ঢাকা, সোমবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০২ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ইসলাম

ইসলামের দৃষ্টিতে চোখের পর্দা

ইসলাম ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১১২ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২৪
ইসলামের দৃষ্টিতে চোখের পর্দা

চোখ মহান আল্লাহ তায়ালার প্রদত্ত নেয়ামত সমূহের অন্যতম। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আমি কি তাকে (নেয়ামত হিসেবে) দু’টি চোখ দেয়নি?” (সুরা আল বালাদ: ৮)।

চোখ যে আল্লাহর পক্ষ থেকে কত বড়ো নেয়ামত; যাদের চোখ নেই তারাই বুঝতে পারে। এই চোখ দিয়ে আমরা সৃষ্টি জগতের অপরূপ সৌন্দর্যকে দেখতে পাই এবং এই চোখ দিয়ে জান্নাতে মুমিনরা সরাসরি আল্লাহ তায়ালাকে দেখতে পাবে।

চোখ আল্লাহ যেমনিভাবে নেয়ামত হিসেবে দিয়েছেন সাথে সাথে তার জন্য কিছু সীমারেখা ও বিধি নিষেধ নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, “হে নবী! মুমিন পুরুষদেরকে বলে দাও তারা যেন নিজেদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং নিজেদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে। এটি তাদের জন্য বেশি পবিত্র পদ্ধতি। যা কিছু তারা করে আল্লাহ তা জানেন” (সুরা আন নূর: ৩০)।

“আর হে নবী! মুমিন নারীদের বলে দাও তারা যেন তাদের দৃষ্টি সংযত করে রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানসমূহের হেফাজত করে। আর তাদের সাজসজ্জা না দেখায় যা নিজে নিজে প্রকাশ হয়ে যায় তা ছাড়া। আর তারা যেন তাদের ওড়নার আঁচল দিয়ে তাদের বুক ঢেকে রাখে” (সুরা আন নূর: ৩১)।

উপরিউক্ত প্রথম আয়াতে মুমিন পুরুষদের জন্য পর্দার দুটি বিধান আল্লাহ ফরজ করেন।
১. তারা তাদের চক্ষুকে সংযত রাখবে।
২. তারা তাদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করবে।
দ্বিতীয় আয়াতে মুমিন নারীদের জন্য এ দুটি বিধানসহ আরও দুটি বিধান মোট চারটি বিধান ফরজ করেন।
১. তারা তাদের চক্ষুকে সংযত রাখবে।
২. তারা তাদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করবে।
৩. তারা তাদের সৌন্দর্য প্রকাশ করবে না।
৪. তারা তাদের বক্ষকে ঢেকে রাখবে।

রাসুল (সা.) বলেন, “কেয়ামতের পূর্বে যিনা ঘরে ঘরে সংঘটিত হবে (যিনা ব্যাপক আকার ধারণ করবে) এবং প্রত্যেক আদম সন্তানকে আল্লাহ তায়ালা যিনার পরীক্ষা দ্বারা পরীক্ষা করবেন। ”

এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) আরও বলেন, “আল্লাহ তায়ালা আদম সন্তানের উপর ব্যভিচারের একটা অংশ লিখে দিয়েছেন এবং প্রত্যেক আদম সন্তানকে আল্লাহ তায়ালা যিনার পরীক্ষা দ্বারা অবশ্যই পরীক্ষা করবেন” (সহিহ বুখারি)।
হাদিস দ্বারা প্রমাণিত হয়, আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক আদম সন্তানকে জীবনে একবার হলেও যিনার পরীক্ষা দ্বারা পরীক্ষা করে যাচাই করে নিবেন।

মূলত যিনা দুই প্রকার
ক. সরাসরি যিনা
খ. রূপক অর্থে যিনা।
সরাসরি যিনার শাস্তির ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “ব্যভিচারিণী ও ব্যভিচারী উভয়ের প্রত্যেককে একশত বেত্রাঘাত করো” (সুরা আন নূর: ২)।

এক্ষেত্রে হযরত মায়েজ ইবনে মালেক (রা.) এর তাওবার ঘটনা উল্লেখযোগ্য। আল্লাহর রাসুল (সা.) একদিন সাহাবাদেরকে নিয়ে বসা অবস্থায় হযরত মায়েজ ইবনে মালেক (রা.) এসে তার উপর যিনার শাস্তি প্রয়োগ করার জন্য রাসুল (সা.) কে অনুরোধ করেন। বারবার অনুরোধের পর রাসুল (সা.) সাহাবীদেরকে নির্দেশ দেন তার উপর যিনার শাস্তি প্রয়োগ করার জন্য। কয়েকদিন পর রাসুল (সা.) সাহাবীদের নিয়ে হযরত মায়েজ ইবনে মালেকের কবর যিয়ারত করেন। যিয়ারত শেষে রাসুল (সা.) সাহাবীদেরকে উদ্দেশ্য করে বলেন আল্লাহ তায়ালা মায়েয ইবনে মালেকের তাওবা এমনভাবে কবুল করেছেন যদি কোন অভিশপ্ত জাতির উপর বণ্টন করা হতো তাহলে আল্লাহ তায়ালা গোটা জাতিকে ক্ষমা করে দিতেন।
রূপক অর্থে যিনা ছয় প্রকার:

আল্লাহ তায়ালা বলেন, “তোমরা যিনার কাছেও যেও না কারণ এটা অত্যন্ত খারাপ কাজ এবং খুবই জঘন্য পথ” (সুরা বনী ইসরাইল: ৩২)।

১.চোখের যিনা: রাসুল (সা.) বলেন, “চোখের যিনা হলো পরনারীর দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকানো ও হারাম জিনিস দেখা। ” রাসুল (সা.) আরও বলেন, “যে ব্যক্তি কোন পরনারীর দিকে খারাপ দৃষ্টিতে তাকাবে হাশরের তার চোখের মাঝে শিসা গলিয়ে দেওয়া হবে। ”
২.কানের যিনা: আমরা যদি কারো কথা শুনার পর তার প্রতি আকৃষ্ট হই অথবা কারো সাথে কথা বলার পর তার প্রতি আকর্ষণবোধ করি তাহলে আমি এর মাধ্যমে কানের যিনা করছি। কারণ রাসুল (সা.) বলেছেন, “কানের যিনা হলো শুনা। ”
৩.মুখের যিনা: রাসুল (সা.) বলেন, “মুখের যিনা হলো মুখ দিয়ে অশ্লীল কথা বলা। ” আমরা যারা দিনের পর দিন রাতের পর রাত ঘণ্টার পর ঘণ্টা পরনারীর সাথে মোবাইলে কথা বলছি রাসুলের ভাষায় আমরা মুখের যিনা করছি।
৪.হাতের যিনা: রাসুল (সা.) বলেন, “হাতের যিনা হলো আল্লাহর নিষিদ্ধ জিনিস স্পর্শ করা। ”
৫.পায়ের যিনা: রাসুল (সা.) বলেন, “পায়ের যিনা হলো হেঁটে হেঁটে ব্যভিচার করার জন্য যাওয়া। ”
৬.অন্তরের যিনা: রাসুল (সা.) বলেন, “অন্তরের যিনা হলো কল্পনা করা। ” চোখের যিনা করার পর তা যদি অন্তর দিয়ে কল্পনা করা হয় তা হলো অন্তরের যিনা। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আর যে ব্যক্তি রবের সামনে এসে দাঁড়াবার ব্যাপারে ভীত ছিল এবং নফসকে খারাপ কামনা থেকে বিরত রেখেছিলো তার ঠিকানা হবে জান্নাত” (সুরা আন নাজিয়াত: ৪০-৪১)।

আমাদের মূল আলোচনার বিষয় হলো চোখের পর্দা। আমরা আমাদের এ চোখ দিয়ে কী দেখছি ও কী করছি সব কিছুই আল্লাহ তায়ালা জানেন। যেমন আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আল্লাহ তায়ালা তোমাদের চোখের চুরি ও মনের গোপন কথা সম্পর্কে জানেন” (সুরা মুমিন: ১৯)।

আমরা চলতে ফিরতে যে কয়টি জায়গায় আমাদের চোখকে সংযত রাখার চেষ্টা করবো তা হলো-

১.পরিবার: আমরা অনেকেই যৌথ পরিবারে বসবাস করি। সেখানে আমরা পর্দা মেনে চলি কী না? যেমন পরিবারে ভাবী, চাচাতো বোন, ফুফাতো বোন, খালাতো বোন, মামাতো বোনদের সাথে আমরা পর্দা মেনে চলি কী না? না চললে আমাদের কঠিন শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে। এক্ষেত্রে রাসুল (সা.) বলেন, “বিপদের সময় হোক কিংবা আনন্দের সময় গায়েরে মুহরিম চিকিৎসক, শ্বশুর বাড়ির লোকজন, এমনকি অন্ধ ব্যক্তির কাছ থেকেও তোমাদের পর্দা করা ফরজ” (সহিহ বুখারি, মুসলিম)। অন্য হাদিসে রাসুল (সা.) বলেন, “তোমরা নারীদের নিকট যাওয়া থেকে বিরত থাকো। এক আনসারী সাহাবী বললেন ইয়া রাসুলুল্লাহ, স্বামী পক্ষীয় আত্মীয় সম্পর্কে আপনি কী বলেন? তখন রাসুল (সা.) বলেন, সে মৃত্যু সমতুল্য” (সহিহ বুখারি ও মুসলিম)।

২.সমাজ: আমরা সমাজে, কর্মস্থলে কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিদিন চলতে গিয়ে সহকর্মী ও সহপাঠীদের সাথে কী আচরণ করছি; সেখানে পর্দার বিষয়কে গুরুত্ব দিচ্ছি কী না তা ভেবে দেখা দরকার। এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) হযরত আলী (রা.) কে উদ্দেশ্য করে বলেন, “হে আলী এক নজরের পর দ্বিতীয় নজর দিবে না, কারণ প্রথম নজর ক্ষমা প্রাপ্ত, দ্বিতীয় নজরের ক্ষমা নেই” (আবু দাউদ, তিরমিজি)। হযরত জারীর ইবনে আবদুল্লাহ থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি নবীজিকে হঠাৎ দৃষ্টি পড়া সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, “তুমি তোমার দৃষ্টিকে ফিরিয়ে নাও” (আবু দাউদ, তিরমিজি)।

৩.মোবাইল: রাসুল (সা.) বলেন, “এমন একটি সময় আসবে যখন ঘরে ঘরে যিনা সংঘটিত হবে। ” আমার মনে হয় এখন শুধু ঘরে ঘরে যিনা সংঘটিত হয় না বরং কক্ষে কক্ষে যিনা সংঘটিত হয়। কারণ আমাদের হাতে যে মোবাইল সেট রয়েছে তারা মাধ্যমে আমরা কী দেখছি, কার সাথে কথা বলছি সে বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা অবহিত রয়েছেন। মোবাইল বা ইন্টারনেটে আমরা যে অশ্লীল ছবি বা ভিডিও দেখছি তার মাধ্যমে আমরা চোখের যিনা করছি। মোবাইলের মাধ্যমে যে গায়রে মুহরিমের সাথে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলছি তার মাধ্যমে মুখের ও কানের যিনা করছি।

পরিশেষে বলবো আমরা যদি আমাদের চোখকে সংযত রাখতে পারি তাহলে রাসুল (সা.) আমাদের জান্নাতের জিম্মাদার হবেন। যেমন হাদিসে এসেছে হযরত উবাদাহ ইবনে সামেত (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসুল (সা.) বলেছেন, “তোমরা আমাকে ছয়টি জিনিসের নিশ্চয়তা দাও, আমি তোমাদেরকে জান্নাতের নিশ্চিয়তা দিবো। ১. তোমরা যখন কথা বলবে সত্য কথা বলবে। ২. তোমরা যখন ওয়াদা করবে ওয়াদা পূর্ণ করবে। ৩. তোমরা আমানতকে যথাস্থানে পৌঁছিয়ে দিবে। ৪. তোমরা তোমাদের হাতকে সংযত রাখবে। ৫. তোমরা তোমাদের চক্ষুকে সংযত রাখবে। ৬. তোমরা তোমাদের লজ্জাস্থানকে হেফাজত করবে।

এ হাদিসের ব্যাখ্যায় মুহাদ্দিসীনগণ বলেছেন, এটা হলো নিশ্চয়তার বিনিময়ে নিশ্চয়তা, পরিপূর্ণতার বিনিময়ে পরিপূর্ণতা। অর্থাৎ যারা রাসুল (সা.) কে এ ছয়টি জিনিসের নিশ্চয়তা দিবে, রাসুল (সা.) তাদেরকে জান্নাতের নিশ্চয়তা দিয়েছেন।

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।