ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

দেশে তিন কারণে সেরিব্রাল পালসি রোগ

স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০২০
দেশে তিন কারণে সেরিব্রাল পালসি রোগ সেরিব্রাল পালসির সার্জিক্যাল চিকিৎসা সংক্রান্ত সেমিনারে ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী | ছবি: জিএম মুজিবুর

ঢাকা: দারিদ্র্য, অশিক্ষা ও নারীর প্রতি অবহেলা— এই তিন কারণে বাংলাদেশে সেরিব্রাল পালসি (মস্তিষ্কের অবশভাব) রোগের বিস্তৃতি বেশি বলে জানিয়েছেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী।

শনিবার (১৪ নভেম্বর) দুপুরে গণস্বাস্থ্য নগর হাসপাতালে সেরিব্রাল পালসির সার্জিক্যাল চিকিৎসা সংক্রান্ত সেমিনারে এ তথ্য জানান তিনি।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন নিউরোসার্জন অধ্যাপক ডা. ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী। বক্তব্য রাখেন ঢাকা শিশু হাসপাতালের পেডিয়াট্রিক নিউরোসার্জন ও বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক মোস্তফা মাহবুব, ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরোসায়েন্সের সহকারী অধ্যাপক ডা. নাজমুল হক, শিশু বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মেজবা উদ্দিন আহমেদ, গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রেস উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু ও সহযোগী অধ্যাপক ডা. কণা চৌধুরী।

ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেন, পুষ্টিহীনতা ও বাচ্চা হওয়ার সময় পর্যাপ্ত অক্সিজেন না পাওয়া—এ দুটি সমস্যার কারণে সেরিব্রাল পালসি রোগ হয়ে যেতে পারে। তাই আমাদের প্রথম কাজ হবে এটি প্রতিরোধ করা। যদি রোগটি হয়ে যায় তাহলে সার্জিক্যাল অপারেশনে তা ভালো হয়। চিকিৎসা খুবই ব্যয়বহুল। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অপারেশনে তিন থেকে চার লাখ টাকা নেয়। আমরা এক লাখ টাকায় এ চিকিৎসা দিচ্ছি।

সেমিনারের অন্যান্য বক্তারা বলেন, ফেসিয়াল পালসির অর্থ হলো ফেসিয়াল নার্ভ প্যারালাইসিস (মুখ বেঁকে যায়, চোখ খোলা থাকে)। সেরিব্রাল পালসিও ওই রকম একটা রোগ। যেখানে মস্তিষ্কের কিছু কিছু অংশ নষ্ট হতে থাকে বা নষ্ট হয়ে যায়। সহজে সেরিব্রাল পালসি মানে আমরা বলতে পারি—আংশিক ব্রেইন প্যারালাইসিস।

সাধারণত জন্মের পর পর নবজাতক ভালোভাবে নিশ্বাস নিতে না পারলে শরীরে অক্সিজেন স্বল্পতা দেখা দেয়। এই অক্সিজেন স্বল্পতায় সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় মস্তিষ্ক। আমাদের দেশে ১০০০ বাচ্চা জন্ম নিলে তার মধ্যে ৩.৫ জন বাচ্চা আক্রান্ত হয় সেরিব্রাল পালসিতে, যা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তুলনায় ১.৫ গুণ বেশি। এই রোগীদের অধিকাংশের খিচুনি হয়, যখন খিচুনি হয় তখন বাচ্চা নিশ্বাস নিতে পারে না। এভাবে বারবার খিচুনি হলে অক্সিজেন স্বল্পতার কারণে মস্তিষ্কের ক্ষতি হতে পারে।

বক্তারা আরও বলেন, সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত বাচ্চারা হাবা-গোবা হয়, হাঁটাচলা করতে পারে না, তাদের ঘাড় শক্ত হয় না, অন্যদের সঙ্গে কমিউনিকেট করতে পারে না, মুখ দিয়ে লালা পড়ে, শক্ত খাবার খেতে পারে না, রোগ যখন তীব্র হয় তখন বাচ্চা তরল খাবারও খেতে পারে না। অনেক বাচ্চা কথাও বলতে পারে না, অনেক রোগী চোখে দেখে না, অনেক রোগীর হাত-পা শক্ত হয়ে যায় এবং তারা নিজে নিজে চলাফেরা করতে পারে না। সব রোগীর ক্ষেত্রে সবগুলি লক্ষণ থাকবে তা নয়।

সেরিব্রাল পালসিতে আক্রান্ত বাচ্চাদের মাথার খুলি ছোট থাকে। তাদের মাথার খুলি ছোট হওয়ার কারণে মস্তিষ্কের পর্দাও ছোট হয়। মাথার খুলি যেহেতু বাড়ে না, মাথার জোড়াগুলো এক বছরের আগেই সম্পূর্ণ জোড়া লেগে যায়। মস্তিষ্কের পূর্ণতা লাভের জন্য ৫ বছর পর্যন্ত বাড়তে হবে, ওই বাচ্চাদের তা আর সম্ভব হয় না। এ অবস্থায় মাথার খুলি কেটে মস্তিষ্কের পর্দা কেটে প্লাস্টিক সার্জারি করে দিলে মস্তিষ্ক বেড়ে ওঠার যথেষ্ট জায়গা পায়। ফলে দ্রুত মস্তিষ্ক বেড়ে উঠে পূর্ণতা পায় এবং অন্যান্য উপসর্গ লোপ পায় বলে জানান সেমিনারের বক্তারা।

সেরিব্রাল পালসির কারণ:
১. জন্মকালে মস্তিষ্কে অক্সিজেন স্বল্পতা
২. মস্তিষ্কে সংক্রমণ
৩. ২৮ সপ্তাহের আগে বাচ্চার জন্মগ্রহণ
৪. জন্মের পর অল্প ওজন থাকা
৫. গর্ভাবস্থায় ভাইরাসের সংক্রমণ

সেরিব্রাল পালসির প্রচলিত চিকিৎসা প্রসঙ্গে নিউরোসার্জন অধ্যাপক ডা. ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, সাধারণত উন্নত বিশ্বে অনেক স্পেশালিস্ট নিয়ে যেমন—নিউরোসার্জন, নিউরো মেডিসিন, ফিজিক্যাল মেডিসিন, সাইকিয়াট্রিস্ট, অর্থপেডিক সার্জন সবাই মিলে একটা টিম গঠন করে চিকিৎসা দেওয়া হয়। যে সমস্ত মেডিসিন ব্যবহার করা হয় তা হলো—এন্টিইনফ্ল্যামেটরি, খিচুনি বন্ধ হওয়ার ওষুধ, বেঞ্জোডায়াজেপিন, বেক্লোফেন, ডেন্ট্রোলিন, গাবাপেনটিন, কার্বিডোপা-লিভোডোপা, বেঞ্জট্রপিন। ইনজেকটেবল ফরমে দেওয়া হয় বটোলিনিয়াম টক্সিন এবং সাথে ফিজিও থেরাপি দেওয়া হয়। সার্জারি যেটা করা হয় তা হলো—ব্যাক্লোফেন পাম্প, টেনডম রিলিজ, হিপ রোটেশন সার্জারি, স্পাইল ফিউশন, স্ট্রেবিসমাস রিপিয়ার, ডিপ ব্রেইন স্টিমুলেশন।

তিনি আরও বলেন, আমরা ব্রেইনের ভল্ট কেটে ব্রেইনের পর্দাসহ প্লাস্টিক সার্জারি করে প্রতিস্থাপন করি। এতে রোগীর অন্য কোনো চিকিৎসা খুব একটা প্রয়োজন পড়ে না। তবে ফিজিওথেরাপি ও অন্যান্য সাপোর্ট রোগীকে দ্রুত সুস্থ করে তোলে।

চিকিৎসা নেওয়া এক রোগীকে দেখিয়ে ডা. ফরিদুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আমাদের এই রোগী টাকা গুণতে পারতো না, টাকা চিনতো না, ছেলেবেলা থেকে ১, ২, ৩, ৪ গুণতে পারতো। তবে অক্ষর চিনতো না। বাবা-মায়ের সঙ্গ ছাড়া কোথাও যেতে পারতো না, খুব ভয় পেতো—এখন তার এই সমস্ত সমস্যা  নেই।

বাংলাদেশে উদ্ভাবিত অপারেশন পদ্ধতি:
রোগীকে অজ্ঞান করে কানের এক পাশ থেকে অপর পাশ পর্যন্ত কেটে মাথার চামড়া পুরোটুকু কেটে মাথার খুলিকে উন্মুক্ত করা হয়। তারপর মাথার খুলির দুই পাশ কেটে নেওয়া হয়। এরপর মাথার খুলির প্লাস্টিক সার্জারি করে পুনরায় প্রতিস্থাপন করা হয়। তবে এর আগে মাথার খুলির যখন অপারেশন হয় তখন মস্তিষ্কের পর্দা বা আবরণ বা ডুরামিটার কেটে আর্টিফিশিয়াল পর্দা লাগিয়ে দেওয়া হয়। যাতে মস্তিষ্ক বাড়ার জন্য যথেষ্ট জায়গা পায়। পরবর্তীতে সবকিছু জায়গামতো প্রতিস্থাপন করে চামড়া সেলাই করে দেওয়া হয়।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৬ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০২০
পিএস/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।