ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

তথ্যপ্রযুক্তি

ব্র্যান্ড-পণ্যের প্রচারণায় ‘ইনফ্লুয়েন্সার’

তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৯০৬ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২৪
ব্র্যান্ড-পণ্যের প্রচারণায় ‘ইনফ্লুয়েন্সার’

সমাজ পরিবর্তনশীল। একবিংশ শতাব্দীতে তথ্যপ্রযুক্তির কল্যাণে সমাজের বিকাশ ঘটছে দ্রুতই।

দেশীয় থেকে শুরু করে আন্তর্জাতিক খবরাখবর এখন যেমন ইন্টারনেটের সুবাদে মানুষের হাতের মুঠোয়, তেমনি রোজকার বাজার-সদাইও যেকেউ করতে পারেন ঘরে বসেই, তার ডিজিটাল ডিভাইসে ক্লিক করে।  

তথ্যপ্রযুক্তির হাত ধরে এমনই বিকাশমান সমাজে এই শতাব্দীতে হাজির হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া অর্থাৎ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম, যেমন—ইউটিউব, ফেসবুক, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, এক্স (টুইটার) ইত্যাদি। আর গত কয়েক বছরে উত্থান হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের। ইনফ্লুয়েন্সার মানে প্রভাব ফেলেন এমন ব্যক্তি। সোশ্যাল মিডিয়ায় যারা প্রভাব ফেলার মতো অবস্থান তৈরি করতে পারেন, সাধারণত তাদেরই বলা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার।

সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার কী বা কে?
ইংরেজি শব্দ ‘ইনফ্লুয়েন্স’ এর অর্থ প্রভাব। অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি বলছে, যার প্রভাব আছে তাকে ইনফ্লুয়েন্সার বলা যায়। আরও খোলাসা করে বললে, মানুষের নির্দিষ্ট কোনো পণ্য বা সেবা ক্রয়ের সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা যার আছে, তিনিই ইনফ্লুয়েন্সার।

যুক্তরাজ্যের বার্মিংহাম সিটি ইউনিভার্সিটির এক প্রতিবেদন অনুসারে, সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সার হলেন এমন ব্যক্তি, যারা ফেসবুক, ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম, টিকটক ও এক্সের মতো প্লাটফর্মে নিজেদের সক্রিয় একটি অডিয়েন্স বা অনুসারী গোষ্ঠী গড়ে তোলেন।  

ইনফ্লুয়েন্সার হলেন তারা, যারা মৌলিক কোনো বিষয়ে কনন্টেন্ট বানিয়ে ও প্রচার করে তাদের বিশ্বাসযোগ্য অবস্থান তৈরি করেন। তারা যখন কোনো পণ্য বা ব্র্যান্ড নিয়ে মতামত তুলে ধরেন এবং ওই পণ্য বা ব্র্যান্ডকে বেছে নিতে বলেন, তখন তাদের অনুসারীরাও এতে উৎসাহিত হন এবং সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তারা চাইলে নিজেদের পেজে যেকোনো বিষয়ে অডিয়েন্সের সঙ্গে সরাসরি আলাপচারিতার ক্ষেত্র তৈরি করতে পারেন।

চলমান সময়ে বই, ফুড রিভিউ থেকে শুরু করে ফ্যাশন ব্লগিং পর্যন্ত সব ক্ষেত্রে ইনফ্লুয়েন্সারদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। প্রজ্ঞা ও অবস্থানগত বুদ্ধিমত্তা ইনফ্লুয়েন্সারদের ডিজিটাল অঙ্গনের শক্তিধর ও ক্ষমতাবানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করে।

এটা সম্ভব হয় তাদের কথা বলতে পারার যোগ্যতায়ই। ইংরেজ কবি ও বক্তা জর্জ হারবার্ট বলেছিলেন, ‘ভালো কথার দাম বেশি, খরচ কম। ’ বক্তৃতায় যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টোস্টমাস্টার ইন্টারন্যাশাল চ্যাম্পিয়ন এবং সৌদি আরবের প্রকৌশলী ও লেখক মোহাম্মদ কাহতানি তার এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘কথা এমনই শক্তিধর, যার মাধ্যমে আপনি একজনকে বস্তি থেকে তুলে সবচেয়ে সফল মানুষে পরিণত করতে পারেন, আর কারও হাসিখুশির জীবনকে তছনছ করে দিতে পারেন। ’

ইনফ্লুয়েন্সাররা সবসময়ই ছিলেন। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইনফ্লুয়েন্সার শব্দটি আইনত সংজ্ঞায়িত হচ্ছে। এই পরিচয়ধারীদের অঙ্গন একটি লাভজনক ইন্ডাস্ট্রি হয়ে উঠেছে, এমনকি এখন পেশাও হয়ে উঠেছে এটি। সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের প্লাটফর্মে কোনো বিষয়ে কনটেন্ট বানিয়ে সেটা প্রচার করে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করা যাচ্ছে। এমনকি গ্রহণযোগ্যতা অনুসারে অনেক ইনফ্লুয়েন্সার তাদের ওই কনটেন্টেই কোনো ব্র্যান্ড বা পণ্যের প্রচারণা চালাচ্ছেন মোটা অংকের অর্থের বিনিময়ে।

একটা সময় শোবিজ বা ক্রীড়াঙ্গনের তারকা ব্যক্তিত্বদেরই ইনফ্লুয়েন্সার মনে করা হতো। তাদের মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানের কারণে তারকাদের মতামত ভক্ত-অনুসারীদের কোনো ব্র্যান্ড বা পণ্য বেছে নিতে প্রভাবিত করতো। তথ্যপ্রযুক্তির সুবাদে বয়স-শ্রেণি নির্বিশেষে প্রত্যেকটা মানুষেরই এখন তেমন ভূমিকা রাখার সুযোগ আছে।

সবাইকে ইনফ্লুয়েন্সার বলা যাবে?
অবশ্য সোশ্যাল মিডিয়ায় বিপুলসংখ্যক ফলোয়ার বা অনুসারী গোষ্ঠী থাকলেই যাকে-তাকে ইনফ্লুয়েন্সার বলা যাবে না। বিশেষ করে এখনকার সময়ে সস্তা-মানহীন কনটেন্ট বানিয়ে ভাইরাল হওয়ার স্রোতে অনেকে গা ভাসিয়ে দেন, তাদের পেজেও বিপুলসংখ্যক ‘লাইক’ বা ‘ফলোয়ার’ আছে। গণমানুষের কাছে তারা বিনোদন যোগানোর উপলক্ষ বা খোরাকই হতে পারেন, কারও সিদ্ধান্তের ওপর প্রভাব ফেলার মতো গ্রহণযোগ্যতা তারা অর্জন করতে পারেন না।

ব্র্যান্ডের সঙ্গে ইনফ্লুয়েন্সারদের সম্পর্ক
বার্মিংহাম সিটি ইউনিভার্সিটির প্রতিবেদন অনুসারে, বিশ্বজুড়ে প্রযুক্তির প্রসারের ফলে কেবল একটি সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্কেই (ফেসবুক) যুক্ত তিন শ’ কোটির বেশি মানুষ। অন্য নেটওয়ার্কেও (ইনস্টাগ্রাম, টিকটক, ইউটিউব ও এক্স) যুক্ত কোটি কোটি ব্যবহারকারী। প্রত্যেকটি নেটওয়ার্কে এখন বিপুলসংখ্যক ইনফ্লুয়েন্সারের পদচারণা। এমনও ইনফ্লুয়েন্সার রয়েছেন, যাদের একটি রিভিউতে কোনো ব্র্যান্ড বা পণ্যের ব্যবসা তুঙ্গে উঠে যেতে পারে, বা একেবারে ধসে যেতে পারে।

গত বছরের ৮ মার্চ ঢাকার একটি রেস্টুরেন্টের কাচ্চিতে কথিত কুকুরের হাড় পাওয়ার অভিযোগ সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে পড়লে দেশজুড়ে হইচই পড়ে যায়। এমনকি ওই প্রতিষ্ঠান মারাত্মক ভাবমূর্তির সংকটে পড়ে। তাদের ব্যবসাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়। যদিও পরে অভিযোগটি অসত্য প্রমাণিত হয়।

আবার সম্প্রতি ফেনীতে ‘কাচ্চি ডাইন’ উদ্বোধনে যান আলোচিত ইউটিউবার তৌহিদ আফ্রিদি। তার আগমন ঘিরে সেখানে শত শত তরুণ-তরুণীর ভিড় তৈরি হয়। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায়, এক পর্যায়ে শৃঙ্খলার জন্য লাঠিচার্জ করতে হয় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে। তৌহিদ আফ্রিদি উদ্বোধন করে আসার পর কয়েকদিন কাচ্চি ডাইনের বাইরে ভোক্তাদের দীর্ঘ লাইন দেখা যায়।

ভোক্তার ক্রয়চিন্তাকে ইনফ্লুয়েন্সারদের এভাবে প্রভাবিত করার সক্ষমতা বড় বড় ব্র্যান্ডগুলোর নজরও এড়াচ্ছে না। উপরন্তু তারা নিজেদের প্রচারণার জন্য সোশ্যাল মিডিয়া ইনফ্লুয়েন্সারদের প্লাটফর্ম ব্যবহার করার দিকে ঝুঁকছে। এরই অংশ হিসেবে তারা মার্কেটিং সহযোগিতা ও প্রচারণায় ইনফ্লুয়েন্সারদের জন্যই আলাদা বাজেট বরাদ্দ করছে। বিশ্বখ্যাত অ্যাডিডাস, মোর্ফের মতো অনেক বড় বড় প্রতিষ্ঠান ইনফ্লুয়েন্সারদের মাধ্যমে তাদের প্রচারণা চালাচ্ছে। ফল হিসেবে তারা অনলাইনে সক্রিয় ভোক্তা পাচ্ছে, বিক্রির উর্ধ্বগতি দেখছে। কুড়াচ্ছে খ্যাতিও।

ছোটখাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোও সোশ্যাল মিডিয়ায় নিজেদের প্রচারণার জন্য ইনফ্লুয়েন্সারদের দ্বারস্থ হচ্ছে। সেজন্য তারা নিজেদের পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের রিভিউ করে দেওয়ার জন্য হয়তো ইনফ্লুয়েন্সারকে কোনো উপহার দিচ্ছে, অথবা তাকে নিজেদের সেবা বা পণ্য বিনামূল্যে সরবরাহ করছে, যাতে সেটা নতুন ভোক্তার কাছে পৌঁছায়। এর ফলও মিলছে। সেজন্য এখন প্রায়ই ফেসবুক-ইউটিউবে অনেক উদ্যোক্তাকে তার পণ্য বা প্রতিষ্ঠানের প্রচারণায় ইনফ্লুয়েন্সারকেই হাজির করতে দেখা যাচ্ছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২২, ২০২৪
এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।