ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

আইন ও আদালত

সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড মিলিবান্ড

শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াক যুক্তরাষ্ট্র

... | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২২৪৩ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৫
শরণার্থীদের পাশে দাঁড়াক যুক্তরাষ্ট্র

গত কয়েক সপ্তাহে মধ্যপ্রাচ্য থেকে ইউরোপে পাড়ি জমানো মানব ঢল এই সময়ের সবচেয়ে বড় বৈশ্বিক মানবিক বিপর্যয়। শরণার্থীদের এ দুর্দশা লাঘবে ইউরোপের রাষ্ট্রগুলোর চেয়ে সাধারণ মানুষের ভূমিকাই বেশি।

শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য জার্মানির ফুটবল ক্লাবগুলো বিশেষ প্রশিক্ষণকেন্দ্র খুলেছে।

অস্ট্রিয়ানরা শরণার্থীদের গ্রহণ করতে ছুটে এসেছে রেলস্টেশনে।

‘Syria is calling’ নামক ফেসবুক পেজে যোগ দিয়েছে ১৫ হাজারেরও বেশি মানুষ। এদের অনেকেই সিরিয়ার ওই মানুষগুলোর জন্য সাহায্যের হাত বাড়িয়েছে। এমনকি তাদের নিজ নিজ বাড়িতে আশ্রয় দেওয়ারও প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।

কিন্তু এমন একটি মানবিক বিপর্যয়ের মধ্যেও শরণার্থী বিষয়ে ওবামা প্রশাসন ভূমিকা রাখছে সতর্কভাবে। তুরস্ক যেখানে প্রায় ১৯ লাখ সিরিয়ান শরণার্থী গ্রহণ করেছে, জর্ডান গ্রহণ করেছে  ছয় লাখ আর লেবানন জায়গা দিয়েছে ১০ লাখের বেশি শরণার্থীকে, সেখানে আমেরিকা গত চার বছর সিরিয়ায় যুদ্ধকালে সর্বসাকুল্যে আশ্রয় দিয়েছে মাত্র দেড় হাজার শরণার্থীকে!

প্রেসিডেন্ট ওবামা আগামী অর্থবছরে (অক্টোবর থেকে শুরু হতে যাওয়া) মাত্র ১০ হাজার শরণার্থী অভিবাসী নেওয়ার যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা বিদ্যমান বাস্তবতায় প্রহসন ছাড়া আর কিছুই নয়!

জন কেরি অবশ্য বলেছেন, ২০১৭ সাল নাগাদ এ সংখ্যা ৩০ হাজার থেকে এক লাখ পর্যন্তও হতে পারে। কিন্তু কেরির বক্তব্যে এদের মধ্যে কতজন সিরিয়ান শরণার্থী তার আভাস পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে, শুধু মিউনিকই এক সপ্তাহে ২৫ হাজারের মতো শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে। তাই সিরিয়ার বর্তমান শরণার্থী সংকট মোকাবেলায় যুক্তরাষ্ট্রকে তাদের ঘোষিত শরণার্থী সংখ্যা পুনর্বিবেচনা করতে হবে।

উল্লেখ্য, যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৭৫ থেকে এ পর্যন্ত ৩০ লাখ মানুষ অভিবাসী হয়েছেন। অভিবাসন প্রত্যাশী বা প্রার্থীদের তুলনায় এ সংখ্যা অনেক কম। একসময় নির্দিষ্ট কিছু রাষ্ট্র বা অঞ্চল থেকেই অভিবাসীরা আমেরিকায় পাড়ি জমাতো। কিন্তু এখন সে অবস্থার বদল হয়েছে। যেমন, কেবল ২০১৩ সালেই ৬৪টি দেশ থেকে আমেরিকায় অভিবাসীরা এসেছেন।

আমেরিকান শরণার্থী বিষয়ক কার্যক্রমের কয়েকটি পর্যবেক্ষণ এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ পর্যবেক্ষণ বলছে, একটি সফল অভিবাসন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য জনগণের সক্রিয় ও কার্যকর অংশগ্রহণ প্রয়োজন। পাশাপাশি সরকারি ও বেসরকারি  সংস্থাগুলোর সম্পৃক্ততাকেও তারা গুরুত্ব দিচ্ছে।

সফল শরণার্থী পুর্নবাসন ও অভিবাসন কার্যক্রম পরিচালনার জন্য আমেরিকান সরকারকে কার্যকর আইনগত কাঠামো প্রণয়ন করতে হবে। এক্ষেত্রে শরণার্থীদের নিরাপত্তার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। একজন শরণার্থীর আগমন ঘটলে প্রথমেই যে বিষয়গুলো সামনে চলে আসে তা হচ্ছে তার নিরাপত্তা ও প্রাথমিক আশ্রয়স্থল। কারণ, এসময় তারা চরম নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকে।

পরবর্তী পর্যায়ে তাদের অন্যান্য অধিকারগুলো বাস্তবায়নের প্রসঙ্গ চলে আসে। সে অধিকার বাস্তবায়নের জন্য তাদের শরণার্থীদের মামলা পরিচালনায় রাষ্ট্রের ইতিবাচক ভূমিকা জরুরি। অন্যদিকে রাষ্ট্রে তাদের সম্পৃক্ত করার জন্য ভাষা শিক্ষার বিষয়টিও একইভাবে গুরুত্বপূর্ণ।

এ অবস্থায় আমেরিকান অভিবাসন সংস্থাগুলোকে সহায়তার হাত বাড়াতে হবে। এ লক্ষে অর্থ সংগ্রহ ও জনগণকে সম্পৃক্ত করার কাজে এগিয়ে আসতে হবে সবাইকে। একটি সফল শরণার্থী ও অভিবাসন কার্যক্রম পরিচালনা করতে হলে অবশ্যই সরকারি ও বেসরকারি অংশীদারিত্ব লাগবে। তাই আমেরিকান জনগণ যে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে, সরকারকেও একই কাতারে শামিল হতে হবে।  

রাষ্ট্র ও সমাজ গঠনে শরণার্থীদের ইতিবাচক ভূমিকার মূল্যায়ন করার সময় এখনই। তাদেরকে ‘বোঝা’ হিসেবে দেখা একটি ভ্রান্তি ছাড়া আর কিছুই নয়। বলে রাখা ভালো, শরণার্থী সমস্যা সমাধানের জন্য একটি সফল অর্থনৈতিক ভিত্তিতো লাগবেই।

শরণার্থী বিষয়ক একটি বার্ষিক প্রতিবেদনে (২০১৩ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদন) বলা হয়েছে, ছয় মাস পর্যন্ত আত্মনির্ভরশীল থাকে শতকরা ৬৯ ভাগ শরণার্থী।

ওয়াশিংটন ভিত্তিক শরণার্থী বিষয়ক সাম্প্রতিক এক সমীক্ষায় দেখা যায়, স্থানীয় আমেরিকানদের চেয়ে শরণার্থীদের কাজে যোগদানের হার বেশি। অর্থাৎ আত্মনির্ভরশীল হওয়ার জন্য তারা নিরন্তর সংগ্রাম করছে এবং এ প্রচেষ্টায় তাদের সাফল্যের হার আমেরিকানদের চেয়ে বেশি।

আগেই বলা হয়েছে, অভিবাসীদের রাষ্ট্র ও সমাজে আত্মীকরণ করার জন্য শিক্ষার কোনো বিকল্প নেই। বিশেষ করে শিশু শিক্ষা। দেখা যায়, অধিকাংশ শরণার্থী শিশুদের তেমন আনুষ্ঠানিক শিক্ষা থাকে না। ইংরেজীতে দক্ষতাতো আরো কম। কিন্তু তারপরও অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে, যদি সঠিক পদক্ষেপ নেয়া যায় তবে শরণার্থী শিশুরা স্বল্প সময়ের মধ্যেই স্কুলে গিয়ে আনুষ্ঠানিক শিক্ষায় অংশ গ্রহণ করতে পারে। পেতে পারে আলোর পথ।

ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির (আইআরসি) এক তথ্য মতে, এর পরিচালিত শিক্ষা প্রকল্প থেকে প্রায় শতকরা ৯৫ ভাগই ডিপ্লোমা ডিগ্রি অর্জন করে। অথচ স্থানীয় ইংরেজি জানা ছাত্রদের মধ্যে এই হার মাত্র ৬২ শতাংশ। কাজেই, শিক্ষায় অভিবাসীদের আগ্রহের বিষয়টি স্পষ্ট।  

শরণার্থী বাবা-মা’র কাছে তাদের ছেলেমেয়েরা শিক্ষার সুযোগ পাওয়া অনেক বড় প্রাপ্তি। শিশুদের শিক্ষা কার্যক্রমে অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে সমাজে অভিবাসীদের আনুষ্ঠানিক সম্পৃক্ততার সূচনা হয়। আজকের শিক্ষা তাদের ভবিষ্যত নিশ্চয়তার ইঙ্গিত দেয়। কারণ, আজকের শিশুরাই আগামী দিনের ‘অভিবাসনের’ সুফলভোগী ও রাষ্ট্রগঠনের হাতিয়ার।

তাই শরনার্থীরা বৈধ হওয়ার সাথে সাথেই তাদের জন্য নাগরিক সুযোগ-সুবিধার দ্বার উন্মুক্ত করতে হবে। কর্মস্থল ও আয়-উপার্জনের ক্ষেত্রে তারা হতে পারে অনন্য।

জাতিসংঘ আগামী কয়েক বছরে চার লাখ সিরিয়ান শরণার্থীদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করবে যা সিরিয়া থেকে তুরস্ক, লেবান ও জর্ডানে উদ্বাস্তু জনগোষ্ঠীর মাত্র ১০ ভাগ। কাজেই প্রয়োজন ও বাস্তবতার তুলনায় জাতিসংঘের ভূমিকাও নগণ্য।

অভিবাসী গ্রহণে আমেরিকার রয়েছে সুদীর্ঘ ইতিহাস। বৈধ হতে সক্ষম এমন অভিবাসীদের শতকরা ৫০ ভাগই আমেরিকায় বসবাস করছে। আমেরিকা তাদের গ্রহণ করেছে। এরই ধারাবাহিকতায় আইআরসি আমেরিকার কাছে অন্তত এক লাখ সিরিয়ানকে গ্রহণ করার আবেদন করেছে। এজন্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত জরুরি। প্রয়োজন রয়েছে অর্থায়নের। কিন্তু দুঃখজনভাবে ইউরোপের এ বিষয়গুলো নেই। ইউরোপের রাষ্ট্র প্রধানরা তাদের বৈঠকে এ বিষয়গুলোর ওপর গুরুত্বারোপ করবে বলে প্রত্যাশা করি।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর আজ অবধি এত মানুষ আশ্রয়হীন হয়ে পড়েনি। তাই এ অবস্থার মোকাবিলায় প্রয়োজন দৃঢ় রাজনৈতিক নেতৃত্ব।

শরণার্থীদের কাছে আমেরিকার চেয়ে ভালো গন্তব্য  আর কি হতে পারে!

সিরিয়া যুদ্ধের ফলে যে মানবিক বিপর্যয় দেখা দিয়েছে তার ইতি টানতে হলে শরণার্থীদের প্রতি আশ্রয়ের হাত বাড়িয়ে দিতে হবে। তাই নিজেদের মধ্যে দ্বন্দ্ব নিরসন করে রাজনৈতিক ও কুটনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে এ অবস্থার অবসান ঘটাতে হবে।

শরণার্থী সংকট মোকাবেলায় সিরিয়ার প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলোর পাশে দাঁড়ানোর এখনই সময়। কারণ তাদের একার পক্ষে এ চাপ সামলানো কঠিন।

স্মরণ করছি সেই সব আমেরিকান সুহৃদ মানুষগুলোকে যারা সিরিয়ার ওই শরণার্থীদের গ্রহণ করতে উন্মুখ হয়ে আছে। তাদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করেছে। সাধারণ সেই জনগণের পাশাপাশি আমেরিকাকেও একইভাবে এগিয়ে আসতে হবে। এতে রক্ষা পাবে অসংখ্য মানুষের মহামূল্যবান জীবন আর নৈতিক ও আন্তর্জাতিক দায়বদ্ধতা পালনে যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে যাবে আরো এক ধাপ।  

ডেভিড মিলিবান্ড, সাবেক ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী। ইন্টারন্যাশনাল রেসকিউ কমিটির প্রধান।

সূত্র: দি নিউইয়র্ক টাইমস।

ভাষান্তর: এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর

বাংলাদেশ সময়: ২২২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।