ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৯ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

আইটি ব্যবসায় সফল হওয়ার কৌশল

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০২৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৭, ২০১৯
আইটি ব্যবসায় সফল হওয়ার কৌশল আইটি বিষয়ে ক্লাস নিচ্ছেন লেখক

বাংলাদেশে আইটি ইন্ডাস্ট্রির ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়; কিন্তু সে তুলনায় আইটি এদেশের অর্থনীতিতে বিশেষ অবদান রাখার মত একটি ইন্ডাস্ট্রি হিসেবে দ্রুত উঠে এসেছে। প্রতি বছর অনেক আইটি কোম্পানি চালু হচ্ছে। এসব কোম্পানির কেউ কেউ অনেক ভাল করছে, আবার অনেকেই ভাল করতে না পারায় বন্ধ হয়ে যাচ্ছে।

আইটি ব্যবসায় সফল হওয়ার অনেক মন্ত্র রয়েছে, যেগুলো জানার চেয়ে বেশি জরুরি হলো সে বিষয়গুলো জানা যেগুলো আইটি ব্যবসা পরিচালনার সময় এড়িয়ে চলা উচিত। জেনে নেওয়া যাক সেই বিশেষ বিষয়গুলো।

অভিজ্ঞতা না থাকা শর্তেও ঝোঁকের বসে ব্যবসা শুরু করা: যেকোনো ব্যবসা শুরু করার আগে আপনি যা নিয়ে ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছেন, সেই প্রোডাক্ট বা সার্ভিস সম্পর্কে সঠিক জ্ঞান থাকা জরুরি। অন্যথায়, কিছু না জেনেই হুট করে ব্যবসা শুরু করা আর সাঁতার না জেনে পানিতে লাফ দেওয়া অনেকটা এক রকম ব্যাপার হয়ে যাবে। অনেকেই ‘আইটি ব্যবসায় প্রচুর লাভ’ এই কথা মনে করে ঝোঁকের বসে ব্যবসা শুরু করে দেন। অবশেষে আইটি প্রোডাক্ট, সার্ভিস এবং সর্বোপরি টেকনোলজি সম্পর্কে ধারণা না থাকার কারণে এক সময় ব্যবসা বন্ধ করে দিতে হয়। শুধু স্বপ্ন, অর্থ বা দক্ষ লোকবল থাকলেই চলে না, উদ্যোক্তা সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান থাকা জরুরি।  

সুনির্দিষ্ট ভিশন এবং মিশন স্টেটমেন্ট না থাকা: অনেক কোম্পানি থিওরিটিক্যালি বিভিন্ন ভিশন-মিশন লিখলেও মনেপ্রাণে শুধু অর্থ উপার্জনকেই মূল ভিশন-মিশন মনে করে, যেটি আসলে ফলপ্রসূ হয় না। বাস্তবে দেখা গেছে, সেসব কোম্পানিই সত্যিকারে ব্যবসা সফল হয়েছে যারা মানুষকে সেবা দিতে চেয়েছে।  

যুগোপযোগী প্রোডাক্ট বা সার্ভিস নিয়ে না আসা: কোনো কোম্পানি বছরের পর বছর একই সেবা দিয়ে ব্যবসা ধরে রাখতে পারে না। একটা নির্দিষ্ট সময় পর তাকে সেই প্রোডাক্ট বা সার্ভিসের নতুন কোনো ধরন বা পুরোপুরি নতুন ধরনের প্রোডাক্ট বা সার্ভিস নিয়ে আসতে হয়, না হলে ব্যবসা ধরে রাখা মুশকিল হয়ে পড়ে। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ক্রেতাদের চাহিদার কথা চিন্তা করে প্রোডাক্ট বা সার্ভিসে পরিবর্তন না আনলে কোম্পানি ধীরে ধীরে পিছিয়ে পড়বে।  

শুধু জনবলভিত্তিক সার্ভিস দেওয়া: শুধু ওয়েবসাইট, সফটওয়্যার, অ্যাপ বা ডিজিটাল মার্কেটিং ইত্যাদি সেবা লোকবলভিত্তিকভাবে দিয়ে বড় কোম্পানি তৈরি করা সম্ভব না। যতদিন যাচ্ছে বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর অনেকেই ওয়েবসাইট, সফটওয়্যার, অ্যাপ বা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের জন্য নিজেদের টিম তৈরি করে নিচ্ছে। সুতরাং ধীরে ধীরে বড় বাজেটের ক্লায়েন্ট কমে গিয়ে মার্কেটে শুধু মাঝারি এবং ছোট বাজেটের ক্লায়েন্টগুলোই থেকে যাচ্ছে। কোম্পানিকে দীর্ঘস্থায়ী এবং বড় করতে হলে অবশ্যই সার্ভিস দানকারী ওয়েবসাইট, সফটওয়্যার, মোবাইল অ্যাপ বা ডিজিটাল মার্কেটিং প্লাটফর্ম তৈরির দিকে ঝুঁকতে হবে। সফটওয়্যার-অ্যাজ-আ-সার্ভিস (যেমন: এন্টারপ্রাইজ ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম), কাস্টমার-টু-কাস্টমার বা বিজনেস-টু-কাস্টমার প্লাটফর্ম (যেমন: অ্যামাজন, ই-বে, উবার, পাঠাও) বা ডিজিটাল এগ্রিগেটর প্লাটফর্ম (যেমন: এসএমএস গেটওয়ে, পেমেন্ট গেটওয়ে, ডিমান্ড সাইড প্লাটফর্ম) ইত্যাদির প্রচুর চাহিদা রয়েছে, যা নিয়ে হাতেগোনা কিছু কোম্পানিই কাজ করে।  

কাস্টমারের কাছ থেকে প্রজেক্ট পেতে প্রজেক্টের টাইম এবং বাজেট অনেক কমিয়ে ফেলা: অনেক কোম্পানি বিশেষ করে স্টার্টআপ কোম্পানিগুলো মনে করে যে কাস্টমারকে কম বাজেট এবং কম টাইম বললে সে খুশি হয়ে প্রজেক্ট দিয়ে দেবে। নতুন কোম্পানির শুরুতে ক্লায়েন্ট পাওয়ার জন্য রিজনেবল ডিসকাউন্ট অফার করা খারাপ না। কিন্তু তাই বলে অত্যধিক কম বাজেট বা টাইম দেওয়া কখনই উচিত নয়। দেখা যাবে, আপনার সীমিত লোকবল দিয়ে আপনি দ্রুত প্রজেক্ট শেষ করতে যাবেন, তখন আর কোয়ালিটি মিট করা সম্ভব হবে না; অথবা বাজেট কম করে ফেলার কারণে দেখা যাবে আপনাকে হয়তো লস ঠেকাতে দায়সারাভাবে প্রজেক্ট শেষ করতে হচ্ছে। এভাবে বাজেট বা সময় কমিয়ে আপনি হয়তো প্রজেক্ট পাবেন, কিন্তু সেটি হয়তো আপনার ওই ক্লায়েন্টের সঙ্গে শেষ প্রজেক্ট হবে। সুতরাং ‘কম সময়’ বা ‘খুবই কম বাজেট’-কে আপনার হাতিয়ার না বানিয়ে, ‘কোয়ালিটি ডেলিভারি’-কে আপনার হাতিয়ার বানান, তাতেই বরং আপনি ক্লায়েন্টকে ধরে রাখতে পারবেন।  

প্রোডাক্ট/প্রজেক্ট হস্তান্তর পরবর্তী সেবা ঠিকমত না দেওয়া: অনেক কোম্পানিই প্রোডাক্ট বা প্রজেক্ট ডেলিভারি করার পর পরবর্তী সেবা এমনকি যোগাযোগ পর্যন্ত ঠিকমত রাখে না। অবশ্যই মনে রাখতে হবে যে, যেকোনো ব্যবসায়, বিশেষ করে আইটি ব্যবসায় ফিরতি কাস্টমারের প্রতি খেয়াল রাখা খুবই জরুরি। কারণ ফিরতি গ্রাহক পাওয়ার সুবিধা আইটিতে অনেক বেশি। আর ঠিকমত সেবা বা যোগাযোগ না রাখলে কোম্পানির উপর থেকে কাস্টমারের আস্থা উঠে যাবে, যা ব্যবসার জন্য খুবই ক্ষতিকারক।

খরচের উপর নিয়ন্ত্রণ না রাখা: অনেক কোম্পানি শখের বশে বা ভবিষ্যৎ চিন্তা না করেই বাড়তি খরচ করে ফেলে, যেটি পরবর্তীতে ব্যবসার ক্ষতি বয়ে আনে। যেকোনো খরচ করার আগে অবশ্যই সেই খরচের নিড অ্যানালাইসিস (প্রয়োজনীয়তা যাচাই) করা জরুরি। অনেক কোম্পানিই ব্যবসায় পরিবর্তনের (উন্নতি বা অবনতি) সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে খরচকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না, ফলে হয় কোম্পানি অর্থের চাপে পড়ে, না হয় বেশি খরচের কারণে কোম্পানিকে ক্ষতির  দিকে যেতে থাকে।  

কর্মচারীদের সুযোগ-সুবিধা দেওয়ার ব্যাপারে আগ্রহী না হওয়া: যেকোনো কোম্পানির চালিকাশক্তি হলো সেই কোম্পানির কর্মচারী; আর তাই কর্মচারীদের সুযোগ সুবিধার প্রতি খেয়াল রাখা খুবই জরুরি। অনেক কোম্পানি শখের বসে অভিজাত এলাকায় অফিস বানানো, জমকালো অফিস ডেকোরেশন করা ইত্যাদিকে প্রাধান্য দেয়। অথচ এসব খরচ কমিয়ে যদি তারা কর্মচারীদের বেতন এবং সুবিধার কথা ভাবে তাহলে বরং আরো ভাল ফল পাবে।  

নির্ভরশীলতাকে সমবণ্টন না করা: আপনি যদি দেখেন যে, আপনার কোম্পানির গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো গুটিকয় মানুষের উপর নির্ভরশীল, এবং সেই মানুষগুলোর কোনো বিকল্প নেই, তাহলে বুঝবেন আপনার কোম্পানি ঝুঁকিতে আছে। কারণ এই বিশেষ মানুষগুলো চলে গেলে বা ক্ষণিকের জন্যও না থাকলে আপনার কোম্পানির অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। তাই নির্ভরশীলতা এবং দায়িত্বকে সঠিকভাবে সবার মধ্যে বণ্টন করুন। শুধু তাই না, আপনার বিশেষ মানুষগুলোর ব্যাকআপও রাখার চেষ্টা করুন।  

সঠিক ম্যানেজমেন্ট এবং অপারেশনাল প্লান প্রতিষ্ঠা করা: কোম্পানিতে কে, কখন, কোথায়, কি কাজ করবে, কোন কাজটির পর কোন কাজটি হবে, কতক্ষণে কোন কাজের ডেলিভারি হবে, এই ব্যাপারগুলো সঠিকভাবে নিয়ন্ত্রণ করা খুবই জরুরি। কোম্পানির সার্ভিস ডেলিভারি করার জন্য স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিজার তৈরি করা এবং প্রোজেক্ট ও টাস্ক ম্যানেজমেন্টের জন্য সঠিক মডেল ও টুল নির্ধারণ করা এবং এসবের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা খুবই জরুরি। অনেক কোম্পানিতে দেখা যায়, কোথায় কি কাজ হচ্ছে তার কোনো স্বচ্ছচিত্র নেই, যার ফলে কেউ অনেক কাজের চাপে আছে, আবার কেউ কাজহীনভাবে বসে সময় কাটাচ্ছে।  

সঠিক মার্কেটিং স্ট্রাটেজি তৈরি করতে না পারা: অসাধারণ একটি প্রোডাক্ট বা সার্ভিস তৈরি করলেই শুধু হবে না, সেই সেবাটি সম্পর্কে মানুষকে অবগতও করতে হবে, যা কিনা এক সময় আপনার সেলস লিডে পরিণত হবে। আর মানুষকে আপনার প্রোডাক্ট এবং সার্ভিস সম্পর্কে জানানোর অন্যতম মাধ্যমই হল মার্কেটিং। আপনার সেবা কোন ধরনের টার্গেট মার্কেটের বা গ্রাহকের জন্য সেটি বুঝে সে অনুযায়ী যদি আপনি মার্কেটিং স্ট্রাটেজি তৈরি না করেন, তাহলে আপনার ব্যবসা উঠবে না। ডিজিটাল মার্কেটিং বর্তমানে অনেক জনপ্রিয়। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে আপনার সেবার সম্পর্কে আপনি সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারবেন। কিন্তু তাই বলে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মাধ্যমে যে আপনি আপনার সব সেবার সচেতনতা বৃদ্ধি করতে পারবেন বা সব সেবার সেলস-লিড আনতে পারবেন, ব্যাপারটা কিন্তু এমন না। সুতরাং কোন সেবার জন্য কোন ধরনের মার্কেটিং এবং সেটি কিভাবে করতে হবে, সেটা সঠিকভাবে প্লান করা জরুরি।  

সহজেই হাল ছেড়ে দেওয়া: বাস্তবে দেখা গেছে, অনেক কোম্পানি ভালো ভালো কনসেপ্ট নিয়ে শুরু করার পরেও খুব তাড়াতাড়ি সেই ব্যবসা গুটিয়েও নিয়েছে। এর কারণ হলো অনেকেই ধৈর্যের সঙ্গে ব্যবসাকে ধরে রাখতে পারে না। কয়েকদিন চলার পর যখন দেখে যে লাভ আসছে না বা ফলপ্রসূ হচ্ছে না, তখন সেই ব্যবসা গুটিয়ে নিয়ে অন্য কিছু করার চেষ্টা করে। আপনি যদি নিশ্চিত থাকেন যে আপনি যে ব্যবসা করছেন আসলেই সেই ব্যবসা সফল হওয়ার মত, তাহলে ধৈর্য ধরুন, এবং সহজেই ব্যবসার হাল ছেড়ে দেবেন না।  

নির্ঝর আনজুম
চিফ অ্যানালিস্ট অফিসার, রিভ সিস্টেমস লিমিটেড
ফ্যাকাল্টি হেড, পিপল অ্যান্ড টেক ইনস্টিটিউট অব ইনফরমেশন টেকনোলজি
ইমেইল: [email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১৬২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৭, ২০১৯
জেডএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।