ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ঝুঁকিতে স্বাস্থ্য

ফসলে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ গুণ আর্সেনিক!

আবু খালিদ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০০৩৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩, ২০১৫
ফসলে স্বাভাবিকের চেয়ে ৪০ গুণ আর্সেনিক!

ঢাকা: শুধু পানিতে নয়, বিভিন্ন ফসলে স্বাভাবিক মাত্রার চেয়ে ৪০ গুণেরও বেশি আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে। এর ফলে এসব জমিতে চাষ হওয়া খাদ্যপণ্যের মাধ্যমে মানুষের শরীরে প্রবেশ করছে আর্সেনিক।


 
এতে লিভার, কিডনি ও ফুসফুসে ক্যান্সারের মতো মারাত্মক রোগসহ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে মানুষের স্বাস্থ্য।
 
তিন বছর মেয়াদী ‘ইভ্যুলউয়েশন অব পেট্রিস ভিটাটা অ্যাজ এ ট্র্যাপ প্ল্যান্ট টু মিটিগেট আর্সেনিক ফরম সয়েল’ (Evaluation of Pteris vittata  as A trap plant to mitigate arsenic from soil) শীর্ষক গবেষণায় উঠে এসেছে এসব তথ্য।

গত বছর শেষ হয় গবেষণাটি।
 
শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শেকৃবি) উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের উদ্যোগে এ গবেষণা পরিচালনা করেন ওই বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও অধ্যাপক ড. এ এফ এম জামাল উদ্দিন।
 
অধ্যাপক ড. এ এফ এম জামালউদ্দিন বাংলানিউজকে বলেন, প্রাকৃতিকভাবে পানির প্রাপ্যতা কমে যাওয়ায় সেচ নির্ভর চাষাবাদ শুরু হয়েছে। এর ফলে মাটির অনেক নিচ থেকে তুলে আনা পানির সঙ্গে আসছে আর্সেনিক। আর এ পানি দিয়ে চাষাবাদের ফলে ফসলেও মাত্রাতিরিক্ত আর্সেনিকের উপস্থিতি পাওয়া যাচ্ছে।
 
তবে আগাছার মতো পে-ট্রিস ভিটাটা জাতীয় গাছ চাষ করে আর্সেনিক থেকে অনেকটাই রেহাই পাওয়া যাবে বলে মনে করছেন তিনি। এছাড়া ফসলি জমিতে বিদ্যমান আর্সেনিকের মাত্রা কমিয়ে আনার জন্য দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনাও হাতে নিতে হবে বলেও মত প্রকাশ করেন এই গবেষক।

গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, অন্যান্য খনিজ পদার্থের মতো আর্সেনিকও মানুষের স্বাস্থ্যের জন্য সামান্য পরিমাণ প্রয়োজন। আর এই সামান্য পরিমাণ আর্সেনিক প্রতিদিন শাক-সবজিসহ বিভিন্ন উদ্ভিজ্জ জাতীয় খাবারের মাধ্যমে সবাই গ্রহণ করে থাকে। কিন্তু এর পরিমাণ একটু বেশি হলেই স্বাস্থ্যের জন্য ভয়ঙ্কর বিপদ।
 
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, প্রতি লিটার পানিতে এক পিপিএম (০.০১ মিলিগ্রাম) পর্যন্ত আর্সেনিক সহনীয়। আর এর মাত্রা যদি ৫০ পিপিএম (০.০৫ মিলিগ্রাম) হয় তা হলে সেই পানি পান করা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ, স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকিস্বরুপ।
 
কিন্তু দেশে এখন বিভিন্ন খাদ্যশস্যে ৪০ পিপিএমের বেশি আর্সেনিক পাওয়া যাচ্ছে। গভীর নলকূপের মাধ্যমে সেচ দেওয়ার ফলে ফসলি জমিতে আর্সেনিকের পরিমাণ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
 
এছাড়া ফসল উৎপাদনে জমিতে কীটনাশক ও আগাছানাশক এবং আর্সেনিকযুক্ত মুরগির খাবারের ব্যবহার বেড়ে যাওয়ার কারণেও আরেক মাত্রায় আর্সেনিকের ক্ষতির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
 
গবেষকরা বলছেন, আর্সেনিক বিষে আক্রান্ত মানুষগুলো অকাল মৃত্যুঝুঁকিতে রয়েছেন। মজার বিষয় হলো, গত ১০ থেকে ১৫ বছর ধরে সরকারি বা বেসরকারিভাবে আর্সেনিক বিষয়ে যতো উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে তা শুধু টিওবয়েলে আর্সেনিকের উপস্থিতি নিরুপণ বা তার উপস্থিতির মাত্রা নির্ণয়ে।
 
বিশেষজ্ঞদের দাবি, নদী-নালা, খাল-বিলে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করে শীত মৌসুমে ফসলি জমিতে সেচে ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরতা কমাতে হবে। পর্যাপ্ত গবেষণা প্রয়োজন এবং মাটি থেকে আর্সেনিক সরিয়ে ফেলার সাশ্রয়ী ও সহজতর প্রযুক্তি উদ্ভাবন জরুরি।
 
গবেষণায় উল্লেখ করা হয়, সাধারণত মানুষ ও গৃহপালিত প্রাণীর খাবার হিসেবে ব্যবহার করা হয় না, এমন সব স্বল্প সময়ের উদ্ভিদ পতিত জমিতে চাষ করে জমির উপরিভাগের আর্সেনিকের মাত্রা কমিয়ে আনার বিষয়ে অনেক বেশি উদ্যোগ নিতে হবে। এ ধরনের আর্সেনিক হাইপার অ্যাকুমুলেটর উদ্ভিদ নির্বাচনের জন্য শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা চলছে।
 
শহরেও আর্সেনিকের উপস্থিতি বাড়ছে
গ্রামাঞ্চলে আর্সেনিকযুক্ত পানি দিয়ে জমিতে চাষ হচ্ছে বিভিন্ন ফসল। আর সেসব ফসল রাজধানীতে বিক্রি হওয়ায় শহরের খাদ্যশস্যেও আর্সেনিকের উপস্থিতি থাকছে। রাজধানীর বিভিন্ন সুপারশপ ও খোলা বাজারের অন্তত ২০টি সবজি পণ্য নিয়ে গবেষণায় আর্সেনিকের উপস্থিতি অনেক বেশি পাওয়া গেছে।
 
বিশেষ করে বাংলাদেশের যেসব অঞ্চলে উচ্চ ফলনশীল ধানের চাষ হয়, সেসব জায়গাতে আর্সেনিক দূষণের মাত্রা বেশি। এছাড়া উচ্চ ফলনশীল ধান চাষে প্রচুর পানি সেচ দিতে হয়। আর এ পানির অধিকাংশই আসে অগভীর নলকূপ থেকে।
 
গবেষণা কার্যক্রম
রংপুর ও কুড়িগ্রাম থেকে মাটি সংগ্রহ করা হয়। এরপর ওই মাটিতে চাষ করা হয় বিভিন্ন ফসল। এছাড়া রাজধানীর বিভিন্ন শাক-সবজির দোকান থেকে আনা হয় সবজিপণ্য। এভাবে তিনবছর ধরে পরিচালনা করা হয় গবেষণাটি।
 
গবেষণায় সহযোগিতা করেন শেকৃবি’র উদ্যানতত্ত্ব বিভাগের তৎকালীন শিক্ষার্থী এম আই মনিরুল ইসলাম, ইউ মায়েদা, এম এ জেড কে রনি এবং মেহেরাজ।
 
আর্সেনিকের ভয়াবহতা
আর্সেনিক সাধারণত কিডনি বা লিভারের কোষের ভেতরে প্রবেশ করে সেলের ফসফরাসকে প্রতিস্থাপন করে কোষে শক্তি উৎপাদন বন্ধ করে দেয় এবং কোষগুলো মারা যায়। এর ফলে লিভার, কিডনি, ফুসফুস ক্যান্সারাক্রান্ত হয়। তাছাড়া আর্সেনিক রক্ত সংবহনে বাঁধা দেওয়ায় অ্যামিনিয়া, লিউকোপেনিয়া দেখা দেয় এবং অস্তিমজ্জায় পচন ধরে।
 
গবেষকরা জানান, ইতোমধ্যে আর্সেনিক উপদ্রুত এলাকার ৬০ শতাংশ মানুষ কঠিন রোগে ভুগছেন। এমনকি রোগের প্রকোপ ঠেকাতে অনেকের হাত-পায়ের আঙ্গুলও কেটে ফেলতে হচ্ছে। আর এভাবে প্রতিনিয়ত আর্সেনিকযুক্ত পানি ও খাবার গ্রহণ করে বাংলাদেশের প্রায় ৮ কোটি মানুষ ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হচ্ছে।
 
বাংলাদেশ সময়: ০০৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০৩, ২০১৫
একে/এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।