ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মালয়েশিয়া

আধ্যাত্মিকতা আর ভালবাসার সুরে কাওয়ালি

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩২ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৫
আধ্যাত্মিকতা আর ভালবাসার সুরে কাওয়ালি ছবি: মাহসিন সেল্লাদুরাই

ঢাকা: প্রায় আড়াই মিনিটের বাদ্যযন্ত্রের মূর্ছণার পর সুর তুললেন মেহের আলী। ডান হাত উচিঁয়ে যেনো সেই সুরকেই ছড়িয়ে দিলেন বিস্তৃতে।

পাশেই হারমোনিয়াম বাজাচ্ছে ভাই শেহের আলী।   
 
শাহ-ই-মারদান…/ শের-ই-ইয়াজদান.. কুওয়াআত-ই-পারওয়ারদিগার…/
(সাহসের রাজা…/আল্লাহর সিংহ…/আল্লাহর শক্তি..)
লা ফাতিহা ইল্লাহ আলি../লা..সাইফ.. ইল্লাহ.. জুলফিকার..
(আলির মতো কেউ নয়/জুলফিকারের মতো নেই কোন তলোয়ার)
আয়এএএএ…/ মান কুনতো মাওলা…
দারাআ দিল দারাআআ দিল দারা-ই-দানিইইই…
 
তুন তুনা তাআ নাআআ নাআআ নানাআআআ নানাআআনাআআ নাআনাআনাআআরেএএএ…

মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুরে এমবিপিজে’র মিলনায়তন ততক্ষণে সুরের মূর্ছণায় মগ্ন।
 
মেহের আলী, শেহের আলী দুই ভাই, এসেছেন পাকিস্তান থেকে।

ছন্দে ছন্দে বাজছে তালির আওয়াজ। সে আওয়াজ তুলছেন দলের বাকি ১৪জন সদস্য।

তালির তালে, হারমোনিয়ামের সুরে আর তবলার বোলে ভরে ওঠা আসরও তখন পুরোপুরি জমে গেছে।

আর মেহের আলীর শক্তিশালী ভারি কণ্ঠ আওয়াজ তুলে যাচ্ছে শাহ-ই-মারদান…/ শের-ই-ইয়াজদান..।

এমন একটা কাওয়ালীর রাত আসলে উপহার দিয়েছিলেন লিলিয়ানে ফান। সঙ্গে  মালয়েশিয়ায় বাংলাদেশি স্বেচ্ছাসেবক সৈয়দ মিনহাজুর রহমান।

কোন ফাঁকে অজান্তেই আমাদের হাতও মঞ্চের শিল্পীদের হাতের সঙ্গে সামিল হয়ে গেছে তালিতে।

হলফ করে বলতে পারি, আপনার মনে ছন্দ বা সুর কিছু না থাকলেও হাত তাল বসাতে বাধ্য হবে এমন কাওয়ালির আয়োজনে।

দুদিন আগে মাত্র মালয়েশিয়ার একটি ডিটেনশন ক্যাম্প ঘুরে মিনহাজের মন খারাপ ছিলো। আর ইন্দোনেশিয়ার ইমিগ্রেশনে বাংলাদেশি হিসেবে ঢুকতে না পারার কষ্ট ছিলো আমার মনে। এই কাওয়ালী তা সব মুছে দিলো নিমেষেই।

মেহের আলী আর শেহের আলীর সুর আমাদেরও যেনো হযরত আলীর বন্দনায় বিভোর করে দিলো।  
 
পৃথিবীর পথে চলতে থাকা অনেক আগের সময়ই যেন ফিরে এসেছে। ধরার ওপরের প্রলেপকে চূর্ণ করে ভালবাসাকে নামিয়ে আনছেন মেহের আলী, শেহের আলীর আর তাদের দল।

সৃষ্টিকর্তার প্রতি ভক্তি, হযরত আলীর গৌরব জানান দিচ্ছেন সুরে সুরে। নিজেদের সমর্পন করছেন আলী বন্দনায়। যেনো সুর আর তালে ভালবাসা ও ভক্তি ছড়িয়ে ঘুচিয়ে দিতে চান ধরার সব কলঙ্ক।

পেছনের সিট ছেড়ে আরও অনেকের মতো আমরা দুজন ততক্ষণে সামনের কার্পেটে আসন নিয়েছি। কাওয়ালির ঝঙ্কারে পুরো মিলনায়তন তখন আন্দোলিত, দর্শকরাও সুরে আচ্ছন্ন হয়ে মাথা ঝাকাচ্ছেন, হাতে হাত চাপড়ে তাল তুলছেন। সুরের ঢেউয়ে যেনো গা ভাসিয়েছেন তারা।
 
লিলিয়ানের আমন্ত্রণে এমন একটি মুগ্ধতা আর উচ্ছ্বাসপূর্ণ সন্ধ্যার অপেক্ষায় ছিলাম আগে থেকেই। আর তা যেনো পেয়ে গেলাম প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি গুনে।

কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশিদের কাছে কনসার্ট ধরনের সন্ধ্যা মানেই, হৈ-হুল্লোড়ের আমেজ। তবে গত ক’দিনে পুসাকার বেশ কয়েকটি পরিবেশনা উপভোগ করে বুঝতে পারলাম, এখানকার দর্শকরা আমাদের মতো হুল্লোড়ে আমোদের বহিঃপ্রকাশ ঘটান না। বরং মুগ্ধ হয়ে উপভোগ করেন।
 
পাশে বসে মিনহাজকেও কিন্তু বেশিই মুগ্ধ মনে হচ্ছিলো। কারণ কাওয়ালির সঙ্গে তার সম্পর্কটিও পুরোনো। নিজের মোবাইল ফোন থেকে রেকর্ডেড কাওয়ালি শুনিয়ে দিয়েছিলেন আগেই। জানিয়েছিলেন প্রায় রাতেই তিনি নাকি এই সুরে ঘুমানোর চেষ্টা করেন।

আরও জানাচ্ছিলেন চট্টগ্রামে তার বাড়িতেই হয় কাওয়ালির আয়োজন। তার দাদা এবং পরিবারের অনেকেই কাওয়াল। তাদের ভক্ত-অনুরাগী সংখ্যাও অনেক। এমনকি ভারত থেকেও তাদের বাড়িতে বড় কাওয়াল শিল্পীরা পরিবেশন করতে আসতেন। উর্দূ ভাষাতেও বেশ পারদর্শী মিনহাজ। এমন একজন সমঝদারের পাশে বসে মেহের আলী আর শেহের আলীর কাওয়ালী হয়ে উঠেছিলো আরও উপভোগ্য।
 
এর আগেও কাওয়ালী অনেক শুনেছি। কিন্তু এর প্রতি আকর্ষণের পাশে এবারই বুঝি হাওয়া লাগলো। মনে পড়ে গেলো  ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মলচত্ত্বরে একটি আয়োজনের কথা। সেটাই ছিলো প্রথম কাওয়ালি শোনা।

সময়টা ২০১২ সালের জুনেই হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন রেজিস্ট্রার রেজাউল করিম স্যার ছিলেন একজন শিল্পমনা। তার উদ্যোগেই সেদিন ঢাকার বিখ্যাত শামির হোসেন ও তার দল এসেছিলেন কাওয়ালি পরিবেশন করতে। মল চত্বরের সে রাতে ঠায় ৪০ মিনিট দাঁড়িয়ে কাওয়ালিতে আগ্রহ তৈরি হয়েছিলো।

‘আল্লাহকো মেহবুব কি../জাব ইয়াদি আগেয়ি../ বোলো আখ-ছে জিবরিল সে../আল্লাহ নে কাহা…’ এখনো কানে বাজে সেই সুর।
 
এবার বুঝি পুরোপুরি ভক্ত হয়ে গেলাম কাওয়ালির।
 
দলটির পুরুষরা পারিবারিকভাবেই বন্ধনে যুক্ত। বাবা, ভাই, চাচা, চাচাতো ভাই ছাড়াও রয়েছে পরিবারের মতোই অর্ন্তভুক্ত কয়েকজন।

একে একে চারটি গান গাওয়ার পর বিদায় নিতে চাইলেন কাওয়ালি দলের দুই ওস্তাদ। কিন্তু তখনও অতৃপ্ত শ্রোতারা গ্যালারি থেকে ‘ওয়ান মোর, ওয়ান মোর.. বলে আকুতি জুড়ে দিয়েছেন।
 
নিরাশ করলেন না মেহের আলী ও শেহের আলী। পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে আবারো হারমোনিয়ামে হাত রাখলেন মেহের আলী, সুর তুললেন শেহের আলী। হঠাৎ ভেসে আসতে শুরু করলো কেবলই তবলার বোল। বাজাচ্ছেন কামার আলী আমজাদ। তার হাতের যাদুতে প্রায় চার মিনিট ঝিম ধরে থাকলো  মিলনায়তন। মঞ্চ থেকেই তার ছুড়ে দেওয়া হাসি সত্যি বিগলিত করলো শ্রোতাদের।

এ কথা বলতেই হবে, তবলায় কাব্য তোলেন কামার আলী আমজাদ।
 
শেহের আলীর সা..সা.সাসাসাসাসাসাস..রেরেরেররে..গাগাগাগাগ মামামামামাম সারেগামায় আবারও আচ্ছন্ন হয়ে পড়লো মিলনায়তন।
 
‘হো..লাল মেরি../রাখিও বালা ঝুলায়…/লালান ও লাল মেরি../হো..লাল মেরি…পাত রাখিও বালা…/ঝুলায় লালান সিন্ধ্রি দা…/ সেভান দা সাখি শাহবাজ কালান্দার… দামা দাম মাস কালান্দার…’
 
শিল্পী রুনা লায়লার কণ্ঠে এই কাওয়ালি বাংলাদেশিদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। এই কাওয়ালিতে আর বসে থাকা নয়। মিলনায়তন ভর্তি শ্রোতাদের নাচিয়ে ছাড়লেন কাওয়াল দুই ভাই।

মিনহাজ জানালেন, কাওয়ালিতে মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটাতে বলতে হয় ‘বেশাখ’ যার মানে অতি চমৎকার।

তালির সঙ্গে সঙ্গে বেশাখ ছুঁড়তে থাকলাম। মাঝে মাঝে উর্দুর তর্জমাও করে দিচ্ছিলেন মিনহাজ। এতে কেবল সুরেই মুগ্ধ নয়, কথাও বুঝে নিতে পারছিলাম।
 
অবশ্য মেহের ও শেহের আলী এবং এজাজ শেহের আলীর সঙ্গে কথা হয়েছিলো আরও আগেই। কাওয়ালি আয়োজনের তিন দিন আগে ১৭ সেপ্টেম্বর।

ওই দিন হোটেল পিজে হিলটনে বসে দুই ভাইয়ের সঙ্গে কথা হয়। তারাই জানালেন, এক প্রকার আধ্যাত্মিক প্রেমবিষয়ক ভক্তিমূলক গান কাওয়ালি। এতে থাকে শুধুই প্রেম আর মানুষকে ভালবাসার কথা।

‘কওল’ থেকে কাওয়ালি শব্দটির উৎপত্তি। আমীর খসরু এই ধারার সঙ্গীতের প্রবর্তক। এ গান মূলত সুফি সাধকদের। ফারসি ও উর্দু ভাষায় রচিত কাওয়ালি গান মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে প্রচলিত। এ গানের স্থায়ী ও অন্তরার মধ্যে তাল বন্ধ রেখে প্রতিবার বিভিন্ন প্রকার স্বরবিন্যাস বা রাগের সমাবেশ করা হয়।
 
দলগতভাবে পরিবেশিত হয় এই গান। এতে এক বা দুজন মূল গায়ক থাকেন, অন্যরা ধুয়া ধরেন। তালযন্ত্র হিসেবে এতে ঢোলক ব্যবহূত হয় এবং সমবেতভাবে হাততালি দিয়ে তাল রক্ষা হয়। এটি কাওয়ালি গানের একটি প্রধান বৈশিষ্ট্য। যে সকল রাগ আধ্যাত্মিক প্রেমপ্রকাশক সে সকল রাগে কাওয়ালি গান গাওয়া হয়। এতে দাদরা, ধূমালি, রূপক, পশ্তু ইত্যাদি তাল ব্যবহূত হয়।
 
মেহের ও শেহের আলী ভ্রাতৃদ্বয় জানালেন, তারা হামদ, নাত, গজল, মানকাবাত, মুনাজাত সব ধরনের কাওয়ালিই পরিবেশন করেন।

বাংলাদেশের রুনা লায়লাকে গুণী শিল্পী হিসেবে জানেন তারা। তার প্রতি ভক্তিরও প্রকাশ মিললো তাদের কথায়।  
 
 
বর্তমানে এই অস্থির পৃথিবীকে শান্ত করতে কাওয়ালির প্রেমের সূফী বাণী ছড়িয়ে দিতে বলেন দুই ভাই। বলেন, এখানে শুধু আধ্যাত্মিকতা আর ভালবাসার কথা বলা হয়। এটা সম্প্রীতির গলা ছেড়ে গায়, এক সুরে সৃষ্টিকে গাথাঁর কথা বলে। হানাহানি, সংঘাত শেষের কথা বলা হয়। কথা হলো, নুসরাত ফতেহ আলী খান, জুনন ব্যান্ড, রবীন্দ্রনাথ, সাবরি ভাইদের নিয়েও।  
 
কাওয়ালি দক্ষিণ এশিয়ার পাকিস্তানের পাঞ্জাব, সিন্ধ, ভারতের হায়দ্রাবাদ, দিল্লি এবং অন্যান্য অঞ্চলের মতোই ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটে বেশ জনপ্রিয়। এটা সূফিবাদের অনুসারী এবং ভক্তিমূলক গান, যা সাতশ বছরের পুরনো ঐতিহ্য।
 
মেহের আলী-শেহের আলীর এই গানের দলটির মূল হিন্দুনস্তানি সংগীতের তালবান্দি ক্লাসিক্যাল স্কুল। পাকিস্তানের সীমান্ত শহর কাসুরে ১৯৫০ এ জন্ম এই দুই গুনী শিল্পীর। তাদের বাবার কাছ থেকেই সংগীতে সুর ধরেন গলায়। তাদের বাবা শিষ্য হন নুসরাত ফাতেহ আলী খানের বাবা ফাতেহ আলী খানের। কিশোর শেহের অালী ছিলেন বখসি সালামাত আলী কাওয়ালির শিষ্য। মেহের আলী এবং শেহের অালী বলেন নুসরাত ফতেহ আলীর পরিবার তাদের ওস্তাদ ঘারান। মোহাম্মদ আলী ফরিদির কাছ থেকে তালিম নেন মেহের অালী। সেখানেই তিনি সূফী দর্শন, কাব্য, সংগীতের অারো কাছে যান।
 
সূফী দর্শনের ওপর পরিস্কার ধারনা থাকতে হয় কাওয়ালদের। কাওয়ালীর সুর এবং কথাগুলোকে লালন করতে হয় মনে।
 
দলটি মনে করে তাদের সংগীত শান্তির ঐকতান তোলে হৃদয়ে। সুরের মোহে আবিষ্ট থাকেন শিল্পীরা নিজেরাও।
 
১৯৬০ সাল থেকে পেশা হিসেবে কাওয়ালিকে ধারন করেন আলী ভাতৃদ্বয়। তবে ১৯৮০ এর পর থেকেই অনেক বেশি পরিচিত পান তারা। তবে ১৯৯৫ সালের পর পাকিস্তান সরকারের নজরে আসলে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি দলটির। পৃথিবীর প্রতিটি কোণাতেই কাওয়ালিকে নিয়ে যেতে থাকেন তারা।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৩ ঘণ্টা, নভেম্বর ৭, ২০১৫
এমএন/জেডএম/এমএমকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

মালয়েশিয়া এর সর্বশেষ