ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

স্বাস্থ্য

ফিরে দেখা-২০১৪

স্বাস্থ্য নিয়ে মন্ত্রী নাসিমের যুদ্ধ!

মাজেদুল নয়ন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭১৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪
স্বাস্থ্য নিয়ে মন্ত্রী নাসিমের যুদ্ধ! স্বাস্থ্যমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিম / ফাইল ফটো

ঢাকা: ২০১৪ সালের শুরুতেই চিকিৎসকদের থেকে রাজনীতিবিদের হাতে আসে স্বাস্থ্যখাত। অভিজ্ঞ রাজনীতিবিদ মোহাম্মদ নাসিম দায়িত্ব নেন স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে।

স্বাস্থ্য প্রতিমন্ত্রী হিসেবেও দfয়িত্ব নেন পেশাদার রাজনীতিবিদ জাহিদ মালেক। শেখ হাসিনা সরকারের গত আমলে যেখানে দুই মন্ত্রী ছাড়াও উপদেষ্টাও ছিলেন চিকিৎসক। স্বাস্থ্যখাতে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছেন নাসিম। চিকিৎসকদের হাত থেকে স্বাস্থ্যখাতকে মুক্ত করে, রোগীদের হাতেও নেয়ার চেষ্টা চলছে। এর মধ্যেও স্বাস্থ্যখাতের দূর্নীতি খুব বেশি কমেছে সেটি দাবি করা যাবে না।
 
রাজনীতিবিদ মন্ত্রী
শেখ হাসিনা সরকারের ২০১৪ এর মন্ত্রিসভায় অন্যতম চমক ছিল, স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে মোহাম্মদ নাসিমের আগমন। এর আগের আমলে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী এবং স্বাস্থ্য উপদেষ্টাও ছিলেন চিকিৎসক। সেখানে স্বাস্থ্যখাতের ক্ষমতা বদলে আসে রাজনীতিবিদদের হাতেই।
 
সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে নাসিমের মন বসছিলো না স্বাস্থ্যে। দায়িত্ব নেয়ার পর বিভিন্ন সভা সেমিনারে রাখঢাক না রেখেই এ অভিব্যক্তি প্রচার করেছেন তিনি। তবে মাস না ঘুরতেই নিজেকে সামলে নেন নাসিম। বছরের মাঝামাঝি সময়ে বিভিন্ন বক্তব্যে নিজেকে ‘গরিবের স্বাস্থ্যমন্ত্রী’ এবং ‘মুন্না ভাই এমবিবিএস’ বলেও ঘোষণা দেন তিনি।

১৩ মেডিকেল কলেজে নিষিদ্ধ
দায়িত্ব নেয়ার পরপরই ১৩টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজের অনুমোদন বাতিল করেন নাসিম। এসব মেডিকেল কলেজের অনুমোদন দিয়েছিলেন সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. আ. ফ ম রুহুল হক তার মন্ত্রিত্বের শেষ দিনে। এর মধ্যে রাষ্ট্রপতি আব্দুল হামিদের নামেও একটি মেডিকেল কলেজ ছিল।
 
এরপরেও মন্ত্রণালয়ের নিষেধাজ্ঞা না শুনে বিজ্ঞাপন প্রচার করতে থাকে মেডিকেল কলেজগুলো। তবে অনুমোদন বাতিল করার পর কলেজগুলোর বিরুদ্ধে আর কোনো ব্যাবস্থা নিতে দেখা যায়নি। আগষ্ট মাসে ৬টি বেসরকারি মেডিকেল কলেজকে পুনঃঅনুমোদন দেয় মন্ত্রণালয়।
 
টিআইবি’র প্রতিবেদনে অস্বস্তি
অনিয়ম-দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে দেশের স্বাস্থ্যখাত। দুর্নীতি ছাড়া এই খাতে নিয়োগ, বদলি, পদায়ন এবং পদোন্নতি কিছুই হয় না। এছাড়া যে কোনো টেন্ডার বা ছোটখাটো যে কোনো কাজের জন্যও গুণতে হয় ঘুষ। এক্ষেত্রে সর্বনিম্ন ১০ হাজার টাকা থেকে সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ঘুষ দিতে হয়। স্বাস্থ্য অধিদফতর, সিভিল সার্জন কার্যালয় ও ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালীরা এ অর্থ নিয়ে থাকেন। এ ছাড়া বিভিন্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার থেকে চিকিৎসকরা ৩০ থেকে ৫০ শতাংশ কমিশন খেয়ে থাকেন। আর দালালরা নিয়ে থাকেন ১০ থেকে ৩০ শতাংশ। দেশের স্বাস্থ্যখাতের অবস্থা এতটাই বেহাল যে, ৩ হাজার ২৯৭ জন সেবাগ্রহীতার জন্য ডাক্তার মাত্র একজন। অথচ বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) মানদণ্ড অনুযায়ী ডাক্তার ও রোগীর অনুপাত হওয়ার কথা ১:৬০০ জন। স্বাস্থ্যখাতের ওপর টিআইবি’র এ গবেষণা প্রতিবেদন আছড়ে পড়ে সিডরের মতো।
 
যদিও সংবাদ সম্মেলন করেই এসব অভিযোগের প্রমাণ দাবি করেন নাসিম।
 
মেডিকেলে ভর্তি নাম্বার বৃদ্ধি
চিকিৎসকদের মান নিশ্চিত করতে মেডিকেলে ভর্তির জন্যে পরীক্ষায় ২০ নাম্বারের পরিবর্তে ৪০ নাম্বার নির্ধারন করে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর ফলে শিক্ষার্থী সংকটে পড়েছে বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলো। ভর্তি ফি ১৩ লাখ ৯০ হাজার টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার।
 
আসনের তুলনায় ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেশি হলেও উচ্চ ফি দিয়ে বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তির মতো আর্থিক সঙ্গতি অনেকেরই নেই।
 
তাছাড়া বেসরকারি মেডিকেলে ভর্তির জন্য সরকার-নির্ধারিত ফির বেশি চাওয়া হচ্ছে। বেসরকারি মেডিকেল কলেজগুলোর এ দুরবস্থার জন্য অপরিকল্পিতভাবে ও রাজনৈতিক বিবেচনায় অনুমোদন, গুণগত মানহীনতা, শিক্ষক সংকট, উচ্চহারে ফি আদায়সহ কয়েকটি কারণকে দায়ী করেছেন বিশেষজ্ঞরা।
 
৬ হাজার চিকিৎসক নিয়োগ
গ্রামে চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করতে গত ৭ আগস্ট তারিখে সারাদেশে ৬ হাজার নতুন চিকিৎসক নিয়োগ দেয় সরকার। ৩৩তম বিসিএস-এ উত্তীর্ণ চিকিৎসকদেরকে নিয়োগ দেয়া হয় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে। তবে প্রথম দিকে চিকিৎসকদের নিজ জেলায় নিয়োগ না হওয়াতে মন্ত্রীর কথার সঙ্গে কাজের মিল খুঁজে পাওয় যাচ্ছিল না। পরে চিকিৎসকদের নিয়োগ প্রক্রিয়া আবারো ঢেলে সাজানো হয়।
 
ইবোলার প্রার্দুভাব
সারাবিশ্বেই ২০১৪ সাল স্বাস্থ্যখাত বিভীষিকাময় হয়ে উঠে ইবোলা নামে এক প্রাণঘাতি ভাইরাসের ছোবলে। আফ্রিকায় একের পর এক গ্রাম মানবশূন্য হয়ে পড়তে থাকে এ ভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে। ছোঁয়াচে এ ভাইরাস আক্রান্তের প্রাণ কেড়ে নেয় কয়েক ঘন্টার মধ্যেই। লাইবেরিয়া থেকে ছড়ানো এ ভাইরাসের প্রবেশ ঠোকাতে দেশের বন্দরগুলোতে বসানো হয়েছে থার্মাল মেশিন। আফ্রিকা থেকে আসা যাত্রীদের পরীক্ষা করে ঢোকানো হচ্ছে দেশে।
 
এছাড়াও বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থ্যার মাধ্যমে আফ্রিকার দেশগুলোতে ইবোলা রোগীকে চিকিৎসা দিতে বিশেষ পোশাক এবং অন্যান্য সাহায্য পাঠায় স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়। এ সময়টায় আফ্রিকার দেশগুলোতে শান্তিরক্ষা মিশনে কর্মরতদের নিয়ে দুঃচিন্তায় পড়ে দেশের মানুষ।
 
হাসপাতালে ধর্মঘট
বছরের প্রথমার্ধে নতুন স্বাস্থ্যমন্ত্রীকে সবচেয়ে বিব্রত অবস্থায় ফেলে বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসক, নার্স, কর্মচারীদের ধর্মঘট। রাজধানীর পুরান ঢাকার স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে সংবাদ সংগ্রহে গিয়ে শিক্ষানবিশ চিকিৎসকদের হামলার শিকার হন একুশে টিভির কয়েকজন সাংবাদিক। এ অভিযোগে একুশে টেলিভিশন কর্তৃপক্ষ একটি মামলা করে। এরপর ২১ এপ্রিল দুপুর থেকেই কর্মবিরতি শুরু করেন শিক্ষানবিশ চিকিৎসকেরা। তাঁদের ধর্মঘটের কারণে হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হয়। অনেক রোগী সেবা না পেয়ে হাসপাতাল ত্যাগ করেন। পরে চিকিৎসক ও সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ বিষয়টি মীমাংসা করেন।
 
সেপ্টেম্বরেও এক নার্সের গায়ে হাত তোলাকে কেন্দ্র করে ইর্ন্টার্নদের সঙ্গে দ্বন্দ্বে আবারো কর্মবিরতির ডাক দেওয়া হয় মিটফোর্ডে।
 
এর আগে এপ্রিলে রাজধানীর বারডেম হাসপাতালের জরুরি বিভাগ, নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্র (আইসিইউ), করোনারি কেয়ার ইউনিট (সিসিইউ) এবং ভর্তিকৃত রোগিদের আওতামুক্ত রেখে অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট ডাকেন চিকিৎসকরা। ১৩ এপ্রিল রাতে রোগীর স্বজনরা কয়েকজন চিকিৎসককে মারধর ও লাঞ্ছিত করেছেন মর্মে  অভিযোগ করে চিকিৎসকরা কর্মবিরতি শুরু করেন।
 
দায়িত্ব নেয়ার পর কর্তব্যে অবহেলার কারণে ১৩ জন চিকিৎসককে বরখাস্ত করেনস্বাস্থ্যমন্ত্রী নাসিম। এর আগে রোগীর প্রতি অবহেলার জন্যে এতো চিকিৎসককে বরখাস্তের ঘটনা কখনো ঘটেনি।
 
বিশ্ব স্বাস্থ্যসংস্থ্যা থেকে বাংলাদেশকে ঘোষণা করা হয়, উন্নয়নশীল দেশে স্বাস্থ্যসেবা উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে।
 
বাংলাদেশ সময়: ০৭১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩০, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।