ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ওয়ান স্টপ মেডিকেল সার্ভিস গড়তে চাই: এনামুর রহমান

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৩৩ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৭
ওয়ান স্টপ মেডিকেল সার্ভিস গড়তে চাই: এনামুর রহমান ডা. এনামুর রহমান এমপি। ছবি: জিএম মুজিবুর

সাভার (ঢাকা): একে তো চিকিৎসক, তারওপর জনপ্রতিনিধি। জনগণের সঙ্গে সম্পর্কটা তাই খুব বেশী গভীর তার। নিজের গড়া ‍অত্যাধুনিক হাসপাতালের করিডোরে হাঁটার সময়ে রোগিদের কাগজ বাড়িয়ে বিল কমানোর আবদারও হরহামেশা শুনতে হয় তাকে।

এ জাতীয় ক্ষেত্রে কি করেন তিনি? কাউকে কখনো ফিরিয়ে দিয়েছেন বলে তো দুর্মুখেরাও বলে না। তাহলে কিভাবে তাদের সামলান এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রতিষ্ঠাতা?

এ প্রশ্নে নিজেই হাঁড়ি ভাঙ্গেন ঢাকা-১৯ (সাভার) আসনে সরকার দলীয় সংসদ সদস্য এনামুর রহমান।

করিডোরে রোগির কথা শুনছেন ডা. এনামুর রহমান।  ছবি: জিএম মুজিবুর স্মিত হেসে বলেন, সবাই যে বিল কমানোর জন্য আসে তা নয়। সাজেশনের জন্যও ‍অনেকে আসে। তখন তাদের চেহারা দেখি, কাপড়চোপড় দেখি, পায়ের দিকে দেখি। জুতা দেখলে একজন মানুষের আর্থিক অবস্থা অনেকটা টের পওয়া যায়।

‘এটা তো গরীবের হাসপাতাল’ –বলেই ফের সেই স্মিত হাসি। এবার গরীবের হাসপাতাল হিসেবে স্বীকৃতি পাওয়ার একটা পরিতৃপ্তি খেলা করে তার মুখাবয়ব জুড়ে।

কিছু সময় বাদেই হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে এক নারী ও তার চটপটিওয়ালা বাবা পথ রোধ করে তার।   গভীর মনোযোগে তাদের কথা শোনেন গরীবের এমপি এনামুর রহমান। কাগজ দেখেন। টুকটাক জিজ্ঞাসায় জেনে নেন প্রয়োজনীয় তথ্য। তারপর ফোন করে নির্দেশনা পৌছে দেন সংশ্লিষ্টজনের কাছে। শ্রদ্ধার সঙ্গেই বাবা-মেয়েকে বিদায় জানান এমপি।

আরও পড়ুন
ক্যানসার মানেই মরে যাওয়া নয়: ডা. সোমনাথ দে

বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে এনাম ক্যানসার সেন্টার
সেবায় অনন্য সাভারের এনাম মেডিকেল

তার আগে বাংলানিউজের মুখোমুখি হয়ে নিজের জীবনের ভিশন, মিশন আর ভালো-মন্দের অজানা অনেক অধ্যায় তিনি বইয়ের খোলা পাতার মতো মেলে ধরেন সাবলীল বাচন ভঙ্গীতে।

জানা যায়, জুতা সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ-সব কাজেই সিদ্ধহস্ত জনদরদী এনামুর রহমান। হালের ডিজিটাল ট্রেন্ড থেকে শুরু করে অর্থনীতি, পরিবেশ, গণস্বাস্থ্য, শিল্প, জনশক্তি, প্রযুক্তি সব কিছু্তেই সর্বশেষ জ্ঞান পুরে রেখেছেন অভিজ্ঞতার ঝুলিতে। বাংলাদেশকে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটেই এগিয়ে নেওয়ার সময়োপযোগী সব চিন্তা তার। সিদ্ধহস্ত শাসন আর সোহাগ দু’টোতেই। সাভারের মতো জায়গা থেকে চাঁদাবাজি আর জমি দখলের মতো দুর্দমনীয় অপকর্ম থামিয়ে দেওয়ার অবিস্মরণীয় নজির গড়া হয়ে গেছে তার।

ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এনামুর রহমানের ভাষায়, গরুর কাছে লাঠি না ‍থাকলে হাল চষা স্লো হয়ে যায়। ছোটবেলায় দাদার সঙ্গে ক্ষেতে যেতাম। লাঙ্গল ধরতাম। পাট মেলতাম। আলুর বস্তা বাইতাম। তাই শ্রমজীবীদের কষ্ট যেমন বুঝি, তেমনি চিনি মন্দ লোকদেরও।

তৃণমূল থেকে উঠে এসেছেন বলেই হয়তো তৃণমূলই থাকে তার চিন্তার অধিকাংশ স্থান জুড়ে। এরই মধ্যে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের প্রায় সব কমিটিই পুনর্গঠন করে ফেলেছেন নিজের উপজেলায়। এমপিও ভুক্ত করিয়েছেন এলাকার প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে, গড়ে দিয়েছেন নতুন ভবন। প্রতিষ্ঠার প্রায় অর্ধশত বছর পর সরকারিকরণ করিয়েছেন সাভার কলেজ।

তার তত্ত্বাবধানেই অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ আর পরিচ্ছন্নতায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখেছে সাভারবাসী। রাস্তা থেকেই এখন জাতীয় স্মৃতিসৌধ চোখে পড়ে। বিকেএসপি’র দেওয়ালে কাছে চোখে পড়ে ফুলের বাগান।  ডা. এনামুর রহমান এমপি।  ছবি: জিএম মুজিবুর

সারাক্ষণ দারিদ্র দূরীকরণ, শিল্পায়ন, দক্ষ জনশক্তি শব্দগুলো ঘুরতে থাকে তার চেতনা জুড়ে।

এনামুর রহমান বলেন,  আমাদের সমাজে শ্রেণিবৈষম্য বেশী। মানবসম্পদ দক্ষ নয়। কারো দশটা বাড়ি। কারো ভাড়া থাকারও পয়সা নেই। তাই জনশক্তিকে স্কিলড করতে হবে। শিল্পায়নের মাধ্যমে কর্মসংস্থান তৈরি করতে হবে।

তিনি বলেন, টেকনিক্যাল এডুকেশনে ঝুঁকে আজ জার্মানি আর চীন কতো এগিয়ে গেছে। চীনারা দক্ষ আর রিসোর্সফুল বলেই কিন্তু সব কান্ট্রিতে জব মার্কেট দখল করে আছে। আর অদক্ষ হওয়ার কারণেই আমাদের জনশক্তি মধ্যপ্রাচ্যে গিয়ে শ্রমের মূল্য কম পাচ্ছে। এখন যারা ২শ’/৩শ’ রিয়াল আয় করছে, তারাই দক্ষ হলে দু’হাজার/তিন হাজার রিয়াল আয় করবে।

এ সময় সাভারে টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটি গড়ে তোলার পরিকল্পনা আছে বলেও জানান তিনি।

এমপি এনামুর রহমান বলেন, দারিদ্র দূরীকরণ আমার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। অবকাঠামো উন্নয়নও গুরুত্বপূর্ণ। আমি চাই, সব কাজই গুরুত্ব দিয়ে করা হোক। আজ যে রাস্তা তৈরি হচ্ছে, তিন মাস পরই তা নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। কিন্তু আমি চাই টেকসই রাস্তা। যার দু’পাশে ড্রেন থাকবে।

সাভারের চারিদিকে নদী। ইন্টার কানেকটেড অনেক খাল আছে। এগুলোকে কিভাবে ব্যবহার করে জনগণের জন্য কাজে লাগানো যায় সে চিন্তা সবসময়ই করেন এনামুর রহমান। সঙ্গে পরিবেশ সংরক্ষণের যুগোপযোগী চিন্তা আচ্ছন্ন করে রাখে তাকে। হাসপাতালের করিডোরে রোগিদের ভিড়ে ডা. এনামুর রহমান।  ছবি: জিএম মুজিবুর

তারই উদ্যোগে বংশী নদীর তীরে স্টেডিয়াম আর শিশু পার্ক হচ্ছে। নদীর পাড় দিয়ে হচ্ছে ওয়াকওয়ে।

গাবতলী থেকে নবীনগর পর্যন্ত হবে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে। তার নিচ দিয়ে স্থানীয়দের জন্য হবে ফ্লাইওভার। গাবতলী থেকে বংশী নদীর নিচ দিয়ে টানেল গড়ে দূরপাল্লার গাড়িগুলোকে সোজা এক্সপ্রেসওয়েতে তুলে দেওয়ারও সুদূরপ্রসারী চিন্তা রয়েছে তার।

এনামুর রহমান বলেন, এক্সপ্রেওয়ের নিচের রাস্তা হবে ৪ লেন। বাইপাইলের দিকেও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে হবে।

এতো গেলো স্থানীয় উন্নয়নের কথা। পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটির সদস্য হিসেবেও উল্লেখযোগ্য সাফল্য আছে তার। বিভিন্ন দেশে পাট ও পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ার নতুন কিছু তথ্য দিয়ে তিনি বলেন, জাপানে পাট পণ্য, বিশেষ করে ওয়াইন ব্যাগের রপ্তানি বেড়েছে। ভিয়েতনামে ডাবল হয়ে গেছে রপ্তানি। লাওসে যাচ্ছে কফি ব্যাগ। অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড আর ইন্দোনেশিয়ায়েও বেড়েছে বাংলাদেশের পাটপণ্যের চাহিদা।

যদিও এতো কিছুও পরও নিজের গড়া প্রতিষ্ঠানেই ফিরে ফিরে আসেন এনামুর রহমান। ডা. এনামুর রহমান এমপি।  ছবি: জিএম মুজিবুর

তিনি বলেন, মেডিকেল কলেজ আমার বেজ। এটা নিয়ে কখনো অবহেলা করি না। এই হাসপাতালকে আমি আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে গড়ে তুলেছি। এখানে রানা প্লাজার ৩ হাজার রোগির চিকিৎসা করিয়েছি। অপারেশন করিয়েছি। এখন আমরা রানা প্লাজার দ্বিগুণ রোগিকে সেবা দিতে সক্ষম।

নিজের সুদূরপ্রসারি স্বপ্নের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, আমি চাই এই হাসপাতালকে ওয়ান স্টপ মেডিকেল সার্ভিসের জন্য গড়ে তুলতে। কোনো রোগি এলে তার সব চিকিৎসাই যাতে একই ছাদের নিচে করানো ‍যায় তার প্রস্তুতি চলছে। আশা করছি, ২০১৮ সালের মধ্যে আমরা এটাকে ওয়ান স্টপ সার্ভিস সেন্টার করে গড়ে তুলতে পারবো।

এনামুর রহমান বলেন, আমাদের এখানে বিদেশি ছাত্ররা পড়তে আসছে। এতো দিন ভারত আর নেপাল থেকেই বেশী আসতো। এবার মধ্যপ্রাচ্য থেকে, বিশেষ করে সৌদি আরব আর ইরান থেকে অনেক শিক্ষার্থী এখানে পড়তে আসার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।

নিজের হাসপাতালের বিশেষত্ব তুলে ধরে তিনি বলেন, আমাদের প্রতিটি বিভাগকে আমরা অত্যাধুনিক করে গড়ে তুলছি। এরই মধ্যে ক্যানসার, কিডনি  ইত্যাদি বিভাগে বিদেশি ডাক্তাররা কাজ শুরু করেছেন। শিগগিরই ইনফারটিলিটি বিভাগেও বিদেশি বিশেষজ্ঞরা কাজ শুরু করবেন। আমাদের কার্ডিয়াক সার্জারি আর অর্থোপেডিক বিভাগও এখন বেশ ভালো।

এমপি এনামুর বলেন, দেশের অনেক বড় হাসপাতালেও আমাদের এখানকার মতো লেকচার থিয়েটার, অত্যাধুনিক রুম নেই। অন্য মেডিকেলে যেখানে ৪ থেকে ৭ জন ফ্যাকাল্টি মেম্বার থাকেন, সেখানে আমাদের এখানে আছেন ৭ থেকে ১৫ জন করে। ডা. এনামুর রহমান এমপি।  ছবি: জিএম মুজিবুর

তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষার্থীরা এখন বিসিএসে ভালো রেজাল্ট করছে। ভালো জব নিয়ে বিদেশে যাচ্ছে। পোস্ট গ্রাজুয়েটে ভালো করছে। আমাদের এখানে এখন অনেক গবেষণা হচ্ছে। আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত মেডিকেল জার্নাল বের হচ্ছে।

১০১৪ সাল পর্যন্ত টিকে থাকার লড়াই করলেও গত ৩ বছরে এনাম মেডিকেলে ৠাপিড গ্রোথ হয়েছে বলে জানান এনামুর রহমান। নেতৃত্ব গুণেই বর্তমানে বাংলাদেশ প্রাইভেট মেডিকেল কলেজ অ্যাসোসিয়েশনের সেক্রেটারি এবং প্রাইভেট হসপিটাল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।

এছাড়া এফবিসিসিআই আর বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ছাড়াও বিভিন্ন সামাজিক সংগঠনেও গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করছেন এমপি এনামুর রহমান।

তবে এতো কিছুর পরও দু’একটি বিষয়ে অতৃপ্তি বড় পোড়ায় তাকে।

এনামুর রহমান নিজেই বলেন, বর্জ ব্যবস্থাপনা আর ড্রেনেজ সিসটেমে এখনো পুরোপুরি সফলতা পাইনি। যেখানে সেখানে ময়লা ফেলে রাখা হয়। বিরুলিয়ার ৩২ বিঘা জমিতে পৌরসভার ভাগাড় বানিয়েছি বটে, কিন্তু সেটাও যথেষ্ট নয়। পুরো উপজেলার ওয়েস্ট ডাম্পিং নিয়েও ভাবতে হবে। জলাবদ্ধতা নিরসনে আরো কাজ করতে হবে। নদী দখল আর পরিবেশ রক্ষা নিয়েও অনেক কাজ করার সুযোগ আছে। কিন্তু টাস্ক ফোর্স গঠন করলেও মাঠে নামে না।

কথা বলতে বলতে হসপিটালের করিডোরে হাঁটতে থাকেন এমপি এনামুর রহমান। কর্মীদের সঙ্গে কতোটা সাবলীল তিনি বুঝতে বাকি থাকে না। ডাক্তারদের চেম্বারের সামনে বিশ্রামের জন্য পাতা সোফাগুলো পর্যন্ত কি না জেনে নিয়ে নির্দেশ দেন আরো সোফা পাতার। বিদেশি ছাত্রদের জন্য হোস্টেল গড়ার জায়গা দেখিয়ে বলে যান পরিকল্পনার আদ্যোপান্ত। ভেড়ার বড় হওয়া লোম, ফল না দেওয়া খেজুর গাছ আর কাঠালের ফলন কিছুই এড়ায় না তার দৃষ্টিতে। শুধু হাসপাতাল কেনো, তার গতিশীল নেতৃত্বে রাজনীতির ট্রেন্ডটাও তো পালটে গেলো সাভারে।

বাংলাদেশ সময়: ১৯০০ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।