ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইচ্ছেঘুড়ি

ফচুর বোঝা | বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী

গল্প/ইচ্ছেঘুড়ি | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৪৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ৭, ২০১৮
ফচুর বোঝা | বাবলু ভঞ্জ চৌধুরী প্রতীকী ছবি

ফচুর বাবা নেই। বাবাকে কখনও দেখেনি। মায়ের কাছে বাবার কথা শোনে। মা রাগ করেন। বলতে চান না। কাকে যেন গালাগালি করেন। মুখে বিরক্তিভাব। বলেন, আমিই তোর মা, ‘আমিই তোর বাবা।’ ফচু বুঝতে পারে না। একজন লোক কী করে দুজন হয়!

মায়ের কথাটি ফচু বুঝলো, যেদিন মা মারা গেলেন। সাথে আরো কিছু বুঝলো।

মা দাঁড়িয়ে ছিলেন রাস্তায়। পার হয়ে ওপারে যাবেন। ওপারে বিস্কুটের দোকান। ফচুর জন্য বিস্কুট কিনবেন। রাস্তার দুদিক ফাঁকা। কোনো ভিড় নেই। মা রাস্তা পার হচ্ছেন। হঠাৎ সাঁ…আ… করে ছুটে এলো একটা বিআরটিসির বাস। মায়ের শরীরটাকে রক্ত আর মাংসের স্তূপ করে দিয়ে চলে গেলো। চারিদিকে ছড়িয়ে আছে মায়ের রক্ত। বিক্ষিপ্ত পড়ে আছে মায়ের মাংস। সকালের চিকচিকে রোদ পড়েছে ওই জায়গাটিতে। রোদের চিকচিকেটা বড় ফাঁকা। সেই ফাঁকা ভারী হয়ে আছে মায়ের কান্নায়। কেউ তা শুনতে পায় না।  

লোকে বলে এটা অ্যাকসিডেন্ট। কিন্তু নানা বলেন কেন? এটা কি অ্যাকসিডেন্ট? মানুষ কবরে যায় আস্ত শরীরে। মা যাচ্ছেন কীভাবে! মায়ের মুখ চেনা যায় না। পা চেনা যায় না। মা যে হাতে ধরে শহরে এনেছিলেন― সে হাত কই? মা যে মুখে ‘আমি তোর মা, আমি তোর বাবা’ বলেছিলেন― সে মুখটা কই? অ্যাকসিডেন্ট কি এরকম? ফাঁকা রাস্তার অ্যাকসিডেন্ট কি এরকম হয়? 

মাকে কবরে নিতে অসুবিধে হলো না। যেকোনোভাবেই ভাঁজ করা যাচ্ছে মাকে। মা যেন খেজুর পাতার পাটি। কাসেম আঙ্কেল মা-পাটিটাকে ভাঁজ করে দিলেন। কবরের কানায় বেঁধে যাচ্ছিল―তাই। সেই সঙ্গে বুকের ভেতরটাও ভাঁজ পড়ে যাচ্ছে ফচুর। সেই ভাঁজের মধ্যে উঁকি দিচ্ছে অনেক কষ্ট, অনেক প্রশ্ন। মাটি ঢাকা হচ্ছে কবরে। মা মাটি চাপা পড়ছেন। অদৃশ্য হচ্ছেন ধীরে ধীরে। বুকের ভেতরের ভাঁজেও দুটো প্রশ্ন চাপা পড়ছে ফচুর; ‘তবে খুন কি?’ ‘খুন আর অ্যাকসিডেন্ট কি এক?’

সত্যি। মা শুধু ‘বাবা’ নন। মা অনেক কিছু। মা মানেই এই পৃথিবীটা। মা শুধু এই পৃথিবীটা নিয়ে যেতে পারেননি। কিন্তু নিয়ে গেছেন এর সব। ফচু এখন বোঝে তা। ফচু খেলা করতে করতে বোঝে। কাজ করতে করতে বোঝে। রাসেল ভাই জোরে বল মারে। ফচুকে বলে কুড়িয়ে আনতে। একটা বিস্কুট দেবে। ফচু দৌড়িয়ে বল কুড়োতে যায়। দৌড়াতে দৌড়াতে মায়ের কথা বোঝে। কারো ঘুড়ি গাছে আটকে গেলে ফচুকে পাড়তে বলে। একটা পেয়ারা দেবে। ফচু লম্বা-উঁচু গাছে উঠতে উঠতে মায়ের কথা বোঝে। ফচু স্নান করে ভিজে গায়ে দাঁড়িয়ে থাকে। মা কই? মা বুঝি প্যান্ট নিয়ে আসবে। কেউ প্যান্ট এগিয়ে দেয় না। নিজের প্যান্ট নিজেকে খুঁজতে হয়, খুঁজতে খুঁজতে মায়ের কথা বোঝে।

বেশিদিন মায়ের সাথে শহরে আসেনি ফচু। মা কাজ নিয়েছিলেন রশিদ সাহেবের বাসায়। সে-ই দশ তলার ওপর। ফচু দশতলার জানলায় একলা তাকিয়ে থাকতো। নিচে বস্তির ছেলেরা খেলা করতো। ফচুর ইচ্ছে হতো― টুপ করে নেমে আসতে। মাকে বলতো, ‘এখানে খেলা করা যায় না, চলো বাড়ি ফিরে যাই। ’ মা আদর করে বলতেন, ‘তোকে মানুষ হতে হবে, গ্রামে কাজ নেই, ফিরে কী করবো?’ মা মরার পর নানা তাকে গ্রামে এনেছেন। ফচু ভাবে, মানুষ কী? সে কি মানুষ না? মা তাহলে মানুষ করতে চাইতেন কেন? বড়ো না হলে কি মানুষ হয় না? বাসের ড্রাইভার তো বড়। সে কি মানুষ? তার মা কি তাকে মানুষ করতে চাইতেন? এমন মানুষ করতে চাইতেন? 

নানা বলেন, মা বেহেস্তে আছেন। বেহেস্ত কোথায়? নানা বলেন, ওই আসমানে। ফচু রাতে আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকে। বেহেস্তের ছিটেফোঁটা খোঁজে। মা কেন বেহেস্তে আছেন? ফচু ছাড়া বেহেস্ত কি ভালো লাগবে মায়ের? সন্তান ছাড়া বেহেস্ত কি ভালোলাগে!

মা কেন মরে গিয়ে এতসব বুঝিয়ে গেলেন? এখনই এত বোঝার কি দরকার ছিল? এত বোঝার একটা ‘ভার’ আছে। তা বহন করা খুব কষ্ট। ফচু মনে মনে প্রশ্ন করে, বাসটা অনেক ভার বয়ে বেড়ায়, আমার ভারটা কি বইতে পারবে?

ইচ্ছেঘুড়িবাংলাদেশ সময়: ১৬৩০ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০১৮
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।