো। বাড়ি আইয়া নাতিরে (লামিয়া) নিয়া ঢাকা নিয়া যাইবে।

মোর মাইয়ায় আর আইলোনা। মোর মাইয়াডা পুইরা কয়লা অইয়া গ্যাছে। যদি বাইচা থাকতে তয় এহনো আইতে'।  

ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে অভিযান-১০ লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডে নিখোঁজ গার্মেন্টসকর্মী ফজিলা আক্তার পপির মা আমেনা বেগম কান্নাজড়িত কণ্ঠে এসব কথা বলেন।

২০২১ সালের ২৪ ডিসেম্বর ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে ঘটে এক ইতিহাসের ভয়াবহ ঘটনা। ওই লঞ্চে অগ্নিকাণ্ডের সময় ফজিলা আক্তার পপিও ছিলেন। এক বছর পার হয়ে গেলেও আজও সন্ধান মেলেনি বরগুনার পাথরঘাটার ফজিলা আক্তার পপির।  

এক বছর ধরে পথপানে চেয়ে আছে একমাত্র মেয়ে লামিয়াসহ (১৪) পরিবারের স্বজনরা। প্রতি মুহূর্তই যেন পপির অভাবে ধুঁকে ধুঁকে দিন পার করছেন পরিবারের সদস্যরা।

নিখোঁজ ফজিলা আক্তার পপি (২৫) বরগুনার পাথরঘাটা উপজেলার চরদুয়ানী ইউনিয়নের ছোট টেংরা গ্রামের আফজাল হোসেনের মেয়ে। পারিবারিক কলহের কারণে ৮ বছর আগে স্বামী সামছুল ইসলামকে তালাক দেয় পপি।

স্বজনরা দুর্ঘটনার পর এমভি অভিযান-১০ লঞ্চসহ ঝালকাঠি ও বরগুনা সদর হাসপাতালের মর্গে এবং বরিশালের শের-ই-বাংলা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে খোঁজখবর নিয়েও তার সন্ধান পাননি। পরে বরগুনা জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ডিএনএ নমুনা দিয়েও মেলেনি শনাক্ত।

পপি ২০২১ সালের ২৩ ডিসেম্বর বৃহস্পতিবার ঢাকা থেকে পাথরঘাটায় অভিযান-১০ লঞ্চে রওনা হন। একমাত্র মেয়ে লামিয়াকে (১৩) বাবার বাড়ি থেকে নিজ কর্মস্থল ঢাকার সাভারে বিদ্যালয়ে ভর্তি করানোর জন্য নিতে আসছিলেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস পপির ইচ্ছে পূরণ হলো না।

পপির গ্রামের বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, সুনসান নীরবতা,আজও পথপানে চেয়ে আছে বাবা আফজাল হোসেন, মা আমেনা বেগম ও একমাত্র মেয়ে সন্তান লামিয়া। শুধু পরিবারের সদস্যরাই নয়, প্রতিবেশীরাও অপেক্ষা করছেন পপির জন্য। নিখোঁজের এক বছর হলেও আত্মীয়-স্বজনরাও আসছেন তাদের সান্ত্বনা দিতে।  

পপির বৃদ্ধ বাবা আফজাল হোসেন বলেন, একমাত্র মাইয়াডারে হারাইলাম। এহন ক্যামনে থাকমু। জামাই মাইয়াডারে ৮ বছর আগে তালাক দিয়া যায়। জীবন বাঁচাইতে ঢাকায় গার্মেন্টসে চাকরি করতো। মাইয়াডার লাশটা পাইলেও কবরডা দেখতাম।  

পপির মা আমেনা বেগম আরও বলেন, সন্তানহারা মা কিভাবে থাকে। সন্তানের অভাব কেউ পূরণ করতে পারে না। খুব কষ্টে দিন পার করছি। পপি লঞ্চে ওঠার সময় ফোন দিয়া বলছিলো- মা ছুটি কম, রুটি পিঠা খাইতে মন চায়। যা খাওয়াবা জলদি খাওয়াবা। সকালে হুনি যে লঞ্চে আমার মাইয়াডা ছিল ওইডাই আগুনে পুইরা গ্যাছে। আর মোর মাইয়াডা আইলেও না, রুটি পিডাও খাওয়াইতে পারলাম না। আমি নিশ্চিত মোর মায় আর নাই। গার্মেন্টসে ওয়েলফেয়ার অফিসার ছিল, ছুটিতে আসার দুদিন আগেও মোর মাইয়াডা আগুন লাগলে কিভাবে নেভাতে হয় এবং বাঁচার উপায় নিয়ে ট্রেনিং করিয়েছে কয়েকশ কর্মীকে। কিন্তু সে নিজেই আগুনে পুইড়া গেল।

পপির ১৪ বছরের একমাত্র মেয়ে লামিয়া বলে, মায় কইছিল, বাড়িতে আইয়া মোরে ঢাকায় নিয়া ভালো একটা স্কুলে ভর্তি করাইবে। এহনো মায় আয় নাই। হুনছি যে লঞ্চে আগুন লাগছে হেই লঞ্চেই মোর মায় আছিল। এহন মোরে মা কইয়া কেডা বোলাইবে। মোর মায় কি আইবে?

লামিয়া আরও বলে, মায়রে সব সময়ই মনে পড়ে, মাঝে মাঝে স্বপ্নেও দেখি। গত ৮ মাস বাবার কাছে ছিলাম, এহন নানা বাড়িতে থাকবো।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০২২
জেএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।