ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৫ ডিসেম্বর ২০২৪, ০২ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে এনাম ক্যানসার সেন্টার

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৩৮ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৭
বাঁচার স্বপ্ন দেখাচ্ছে এনাম ক্যানসার সেন্টার এনাম ক্যানসার সেন্টারে থেরাপি’র প্রস্তুতি। ছবি: জিএম মুজিবুর

সাভার (ঢাকা):  ভেলোরের হাসপাতাল দায় নিতে চায়নি তার। মৃত্যুকে অমোঘ নিয়তি মেনে নিয়ে তাই ভারত থেকে দেশে ফিরে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু এখানে এসেই ক্ষয়ে যেতে থাকা জীবনে ফের বাঁচার স্বপ্ন জাগে তার। সেই স্বপ্ন ডালপালা মেলে মাস দুয়েকের টানা চিকিৎসায়। শেষ তক হাশিমুদ্দিনের বাঁচার স্বপ্নটাকে তার হাতের মুঠোতেই পুরে দিয়েছে এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের বিশেষায়িত ক্যানসার সেন্টার।  

কানের নিচে গলার পাশের টিউমারটা তো গেছেই, সঙ্গে বিতাড়িত হয়েছে ক্যানসারও। দিনাজপুরের চিরিরবন্দর থানার রাণীরবন্দর এলাকার হিশামুদ্দিন এখন দিন গুনছেন বাড়ি ফেরার।

গলার পাশটা এখনো কালো হয়ে আছে বটে, কিন্তু বিশ্রাম কক্ষে বসে আপনজনদের সঙ্গে খোশগল্পে মত্ত তিনি।

তার মতোই দেশ-বিদেশের অন্য হাসপাতালে প্রত্যাখ্যাত হয়ে এখানে এসে মৃত্যুর দু:স্বপ্ন বাঁচার স্বপ্ন হয়ে ডানা মেলছে অনেকের জীবনে। ক্যানসার থেকে সেরে ওঠা হিশামুদ্দিন।  ছবি: জিএম মুজিবুর

শুরুর পর গত ৬ মাসে ১ হাজারেরও বেশী ক্যান্সার রোগীকে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে এখানে। এরমধ্যে অন্তত ৫০০ রোগীকে দেওয়া হয়েছে কেমোথেরাপি। এছাড়া দেড়শ’ জনকে রেডিওথেরাপি এবং আরো দেড়শ’ জনকে বেকিথেরাপি দেওয়া হয়েছে। এসব রোগির অন্তত ৮০ শতাংশ সুস্থ হয়ে ফিরে গেছে বাড়ি। এখানে চিকিৎসা নিয়ে সুস্থ হয়ে কৃষক ফিরে যাচ্ছেন তার কৃষিকাজে, নিত্যকার জীবন যুদ্ধে ফিরছেন দিনমজুর।

ভারতীয় ক্যানসার বিশেষজ্ঞ সোমনাথ দে এর তত্ত্বাবধানে ক্যানসার চিকিৎসার দৃশ্যপট আমূল পালটে গেছে এখানে।

এখানকার ‘প্রপার ট্রিটমেন্ট, লেস ফেয়ার, হলিস্টিক অ্যাপ্রোচ’ নীতি রোগীদের মনেও সীমাহীন আশার সঞ্চার করেছে।  

এখানে রোগির অবস্থা দেখে ট্রিটমেন্ট করা হয়। যার যে স্টেজে যে ট্রিটমেন্ট লাগে সেটাই দেওয়া হয়। টাকার জন্য কোনো রোগিকে ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। ৭ লাখের চিকিৎসা ৭০ হাজারেই হয়ে যায় এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের ক্যানসার ইউনিটে।

অপ্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা (ইনভেস্টিগেশন) করে খরচ বাড়ানোর কোনো নজির নেই এনাম মেডিকেলে। ক্যানসার সেন্টারও সেই নিয়মেই চলে। এখানে যার যেটুকু দরকার, তার সেটুকুই করা হয়। যার রেডিওথেরাপি দরকার, তাকে রেডিওথেরাপিই দেওয়া হয়। যার কেমোথেরাপি দরকার, তাকে দেওয়া হয় কেমোই। জরুরি হলেই কেবল অপারেশন করা হয়। ফলে বাড়তি খরচ নেই। মূল চিকিৎসা খরচও অন্যান্য হাসপাতালের তুলনায় কম। ক্যানসার বিশেষজ্ঞ ডা. সোমনাথ দে।  ছবি: জিএম মুজিবুর

ক্যানসার চিকিৎসায় এরইমধ্যে রোগীদের আশা, ভরসা আর আশ্রয়ের আধার হয়ে ওঠা সোমনাথ দে-এর ভাষায়, ক্যানসার মানে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ। শত্রু শিবিরে যেমন টার্গেট ঠিক করে একটা মিসাইলেই জয় আদায় করে নেওয়া যায়, তেমনি টার্গেট ঠিক করে এখানে ক্যানসারের সেই ট্রিটমেন্টই দেওয়া হয় যেটা নিরাময়ে সহায়ক হবে।

এখানে চিকিৎসার খরচ প্রসঙ্গে সোমনাথ দে বলেন, আমাদের এখানে অনেক নিম্ন আয়ের মানুষ আসেন। কারো এক খণ্ড জমি বেচলে হয়তো পরের থেরাপিটা হবে। আমরা বলি, জমি বেচো না, যা আছে নিয়ে আসো। দেখছি কি করা যায়।

তিনি বলেন, এখানে চিকিৎসা খরচ ভালো মানের যে কোনো হাসপাতালের এক তৃতীয়াংশ। কিন্তু অবকাঠামো ও প্রযুক্তি বিশ্বমানের। সাকসেস রেটও বেশী।

এরই মধ্যে রেডিওথেরাপি নিয়ে প্রায় ১শ’ রোগি সুস্থ হয়ে ফিরে গেছেন ‍জানিয়ে তিনি বলেন, আমি নিজে রিমোট এলাকা থেকে উঠে এসেছি। দরিদ্র মানুষের পেইনটা ফিল করতে পারি। এনাম ক্যানসার সেন্টার।  ছবি: জিএম মুজিবুর

ক্যানসার ইউনিটের পরিবেশও ঝকঝকে তকতকে। মসৃণ টাইলস দ্যুতি ছড়াচ্ছে মেঝেতে। তাতে ব্যাকটেরিয়া প্রতিরোধী অ্যাপোক্সি পেইন্ট।

১২ ফুট পুরু ছাদেও চকচকে দ্যুতি। চারপাশে দুর্ভেদ্য কংক্রিটের বেড়। থেরাপিজাত রেডিয়েশন মাটির নিচে আটকে রাখতেই এমন পুরু ছাদ আর মোটা দেওয়াল আন্ডারগ্রাউন্ড ফ্লোরে। ভেন্টিলেশনের ব্যবস্থাটা তবু ফ্রেশ এয়ারেই।

বসেছে জার্মানি, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র ইত্যাদি দেশ থেকে আনা অত্যাধুনিক সব স্ক্যানিং ‍আর থেরাপি মেশিন। বিভিন্ন নামকরা হাসপাতাল আর ইনস্টিটিউটের অভিজ্ঞজনদের নিয়ে গড়া এই ইউনিটকে এখন দেশের সেরা ক্যানসার সেন্টার বলছেন যে কেউ। সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে পর্যবেক্ষক দল এসে অভিভূত হচ্ছেন বিস্ময়ে।

এখানকার সার্জারি, কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি, হরমোনথেরাপি, ইমিওনোথেরাপি আর টারগেটেড থেরাপির সর্বাধুনিক বিশাল আয়োজনে মুগ্ধ হচ্ছেন সবাই। প্রশংসা করছেন এখানকার লিনিয়ার এ্যাক্সেলারেটর, ইলেকট্রনিক পোর্টাল ভিশন ইমেজিং ডিভাইস, সিটি সিম্যুলেটরের।

বিশ্বখ্যাত ক্যানসার সেন্টার সুইজারল্যান্ডের বেলাঞ্জনা পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা ভালোই কাজে লাগিয়েছেন এনাম মেডিকেলের স্বপ্নদ্রষ্টা স্থানীয় এমপি এনামুর রহমান। প্রায় ১২০ কোটি টাকা খরচে এই ক্যানসার সেন্টার গড়ে তুলেছেন তিনি। এনাম ক্যানসার সেন্টারে অত্যাধুনিক প্রযুক্তি।  ছবি: জিএম মুজিবুর  

ডাক্তার, নার্স, টেকনিশিয়ান মিলিয়ে এখানকার লোকবল ৫০ এরও ওপরে। দেশের ভেতর বিশ্বমানের ক্যানসার চিকিৎসা চলছে এখানে। এনাম ক্যান্সার সেন্টার তাই ক্যানসার চিকিৎসায় সূচনা করেছে নতুন যুগের।  

ঢাকার উপকণ্ঠে শিক্ষা, বাণিজ্য ও শিল্প নগরী সাভারে ২০০৩ সালে গড়ে ওঠা এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল অনেক আগেই হয়ে উঠেছে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আশা-ভরসা-আশ্রয়ের গন্তব্য।

কার্যত ২০১৩ সালে রানা প্লাজা ধসে হতাহতদের নিরন্তর সেবা দিয়ে সারাবিশ্বের নজরে আসে এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল। সেই জাতীয় দুর্যোগে রাত-দিনের হিসাব ভুলে টানা সেবা দিয়ে যান এখানকার চিকিৎসক-ছাত্র-শিক্ষকরা। ওই ঘটনার পর ছাত্র ও অভিভাবকদের আগ্রহ বেড়ে যায় এনাম মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের প্রতি। সঙ্গে এর প্রতিষ্ঠাতা ডা. এনামুর রহমানের সহজাত সেবার মানসিকতা আর আন্তরিকতা হাসপাতালটির ধারাবাহিক উন্নতির পথ রচনা করে দেয়। অত্যাধুনিক ক্যানসার সেন্টার গড়ে রোগিদের আস্থার প্রতিদান আরো ভালোভাবেই দিয়ে যাচ্ছে এনাম মেডিকেল।

বাংলাদেশ সময়: ১১৪০ ঘণ্টা, জুলাই ১৬, ২০১৭
জেডএম/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।