ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

স্বেচ্ছায় হাসপাতালে, পরে ফিরলেন লাশ হয়ে

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৭
স্বেচ্ছায় হাসপাতালে, পরে ফিরলেন লাশ হয়ে মৃত্যুসনদের উপর মিতার আলোকচিত্র, ছবি: বাংলানিউজ

মৌলভীবাজার: পরিবারের সবাই বলেছিলেন প্রাইভেট ক্লিনিকের কথা। কিন্তু মিতার ইচ্ছাই ছিল তার কোলজুড়ে আলো করে আসতে-যাওয়া এই সন্তানটিকে ভূমিষ্ঠ করতে তিনি শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সেই ভর্তি হবেন। ভর্তিও হলেন। সন্তান ভূমিষ্ঠ হলো ঠিকই, তার আর কোলে নেওয়া হলো না। মিতুকে ফিরতে হলো লাশ হয়ে।

সদ্যভূমিষ্ঠ পুত্র সন্তানটিকে তিনি কয়েকবার দেখলেও কোলে নিতে পারেননি। শরীরে তীব্র জ্বালা-যন্ত্রণা শুরু হয়ে গেলে মিতা তার বড় ভাইয়ের স্ত্রী তৃষাকে শেষবারের মতো বলেন, ‘বৌদি, আমি হয়তো আর বাঁচবো না।

আমার ছেলেটাকে তোমরা দেখে রেখো...। ’

মিতা দেববর্মা ছিলেন হারপাছড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা। অনুসন্ধানে উঠে আসে তার প্রতি ডাক্তারদের অবহেলাসহ অ্যাম্বুলেন্স চালকের ‘ডাক্তার নেই’ অজুহাতে অদক্ষ-ক্লিনিকে নিয়ে যাবার অসৎ উদ্দেশ্যটিও।

এছাড়াও রয়েছে আরো একটি গুরুতর অভিযোগ। মিতার জীবনের অন্তিমপর্যায়ে ‘তার নিজস্ব ডাক্তার’ এর গফিলতিটিও। গাইনি বিশেষজ্ঞ এবং শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কমকর্তা ডা. রোকসানা পারভীনের নিয়মিত তত্ত্বাবধানে ছিলেন মিতা। কিন্তু তার প্রচণ্ড রক্তক্ষরণের সময় তাকে ফোন দেওয়া হলেও সেই গাইনি বিশেষজ্ঞ ডা. রোকসানা পারভীন আসেনি। গর্ভবতী অবস্থায় মিতা ডা. রোকসানাকেই নিয়মিত দেখিয়েছিলেন।
মিতা দেববর্মার ভূমিষ্ঠ পুত্রসন্তান, ছবি : বাংলানিউজ
মৃত্যুপথযাত্রী এই রোগীকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলার সময় ডা. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী পরিবারের সদস্যদের ‘মৌলভীবাজার ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট হাসপাতালে’ না নিয়ে যাবার কথা বলেন এবং বলতে থাকেন মৌলভীবাজারের ‘মৌলভী ক্লিনিক’-এ নিয়ে যাবেন। আর অ্যাম্বুলেন্স চালক সোহেল বলেন ‘মামুন প্রাইভেট মেডিকেল’র কথা।

এ বিষয়টি নিয়ে শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের দায়িত্বরত প্রধান কর্মকর্তা (ইউএইচও) ডা. জয়নাল আবেদীন টিটোর সঙ্গে যোগাযোগ করে হলে তিনি প্রথমেই বলেন ‘এই রোগী বাসা থেকে কি জানি ইঞ্জেকশন দিয়ে উল্টাপাল্টা কি করলো তারপর আমাদের সারকারি হাসপাতালে এসেছে। ’
 
‘ডেলিভারি জন্য এই রোগী তখন সুস্থ শরীরে হেঁটে হেঁটে হাসপাতলে ভর্তি হয়েছেন’ -এই তথ্যটি নিশ্চিতভাবে জানালে তিনি তার আগের ‘উল্টাপাল্টা’ শব্দের বক্তব্য থেকে সরে আসেন। পরে আবার বলেন, আমাদের কোনো প্রকারের অবহেলা ছিলো না।

গত ১৭ জুলাই (সোমবার) দুপুরে সরেজমিনে হারপাছড়া মিতার বাড়িতে গিয়ে দেখা যায় মিতার সন্তানটিকে তার মা, বৌদি এবং বোনেরা পরম মমতায় লালনপালন করছেন। চিকিৎসাব্যবস্থার প্রতি জমে থাকা নানান ক্ষোভ নানান বাক্যের মধ্যে দিয়ে বেরিয়ে আসছে।
১২ জুলাই মিতাকে মামুন প্রাইভেট হাসপাতালে নিয়ে যাওযার পূবমুহূর্ত, ছবি : বাংলানিউজ
বড়ভাইয়ের স্ত্রী তৃষ্ণা দেববর্মা বাংলানিউজকে বলেন, ১২ জুলাই (বুধবার) দুপুর সাড়ে ১২টায় শ্রীমঙ্গল স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তার ইচ্ছাতেই ভর্তি করানো হয়। সন্ধ্যা ৬টা ২৫ মিনিটে নর্মাল ডেলিভারিতে তার ছেলে সন্তান জন্ম নেয়। শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়া ঘণ্টাখানেক পর থেকে অতিরিক্ত রক্তক্ষরণ শুরু হয় মিতার।

তিনি বলেন, এই রক্তক্ষরণ কিছুতেই ডাক্তার বন্ধ করতে পারছিলেন না। পরে আমরা নার্সের মাধ্যমে ডা. রোকসানার সঙ্গে যোগযোগ করলে তিনি আসেননি। তিনিও তাড়াতাড়ি মৌলভীবাজার নিয়ে যেতে বলেন।

জানা যায়, মিডওয়াইফ মিঠু দাস, সিনিয়র স্টাফ নার্স রাশিদা আক্তার এবং ডা. সাজ্জাদ হোসেন চৌধুরী ১২ জুলাই দায়িত্বে ছিলেন।

মিতার ভাই অমিত দেববর্মা আরও বলেন, আমাদের অবস্থা তখন সূচনীয়। কি করবো, কোথায় যাবো- কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। অ্যাম্বুলেন্স চালক সোহেলের কথা মতো মামুন প্রাইভেট মেডিকেলে নিয়ে আসার পর দেখি এখানেও ডাক্তার নেই। প্রায় ঘণ্টা দেড়েক পর একজন খাটো মতো বোরখাপড়া মহিলা ডাক্তার আসলেন। আমাদের রোগী তখন ব্যথায় ছটফট করছিল। পরে তারা সিলেট নিয়ে যেতে বললো এবং সাদা কাগজে ভূয়া ওষুধ লিখে ১২ হাজার টাকা দাবি করলো। এ নিয়ে তুমুল বাকবিতন্ডা। পরে আট হাজার টাকা দিয়ে মিতাকে নিয়ে সিলেট মেডিকেল কলেজে আসলাম। ডাক্তাররা বললো, আর একঘণ্টা আগে আসলে হয়তো রোগীটা বেঁচে যেতো। রোগীকে চার ব্যাগ রক্তও দেওয়া হয়েছিল।

এ বিষয়ে যোগাযোগ করে হলে সিলেট বিভাগের পরিচালক (স্বাস্থ্য) ডা. ইসমাইল ফারুক বাংলানিউজকে বলেন, বিষয়টি আমার জানা ছিল না। এ ব্যাপারে তদন্ত করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১১৩৫ ঘণ্টা, জুলাই ১৯, ২০১৭
বিবিবি/জিপি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।