ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

কায়রোর ঐতিহ্যবাহী দুর্গ-মসজিদ

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৮
কায়রোর ঐতিহ্যবাহী দুর্গ-মসজিদ কায়রোর ঐতিহ্যবাহী দুর্গ-মসজিদ। ছবি : সংগৃহীত

প্রায় এক হাজার বছর আগে মিসরের ‘তুলুনিয়া রাজ্য’র প্রতিষ্ঠাতা ইবনে তুলুন কায়রোতে একটি পাথুরে পাহাড়ে দাঁড়িয়ে ঘোষণা দেন ,আমি এমন একটি মসজিদ নির্মাণ করতে চাই, যা মিসরের মতো দেশ পুড়ে ছাই হয়ে গেলেও তা অটল থাকবে। আর বন্যায় প্লাবিত হলেও ঠায় টিকে থাকবে।

তার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘ইবনে তুলুন মসজিদ’ নির্মাণ করেন। তৎকালীন ইসলামী রাষ্ট্র মিসরের কায়রোতে ‘আমর ইবনে আস’ ও ‘আসকার’ মসজিদের পর এটিই ছিল আয়তন ও গঠনপ্রক্রিয়ার দিক থেকে সবচেয়ে বড় মসজিদ।

স্কয়ারাকারে তৈরী মসজিদটির আয়তন ২৫ হাজার বর্গমিটার।

কায়রোর ঐতিহ্যবাহী দুর্গ-মসজিদের গম্বুজ ও মিনার।                                          ছবি : সংগৃহীত

ঐতিহাসিক কায়রোর একটি প্রসিদ্ধতম সাইয়েদা জয়নব উপকন্ঠে ও প্রস্তরবেষ্টিত ইয়াশকর পাহাড়ের মসজিদটির অবস্থান।

মিসরীয় একটি পৌরাণিক সংগঠনের তথ্যানুসারে, নুহ (আ.) এর যুগে মহাপ্রলয়ের পর তার নৌকা এ পাহাড়ের পাদদেশে এসে ভিড়ে। অন্যদিকে অন্যান্য ইসলামী গবেষকরা বলেন, নৌকাটি পূর্ব তুরস্কের দক্ষিণে একটি স্থানে ঠেকেছিল।

একটি প্রাসাদ ও দূর্গ
দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি পাহাড়ের চূড়ায় অবস্থান করায় এর বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ও সুবিধা রয়েছে। এখান থেকে দর্শনার্থীরা কায়রোর বেশকিছু পর্যটন এলাকা ও প্রত্নতাত্ত্বিক স্থান দর্শন করতে পারে। সুলতান সালাহউদ্দিন আইয়ুবির দুর্গ, কায়রো টাওয়ার, জামেয়া আজহার গার্ডেন ও মসজিদ, রিফায়ি ও সুলতান হাসান মসজিদ ইত্যাদি অনায়াসে দেখা যায়।

কায়রোর ঐতিহ্যবাহী দুর্গ-মসজিদের দারুাণ দৃশ্য।  ছবি : সংগৃহীত

ইবনে তুলুন নামে এই মসজিদটি তারকা খচিত নকশা ও নির্মাণশৈলিতে অনেকটা প্রাচীনযুগের অন্যসব মসজিদের মতোই। মসজিদের মধ্যখানে একটি বড়সড় আঙ্গিনা রয়েছে। চারপাশের ছায়ানিবিড় শামিয়ানা যেটিকে ঘিরে রেখেছে। তখনকার সময়ে পাঠদান, নামাজ আদায় ও অন্যান্য আলাপ-আলোচনার জন্য এগুলো বানানো হয়েছিল।

গভর্নর ইবনে তুলুনের আকাঙ্ক্ষা অনুযায়ী মসজিদটি তিনটি বিশেষ নির্মাণশৈলীতে তৈরী করা হয়। বিশেষত নীল নদের প্লাবন যেন দুর্গ-মসজিদটি স্পর্শ করতে না পারে এবং শত্রু পক্ষের দেয়া লেলিহান আগুনও যেন তার ঐতিহ্য, আভিজাত্যকে চিড় ধরাতে না পারে; সে জন্য বিশেষ শৈল্পিকতা ও পদ্ধতিতে তা নির্মাণ করা হয়েছে।  

নীল নদের পানি স্বাভাবিক স্তরের উপরে অবস্থান করতো বলে তিনি এমন সাহসী পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন।

মসজিদের শৈল্পিকতা ও নান্দনতত্ত্ব
প্রত্নতাত্ত্বিকদের তথ্যানুসারে মসজিদটিতে মোট ৪২টি দরজা রয়েছে। ভেতরের ১৯ টি দরজার প্রতিটি দৈর্ঘ্য ও প্রস্থে প্রায় ৬ মিটার। প্রতিটি দরজা লোহা-অঙ্কিত কাঠ দিয়ে তৈরী।

মসজিদটিকে ১৮০টি বড়বড় স্তম্ভ রয়েছে। যেগুলোতে লোহার নিকেল দ্বারা কারুকাজকৃত ১২৮টি জানালা রয়েছে। এগুলো নামাজের নির্দিষ্ট সময়ে খুলে দেয়া হয় এবং সূর্যের আলোকরশ্মি ভেতরটা আলোকিত করে রাখে। মসজিদের ছাদবাহী কাঠের স্তম্ভে বিভিন্ন স্তরে স্তরে দীপাধার রয়েছে।

তার দেয়াল ও প্রশস্ত পিলারে কোরআনের আয়াত ও অন্যান্য কারুকাজ খোদাই করে বসানো হয়েছে।

মসজিদ-আঙ্গিনায় মাঝারি ধরনের গম্বুজ আকৃতির একটি দালান রয়েছে। যার প্রতিটি পার্শ্বে নামাজের জন্য ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ওপরে রয়েছে একটি মিম্বার। দালানটির পেছনের অংশে ‘দুক্কাতুল মুবলাগ’ নামে একটি কাঠের তৈরী লম্বা উঁচু যন্ত্র রাখা আছে। (ঐসময়ে এটি মার্বেল পাথর, কাঠ ও সাধারণ দিয়ে বানানো)। দেখতে অনেকটা ঝাড়বাতির মতো। যা আজো তার গায়ে ঐতিহ্য ও উজ্জ্বল আবরণ ধারণ করে আছে। ঐ যন্ত্রটির কাজ সম্পর্কে এমন বর্ণনা পাওয়া যায় যে, নামাজ চলাকালীন তা নামাজ মধ্যবর্তী সময়ে পঠিত ইমামের কেরাত ও তাকবির প্রতিধ্বনিত করতো। এতে পেছনে দূরের মুসল্লিরাও আওয়াজ শুনতে পেতো। যা অনেকটা মাইক্রোফোন বা লাউডস্পিকারের মতো।

মেহরাব ও অন্যান্য
এর একেক প্রান্তে ফিকহি মাজহাব অনুসারে কয়েকটি মেহরাব বানানো হয়। যা তখনকার সময় থেকে মাজহাব বিভক্তির বহিঃপ্রকাশ। সামনের মেহরাবটি ইবনে তুলুনের বানানো। যা কালিমায়ে তাইয়্যেবা ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ দিয়ে সজ্জিত। সম্প্রতি এই মেহরাবটির উপরে নামাজের জায়গা করা হয়েছে। তার ঠিক বামপাশে সুলতান হিসাম উদ্দিন লাজিন ১২৯৬ সনে একটি মেহরাব নির্মাণ করেন যা ‘সাইয়েদা নাফিসা মেহরাব’ নামে পরিচিত।

কথিত আছে, ‘সাইয়েদা নাফিসা’ হলেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) এর নাতনী। বাকি মেহরাবগুলো ইসলামী শাসনামলে বিভিন্ন সময়ে বানানো।

কায়রোর ঐতিহ্যবাহী দুর্গ-মসজিদের গম্বুজ ও পেঁচানো মিনার।  ছবি : সংগৃহীত

অনিন্দ্য সুন্দর আজানঘর
মিসরে ইবনে তুলুনই সর্বপ্রথম ঘুরানো-পেঁচানো আজানঘরের বানান। অর্থাৎ সিঁড়িধার ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে ওপরের দিকে নির্মাণ করা হয়েছে। চল্লিশ মিটার দৈর্ঘ্যের আজানঘরটির পাদদেশ বর্গাকার হলেও ওপরের অংশটি গোলাকার। পর্যটকরা এর ওপরে চড়তে হলে তিনশো ষাটটি সিড়ি গুনতে হয়। সিঁড়িগুলোর উপরে রয়েছে একটি ছোট্ট দৃষ্টিনন্দন গম্বুজ।

মিসরীয় ৫ পাউন্ড মানের কাগুজে মুদ্রায় ‘ইবনে তুলুন মসজিদ’র ছবি রয়েছে। যা মসজিদটির ঐতিহ্য, রূপ-বৈশিষ্ট্য ও গুরুত্ব বোঝায়। ১১৭৭ খ্রিস্টাব্দে ইবনে তুলুন মসজিদের প্রথম পূণনির্মাণ করা হয়। ২০০৫ সর্বশেষ সংস্করণ ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ করা হয়। কায়রোর প্রত্নতাত্বিক প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে বারো মিলিয়ন পাউন্ড ব্যয়ে এটির সংস্কারকাজ সম্পন্ন হয়।

দৃষ্টিনন্দন এই মসজিদটি প্রায় ১৩৩২ বছর আগের মুসলিম সোনালি যুগের উন্নত নির্মাণশৈলী নন্দন-শিল্পের রূপ বহন করে চলছে।

লেখক, শিক্ষক, বক্সমাহমূদ দারুল উলূম কারিমীয়া মাদরাসা, ফেনী।

ইসলাম বিভাগে লেখা পাঠাতে মেইল করুন: [email protected]
বাংলাদেশ সময়: ১১২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৮
এমএমইউ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।