ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

আমার মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে | সানজিদা সামরিন

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২৩ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৬
আমার মৃত্যুর কিছুক্ষণ আগে | সানজিদা সামরিন

ধীরে ধীরে ঘাড়ের রগটা ছিঁড়ে গেলো। কর্কখোলা বোতলের মুখ থেকে যেভাবে গড়গড়িয়ে জল পড়ে তেমনি অনর্গল রক্ত বের হতে লাগলো।

ওমা, আমার মৃত্যু হচ্ছে! একথা ভেবে ভুলেই গেলাম ছেঁড়া রগের ব্যথা। অনুভূত হলো না ঘাড়টা বাঁকা হয়ে পড়ে রয়েছে রাস্তায়।
  
ডান কাত হয়ে চিৎ হয়ে পড়ে রয়েছি। এক পায়ের স্যান্ডেল খুলে গেছে। আরেক পায়ে দিব্যি এঁটে রয়েছে আড়ংয়ের পুঁথি বসানো স্যান্ডেল। ইস্ একটুও আরামদায়ক না চপ্পলটা। ফোসকা পড়ে যায়। সেবার মাধবের সঙ্গে ইউনিভার্সিটি এলাকায় বহুত হাঁটা হয়েছিলো। কতোগুলো যে ফোসকা পড়েছিলো পায়ে! সঙ্গে ব্যথাও ছিলো। ওহ হ্যাঁ, আমার ঘাড়ের রগটা কেটে গেছে। রক্তে মাথার পেছন দিককার চুল চুপচুপে হয়ে গেলো ভিজে। মাথা সোজা করতে পারছি না। রাস্তায় একটা মানুষও নেই। অবশ্য এতো ভোরে কে থাকবে? পাশে একটা মসজিদ। আজান পড়লে নামাজ পড়তে হয়তো অনেকেই আসবে। তখন কাউকে ডেকে বলবো যেনো আমার মুখের স্কচটেপটা খুলে দেয় আর ঠোঁটটা ভালোভাবে মুছে দিয়ে যায়। রক্ত গড়িয়েছে ঠোঁটেও। রক্তের গন্ধটা বড্ড কটু লাগে। অম্ল স্বাদ। কী বাজে! এজন্যই আমি গাজর আর বীট খাই না। কেমন রক্ত টাইপ টেস্ট।  

এও ঠিক এই চিপা গলিতে যম ছাড়া কে-ই বা দেখতে পাবে আমাকে। টিনের বেড়ার ফাঁক দিয়ে কেবল আমিই রাস্তার পিচগুলোকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
  
উফ! আর কতোক্ষণ এভাবে শুয়ে থাকবো। যমদূত কী আসবে না! রাস্তার মধ্যে ১০ মিনিট দাঁড়িয়ে থাকাও আমার জন্য অস্বস্তিকর। সেখানে এভাবে চিৎ হয়ে শুয়ে থাকা ছি ছি টাইপ বিষয়। মাধব বরাবরই দেরি করে আসে, তাই আমায় বলতে গেলে সবসময়ই দাঁড়িয়ে থাকতে হয় রাস্তায়। কিন্তু এখন তো মাধব না, আসবে যম। প্রচণ্ড ব্যথা, কেউ বুঝি সুই দিয়ে অনবরত খোঁচাচ্ছে। বোধহয় যমদূতের গাড়ি রেড সিগন্যাল পার হয়ে গেছে...।  

মা বলেছিলেন, ভালো কাজ করলে যমদূত প্রিয় মানুষের রূপ ধরে আসে, আর খারাপ কাজ করলে একশোটা ডানা নিয়ে ভয়ঙ্করভাবে হাজির হয়। কে জানে, কতো কাজই তো করেছি, যমদূত কী রূপ নিয়ে আসবে। কিন্তু আমার প্রিয় মানুষ কে? চোখ বন্ধ করে দেখবো নাকি! 

চোখ বন্ধ করতেই ঘাড়ের কাটা অংশ মনে হলো ফটাশ করে ফেটে গেলো। মস্তিষ্কে একটা ঢেউ খেলে গেলো। ধবধবে ফর্সা একটা মুখ, মুখে হালকা চাপ দাড়ি, ঝকঝকে সাদা হাসি আর কোকড়া চুল। শীতলদা? শীতলদাকে দেখলাম কেন? মাধবের মুখটা কেন এলো না? 

আজান পড়ে গেলো। আমাকে পাশ কাটিয়ে অনেক নামাজি চলে গেলেন মসজিদে। তাদের পাগুলো আমার পড়ে থাকা হাতের পাশ দিয়ে চলে গেলো। মনে হলো, মাথার উল্টোপাশে কেউ দাঁড়িয়ে। কে? সাদা টি-শার্ট আর কালো প্যান্ট পরা একটা ছেলে আমার মাথা কোলে তুলে নিলো।  

- শীতলদা? তুমি?
- তোমাকে নিতে এলাম।
- কোথায় যাবে আমাকে নিয়ে?
- পাতালপুরী। যাবার এতোই তাড়া ছিলো তোমার?

শীতলদাকে তো আমি তুমি করে বলি না। আপনি করে বলি। তখন কেন তুমি বললাম জানি না। শীতলদাও স্বাভাবিক ছিলেন।

- ও, তুমি বেঁচে নেই শীতলদা?
- আমি বেঁচে আছি। ঘুমাচ্ছি বাড়িতে। কাজ না থাকলে এতো ভোরে উঠি না আমি। আসতে হলো তোমাকে পাতালে রেখে আসবো বলে।

আমার ঘাড়ের শিরা কেটে গেছে, উপশিরাগুলো চড়চড় করে ছিঁড়ে যাচ্ছে। কোমলভাবে ফোঁটা ফোঁটা গড়ানো রক্তে ভিজে যাচ্ছে আমার চুল আর শীতলদার সাদা টি-শার্ট।
 
শীতলদা চুপচাপ। তবে গম্ভীর নন। ঘর কাঁপিয়ে দুষ্টুমিতেও মেতে ওঠেন বড়। অবশ্য আমার সঙ্গে অতো কথা বলেন না, হঠাৎ যখন বলেন, খুব বলেন। তবে আমার কোনো কথা ফিরিয়েও নেন না। বড্ড গুছিয়ে কথা বলেন। মনে হয়, কবিতা বলছেন। শুদ্ধ উচ্চারণ।

যদি বলি- দাদা, আপনাকে আমি বড্ড জ্বালাই না?
শীতলদা বলেন, নাও এবার জ্বালাতে শুরু করো।

ফাঁকা সময়ের সঙ্গী আর দুঃসময়ের অবলম্বন দু’টোই শীতলদা। অবলম্বন শব্দটা হয়তো একটু বেশিই গাঢ় হয়ে গেলো। এসব বলতে নেই, মনেই থাকা ভালো। সহজ কথা এ দুনিয়ায় বড্ড কঠিন। শীতলদা এমন একজন যাকে আশ্রয় করা যায়। মন গলিয়ে বহুক্ষণ কথা বলা যায়। মানুষটাই এমন, যাকে ঘর মনে হয়।

তার সঙ্গে আমার পরিচয় উষাদির অ্যাঙ্গেইজমেন্টের দিন মণীষাদের বাড়ি। অনুষ্ঠানে শীতলদা এসেছিলেন তার পিসির বাড়ি। উষা-মণীষা শীতলদার পিসতুতো বোন। বিকেলবেলা মাসীমা, আমি আর মণীষা রান্নাঘরে কাজ করছিলাম। দুই পর্দার মাঝ দিয়ে সোনালি পেড়ে সাদা ধুতি আর নীল পাঞ্জাবি পরে শীতলদা ঢুকলেন। তিনি ফর্সা তবে অসহ্যকর ফর্সা নন।

স্মিত হেসে বললেন, পিসি পাঞ্জাবিটা ঠিক আছে, বড় হয়নি?
মাসিমা বললেন, হ্যাঁ, ভালো দেখাচ্ছে বাপধন।

কোনো কথা না বলে একটুখানি হেসে সুবোধ বালকের মতো চলে গেলেন তিনি। আমি জানতে চাইনি তরুণ রবীন্দ্রনাথের মতো দেখতে ছেলেটি কে? আমি কখনও কিছু জানতে চাই না। প্রশ্ন আমার মনে এসেই ইস্তফা দেয়, মুখ অব্দি গড়ায় না।  

শীতলদা চলে যেতেই ধমাধম দরজার পর্দা সটকে ঘরে ঢুকলো মাধব। স্মোকি সানগ্লাসটা কব্জি দিয়ে উপরে ঠেলে বললো- মা, একটু কাজ আছে বাইরে যাচ্ছি।

মাসিমা বললেন, এখন কোথায় যাবি?
- আছে একটু কাজ। আড়চোখে আমাকে দেখলো সে। আমি খুব স্বাভাবিক ভঙ্গি ধরে রাখতে চেষ্টা করলাম, মাধবও তাই। সে অবশ্য সবার সামনে একটু বেশিই সিরিয়াস থাকে। চেনেই না আমাকে এমন ভাব ধরে রাখে।

লুজ শার্ট, সাদা জিন্স আর সাদা কেডস পরে নাইন্টিজের নায়কের মতো হেলেদুলে চলে গেলো মাধব। আমার মনটাও গাঢ় বিষাদে ভরে উঠলো। সে চলে গেলো বলে না, অন্য কোনো কারণ। ব্যাখ্যা না করতে পারার মতো গাঢ় বিষাদ।

মণীষা খুব শান্ত মেয়ে, তার ভাইটা এমন কেন কে জানে। অবশ্য প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর ‘এমন কেন’ এই প্রশ্ন করার কিছু নেই।

বরপক্ষের লোকজন আসবে সন্ধ্যার পর। উষাদি মোটামুটি তৈরি। অ্যাঙ্গেইজমেন্ট একটু জাঁকজমকভাবে হচ্ছে। এসব অনুষ্ঠানে আমি যাই না খুব একটা। তবে মাসীমার কথা ফেলতে পারলাম না। বড্ড মায়া করেন আমাকে। ডাইনিং টেবিলের উপর অনেকগুলো রঙিন মোমবাতি। এগুলো জ্বালানো হবে একটু পর। পিতল আর মাটির বেশ কতোগুলো প্রদীপও রয়েছে। আজ মণীষাদের বাড়ি অনেক লোকজন। এতো ভিড় সইতে পারি না আমি।  

মণীষা আর আমি তৈরি হয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে রয়েছি। লিভিংরুমের সবাই যে যার মতো ব্যস্ত। চোখে পড়লো, শীতলদা প্রদীপ জ্বালাচ্ছেন। এতো শান্ত, এতো গোছানো তার ভঙ্গি। পবিত্র নীরব হাসি ঠোঁটে। প্রদীপের সমস্ত শুদ্ধতা ছড়িয়ে পড়েছে তার চোখে-মুখে। এ যেনো শুভ্র রবীন্দ্রনাথ। চোখেমুখে আলো মাখানো তরুণ যেনো কখনও মিথ্যে বলেনি। কেন যেনো তাই মনে হলো আমার।        

এমন সময় অন্তর কাঁপিয়ে তারস্বরে মাধব বললো- মণীষা, বললাম না গরম পানি দে!
- পানি গরম হতেও তো সময় লাগে দাদা! মণীষা মুখ কালো করে লাফাতে লাফাতে চলে গেলো।

ভ্রু-দু’টো এতো কুঁচকাতে পারে মাধব! আমার দিকে তাকাতেই দুই ভ্রু জায়গামতো দূরত্বে চলে গেলো তার।
- শাড়ি পরেছো?
- পরেছি।  
- কেন?
- এমনিই। তুমিও পাঞ্জাবি পরবে আজ প্লিজ?
- এই যে, মেহরুন তুমি কিন্তু বেশি আবদার শুরু করেছো আজকাল। আগে কিন্তু এমন ছিলে না।
- এটা যে বেশি আবদার হবে বুঝতে পারিনি মাধব। ঠিক আছে আর বলবো না।  

যতোটা শান্ত হয়ে কথাটা বলা যায় বললাম। উল্টো ঘুরে বের হওয়ার সময় খপ করে হাত ধরে সে বললো- খুব সাহস তোমার, রাগ করো আমার সঙ্গে? তুমি কিন্তু ইদানিং খুব বেড়েছো মেহরুন। শোনো চাহিদা এতো বাড়িও না বুঝলে?
- মাধব, যা বলছো, কী বলছো, যাকে বলছো তার জন্য কতোটা সহনীয় একটু ভাবো। আমাকে ছাড়ো।


ঝাড়া দিয়ে আমার হাত ছেড়ে মাধব বললো, যাও তুমি! আর এসো আমার সামনে।
আমি শান্ত ভঙ্গিতে বের হয়ে গেলাম ঘর থেকে। চোখটা জ্বলে উঠছে। কোথাও একটা আড়াল দরকার। বা দিকে ‍ঘুরতেই শীতলদার সঙ্গে ধাক্কা খেতে খেতেও খেলাম না। হয়ে গেলাম দু’জনেই অপ্রস্তুত।
সরি বলে পাশ কাটিয়ে গেলেন শীতলদা। আমি বারান্দা গলিয়ে নিচে নেমে এলাম।
বরপক্ষের লোকজন চলে এসেছে। মণীষা উষাদিকে নিয়ে ব্যস্ত। সেখানে মণীষাদের অনেক কাজিনও রয়েছে। আমি কিছুক্ষণ ওদের কাছে বসে মোবাইল টেপাটেপি করে উঠে এলাম। কাজ না থাকলে আর অস্বস্তি কাটাতে সবচেয়ে সহজতর কাজ হচ্ছে মোবাইল ফোন টেপাটেপি আর ফেসবুক স্ক্রলিং। মাধব অনলাইনে। খানিক সময় বাদে তাকে দেখাও গেলো। সেই যে রাগ করে চলে এলাম তারপর ওর কোনো খবর নেই। আমিও ফোন করিনি। কিন্তু অপেক্ষায় রয়েছি তার জন্য, যদি ফোন করে।  

উষাদিকে নিচে লিভিংরুমে নিয়ে যাওয়া হবে। মণীষার জোরাজুরিতে আমাকেও ওদের সঙ্গে নিচে যেতে হলো। উষাদিকে বসিয়ে আমি বসার ঘরের পাশে পর্দাঘেরা ছোট বুক কর্নারে বসে সবাইকে দেখছি। আংটি বদল হচ্ছে। গমগম করছে ঘর। শীতলদা খিলখিল করে হাসছেন আর ছবি তুলছেন। পুরো সময়টা আমি পর্দার আড়ালেই বসে রইলাম। মণীষা হয়তো আমাকে খুঁজতে খুঁজতে আমার সামনে দিয়েই চলে গেলো। কিন্তু টের পেলো না আমি রয়েছি। বহুক্ষণ বাদে পর্দা সরিয়ে মণীষা বললো, কী রে এখানে তুই? আমি খুঁজছি তোকে। চল খাবো, মা ডাকছেন।

ইচ্ছে হচ্ছিলো বলি, খাবো না। কিন্তু শোভনীয় হবে না ভেবে উঠলাম। প্যাসেজ গলিয়ে ডাইনিংয়ে ঢোকার সময় দেখি শীতলদা আর আরেকটা ছেলে দাঁড়িয়ে। শীতলদা বললেন, খাওয়া হয়েছে?

- যাচ্ছি। আপনি?
- হ্যাঁ, খেয়েছি।

এটাই তার সঙ্গে আমার প্রথম কথা। মাধব কোথায়, ওকে ফোন করলাম। ফোনটা কেটে দিলো। খেয়েছে কিনা জানতে চেয়ে একটা মেসেজ করলাম, তারও উত্তর এলো না। ওদের ডাইনিং টেবিলের সামনে বিশাল একটা আয়না। আয়নার ভেতর দিয়ে দেখা গেলো মোবাইল স্ক্রিনে চোখ রেখে মাধব আসছে। আমার পেছনের একটা চেয়ারে বসে পানি খেলো। তারপর টানা কয়েক মিনিট ফোনে বকরবকর করে উঠে চলে গেলো। আমার কী ভাবা উচিত বুঝে পেলাম না। লক্ষ্মী হয়ে খেয়ে উঠলাম। তারপর মাধবকে ফোন করলাম। এবার সে ফোন ধরলো।  

- মাধব কী করো?
- এইতো সবার সঙ্গে কথা বলি। তুমি?
- খেয়ে উঠলাম। একটা মেসেজ করেছিলাম, তার আগে একটা ফোন করেছিলাম দেখেছো?
কিছুক্ষণ চুপ থেকে সে বললো, হ্যাঁ।

রিপ্লাই দিলে না কেন বা ফোন ধরলে না কেন অথবা আমার পেছনে বসে থেকেও কিছু না বলে উঠে এলে কেন- এগুলো বলার কোনো প্রয়োজন মনে করলাম না। একমাত্র বলার যেটা পেলাম তা হচ্ছে- আচ্ছা, রাখি। মাধব তাতে মুক্তিই পেলো মনে হলো।

আমার গা দিয়ে যেনো ধোঁয়া বের হচ্ছে। পায়ের গতি বেড়ে গেছে। সব ভেঙেচুরে চলে যেতে ইচ্ছে করছে। ধাপাধপ সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠছি। আবারও তরুণ রবীন্দ্রনাথের দেখা -

- অগ্নিমূর্তি কেন দূর্গা?
- আমি মেহরুন, দূর্গা নই।
- সে তুমি যাই হও, এখন তোমাকে দূর্গা লাগছে। মনে হচ্ছে, অসুর বধ করতে যাচ্ছো।

হাসা উচিত ছিলো হয়তো। অপরিচিত মানুষ দেখলে আমার অনুভূতি নিজেই বিব্রত হয়ে পড়ে। হাসার চেষ্টা করে পাশ কাটিয়ে চলে এলাম। মণীষাকে খুঁজছি। এখনই বাড়ি যাবো। বাড়ি না হোক, এখানে থাকবো না। বুকটা কেবল ভারী হচ্ছে। একটু একা থাকা দরকার। একটু অন্ধকার চাই। এখানে এতো আলো। খুঁজে ফিরে সেই বুক কর্নারে এসে বসলাম। পাশের টেবিলে একটা মোবাইল ফোন পড়ে রয়েছে আর একটা সাদা শাল।
 
-কী ব্যাপার তুমি এখানে একা একা বসে আছো কেন?
কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম- এমনি শীতলদা।
- তোমাকে তুমি করে বললাম বলে কিছু মনে করো না।
- না দাদা তা কেন? আমি আপনার ছোটই হবো।
- এখানে এসো সবাই আছে।

শীতলদাকে ইচ্ছে হচ্ছিলো বলি- আমি ভিড়ে মিশে যেতে পারি না, হারিয়ে যাই শীতলদা। আমাকে একা থাকতে দিন।

বললাম- শীতলদা, আমি এখানেই বসি। ক্লান্ত লাগছে।
- মুখটা শুকনো কেন?
- কোথায়, না তো।
- আজকেই তোমার সঙ্গে পরিচয় হলো। যদিও বলা ঠিক না, শুরু থেকেই মুখটা বিষণ্ন তোমার। সবাই হাসছে তুমি যেনো কোথায় হারিয়ে আছো।
- আমি এমনই শীতলদা।
- অবশ্য প্রথম দেখেই বোঝা যায় না কাউকে।
- বহুদিন দেখেও অনেককিছুই বোঝা যায় না।
- তা ঠিক। যাই হোক, এসো সবাই ছবি তুলি।  
- আমি চলে যাবো। নয়টা বাজে। বাড়ি ফেরা উচিত।
- ও আচ্ছা। ঠিক আছে। যাওয়ার সময় বলে যেও কেমন?
- আচ্ছা।

শীতলদা ফোন আর শাল নিয়ে চলে গেলেন।

তাড়াহুড়ো করে শাড়ি বদলে নিলাম। ব্যাগ গোছাতে গোছাতে মাধবকে ফোন করছি। প্রথমবার সে কেটে দিলো। পাত্তা না দিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে আবার ফোন করলাম। তাও ধরলো না। ঠিক আছে আমারও দরকার নেই। ব্যাগ কাঁধে নিয়ে মাসীমাকে বলে মণীষাকে নিয়ে দরজা অব্দি এলাম।

- মাধবদা কোথায়? মণীষা আমাকে জিজ্ঞেস করলো। শুনেই গা জ্বলে গেলো আমার।
- আমি কী করে জানবো কে কোথায়?
- কথা হয়নি দাদার সাথে!
- মাথা খারাপ তোর? আচ্ছা শীতলদা কোথায়?
- বাইরে হবে হয়তো। তুই যেতে পারবি একা?
- ঢং করিস না। একাই চলাফেরা করি।
- মাধবদাকে বলি বা আমি আসবো?
- লাগবে না। আমি গিয়ে ফোন করবো।

মেইন গেট দিয়ে বের হয়ে দু’পা এগোলাম। এমন সময় চোখে পড়লো মাধব আর একটা মেয়ে দাঁড়িয়ে। মেয়েটাকে পেছন দিক থেকে দেখা যাচ্ছে। মাধব নিজের ফোনে কী যেনো দেখাচ্ছে তাকে। মনে পড়লো, সে আমার ফোন ধরেনি। বিষক্রিয়া বুকে ছড়িয়ে পড়বে এমন সময় মাধব নিজেই আমার দিকে তাকালো।  

হাত নেড়ে বললাম, চলে যাচ্ছি।  
মাধব মাথা কাত করে বললো, ওকে।
মেয়েটা আমায় দেখতে পেছন ফিরলো। তার আগেই আমি ঘুরে হাঁটা শুরু করলাম।

মাধবের মুখে শুধু ‘ওকে’ শুনে কানটা ফাঁকা ফাঁকা লাগলো। আরও দু’-একটা শব্দ বা একটা বাক্য হলে বোধহয় ঠিক হতো। যতোটা সম্ভব মুখ স্বাভাবিক রেখে এগোচ্ছি।
 
- মেহরুন!
পেছন ফিরে দেখি শীতলদা। উনি বাইরে কী করছেন? ওহ হ্যাঁ, তাকে তো বলে আসার কথা ছিলো। ভুলেই গেলাম।
- কী চলে যাচ্ছো?
- হুম চলে যাই।
- কীভাবে যাবে?
- বাসা কাছেই।  
- কোথায় বাসা?
- এইতো ১৫ মিনিটের পথ। রিকশা নিয়ে চলে যাবো।
- রিকশা করে দিচ্ছি দাঁড়াও।  
- রিকশা পেতে আরেকটু হাঁটতে হবে। আমি পারবো শীতলদা।
- আচ্ছা সাবধানে যেও।

পরদিন ইউনিভার্সিটি যাওয়ার সময় মণীষাকে নিতে ওদের বাড়ি গেলাম। দরজা খুললেন শীতলদা।
- কী সৌভাগ্য, ঘুম ভেঙেই দূর্গাদেবীর দেখা!
- কেমন আছেন শীতলদা?
- এইতো। তুমি কেমন?
- আছি ভালো।

নিজ মনেই বলে উঠলাম, আমি ভালো নেই শীতলদা। গতকাল বাড়ি ফেরার পথে তুষার ছেলেটা গলির মোড়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। রাত আটটা-নয়টাও আমাদের ওখানে রাত একটার মতো শুনশান। রাস্তার পাশে দোকানপাট কিছু নেই বলে দু’-একজন পথচারী ছাড়া কোনো সমাগম নেই। অনেকদিন ধরে উত্যক্ত করছে ছেলেটা। বাড়ি থেকে বের হলেই দেখা যায়, পিছু নেয়। পেছন পেছন রিকশা নিয়ে আসে কখনও। একটা নেশাখোর বদমাশ। কোত্থেকে আমার ফোন নম্বর পেয়েছে জানি না। কাল খুব ভয় লাগছিলো। রিকশা থেকে নামার পর নাম ধরে অনেকক্ষণ ডাকছিলো, পিছু পিছু এগোচ্ছিলো। আমি কোনোরকমে বাড়ির ভেতর ঢুকেছি। বাড়ি ফিরে ফোনটা সুইচ অফ করে রেখেছিলাম। ফোন অন রেখে মাধবের অপেক্ষায় বারবার স্ক্রিনে চোখ রাখার কোনো কারণ খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মাধব হয়তো কয়েকবার ফোন করেছে রাতে। দিতে হয় বলেই নিয়মমাফিক ফোন যেটাকে বলে। জানি না কোন আকাশ আমার মাথায় ভেঙে পড়বে আজ।

সরাসরি দোতলায় উঠে মণীষার ঘরে ঢুকবো, এমন সময় হ্যাঁচকা টানে মাধব আমাকে নিয়ে গেলো নিজের ঘরে। দরজা বন্ধ করে দিলো।


মূর্ছা যাবার মতো মেঘস্বরে বললো, ফোন অফ ছিলো কেন তোমার?
- ফোন খোলা রাখার কোনো কারণ নেই মাধব।
- কারণ নেই মানে কী, তুমি অফ করবে কেন ফোন? বাসায় গিয়েও তো কোনো ফোন করোনি আমাকে।
- ফোন করে কী হবে আশ্চর্য! ফোন ধরো তুমি? আমার ইমোশনের কোনো মূল্য আছে তোমার কাছে?
- একদম তর্ক করবে না। আমি ধরি বা না ধরি, তুমি বাসায় গিয়ে কেন ফোন করবে না?
- কাল তোমাদের বাসায় থাকতে কতোবার কল করেছি হুঁশ আছে? ফোন ধরোনি, মেসেজের রিপ্লাই করোনি। চলে আসার সময় পাত্তাই দিলে না। তোমাকে কেন ফোন করবো?
- তোমার যতো অভিযোগ। এসব বাদ দাও মেহরুন। এতো এক্সপেক্টেশন ভালো না। এক্সপেক্টেশন কমাও, নয়তো খুব খারাপ হবে বলে দিচ্ছি! তুমি আমার ভুল ধরতে আসবে না। নিজেকে শোধরাও।
- হাত ছাড়ো মাধব, লাগছে আমার!
- নাও, যাও এখান থেকে! এমনিতেই তোমার-আমার কাস্ট প্রবলেম আছে। তারপর তোমার এতো আবদার, এতো অভিযোগ। শোনো আর যদি কখনও তোমার এমন আচরণ দেখি তাহলে আমি সোজা তোমাকে ছেড়ে দেবো। মনে রেখো।

দরজা খুলে চলে এলাম। আমার শরীর থরথর করে কাঁপছে, একটু কাঁদা উচিত। অবশ্য আদৌ কী উচিত আর কী উচিত না আমি এখন কিছুই বুঝি না। দ্বিধা দ্বন্দ্ব তৈরি করে, আর অযথা দ্বন্দ্ব তৈরি করে দ্বিধা। দূর্বোধ্যকে বুঝতে গিয়ে নিজেই বোধহীন হয়ে পড়ছি। তৈরি হচ্ছে এমনি এমনি খারাপলাগা, এমনি এমনি কষ্ট। সবার যাবতীয় প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে এসে ঠেকছে- জানি না, কিছু না, কিছু হয়নির দুয়ারে। এই মুহূর্তে সব ছেড়ে বাড়ি চলে যাওয়া উচিত বা রিকশায় একা একা ঘুরে আসা উচিত জননীরব রাস্তা দিয়ে। কিন্তু মণীষা তৈরি হচ্ছে, ওকে ফেলে যাই কী করে। লিভিংরুমে শীতলদা বসে। আমিও গিয়ে বসলাম।  
- গতকালের ছবি দেখেছো? শীতলদা বললেন।
- না দেখিনি।
- মণীষা তোমার ফেসবুকে অ্যাড নেই? ও কালকের ছবি দিয়েছে  তো ফেসবুকে।
- ও আচ্ছা। আমি ফেসবুক চেক করিনি। আছে হয়তো।

বেশ কিছুক্ষণ স্বাভাবিক কথা হলো শীতলদার সঙ্গে। পরিচয় আলাপচারিতা যেমন হয়। কথাবার্তায় বোঝা গেলো তিনি আজ বিকেলে চলে যাবেন কলকাতা। সেদিন সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে ফেসবুক আপডেট দেখলাম। মণীষা ছবি ট্যাগ করেছে। ট্যাগে রয়েছেন শীতলদাও। কিছুক্ষণ তার প্রোফাইল দেখে লগ আউট করে দিলাম।  

মাধবের প্রোফাইলে রোজই কয়েকবার ঢুকি। এমনিই ঢুকি। কখনও টাইমলাইন দেখে মুশড়ে পড়ি, কখনও সামলে যাই। বহুদিন বাদে বাদে হেসেও উঠি। মাধবের সঙ্গে আমার অনেক কথা, কিন্তু বলার মতো কোনো কথা নেই। কী করো, কখন ফিরলে আর খেয়েছো কিনা ছাড়া কোনো কথা পাই না।
 
সেদিন ক্লাস শেষে বাড়ি ফিরছি। বড্ড দেরি হয়ে গেছে। তুষার ছেলেটা দাঁড়িয়ে। এমনভাবে দাঁড়িয়ে যে ওখান দিয়ে যেতে হলে তাকে সরতে বলতে হবে। আমি হনহন করে হেঁটে যেতে লাগলে সে আমার হাত ধরলো। আমি জোর করে ছাড়িয়ে নিতেই সে আমাকে আরও শক্ত করে ধরলো।  
- ছাড়ুন, কী করছেন?
- তুমি আমাকে অ্যাভোয়েড করো কেন বলো?
- আমি আপনাকে পছন্দ করি না। আমি ‍আমাকে ডিসটার্ব করবেন না প্লিজ। ছাড়ুন।
- কেন পছন্দ করিস না তুই বল্। কেন?
- আপনার মতো ইডিয়টকে কেন পছন্দ করবো। স্টুপিড!
- তুই যদি আমাকে অ্যাভোয়েড করিস তবে তোকে আমি মেরেই ফেলবো।
- মেরে ফেললেও আমি আপনার মতো ইডিয়টের দিকে তাকাবো না।

কোনোমতে ছুটে বাড়ি ফিরলাম। বুক ধড়ফড় করছে। কাঁপা কাঁপা হাতে মাধবকে কল করলাম। গরগর করে পুরো ঘটনা জানালাম তাকে।
-    মেহরুন, এতো বোকামো করো কেন? এটা কোনো বিষয় নাকি। তুমি অ্যাভোয়েড করলেই পারো ছেলেটাকে।
-    তা তো করিই মাধব, আজ খুব ভয় পেয়েছি। সে জবরদস্তি করছিলো। আশেপাশে কেউ ছিলো না।  
-    তুমি অ্যাভোয়েড করলে এমন ঘটনা ঘটে কী করে। যাইহোক বিষয় না, পাত্তাটাত্তা দিও না।

মাধবের ফোন রাখার পর নিজেরই মনে হলো, আসলেই হয়তো এটা মাধবকে জানানোর মতো বিষয় ছিলো না। জানানোটাই বোকামি হলো।  

রাতে ফেসবুক নাড়াচাড়া করতে করতে শীতলদার প্রোফাইলে গেলাম। সবগুলো ছবি নেড়েচেড়ে অ্যাড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছি। পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে ফেসবুকে লগ ইন করে চমৎকার একটা মেসেজ পেলাম। শীতলদা লিখেছেন- দূর্গাদেবী, ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালেন বলে ধন্যবাদ! এবার বলো কেমন আছো তুমি? উষাদির বিয়ের খবর নিশ্চয়ই জানো। আমি আসবো পরের সপ্তাহে। দেখা হবে। ভালো থেকো।

মেসেজটা পড়ে মনটা কেমন চনমনে হয়ে উঠলো। সকালটাই দারুণ লাগছে। ভালো লাগছে আমার। ভালোবোধের কোনো সংজ্ঞা হয় না। সবার সঙ্গে ভালোবোধ হয় না। আপনবোধ একান্ত মনের ব্যাপার। কখন যে কে মনের আপন হয়ে যায়, আবার কখনও আপন নিজেই আপন হতে পারে না।  

শীতলদার সঙ্গে প্রায়ই ইনবক্সে কথা হয়। সাদাসিধে সহজ মানুষ। জীবনটা যে কতো সহজ তা শীতলদার মতো মানুষই জানেন। প্রায় দিনই আমি নক করি। বুকে জমা যতো প্রশ্ন সবগুলোর কপাট মেলে দেই। এটা কী, ওটা কী- সব। শীতলদাও ধৈর্য ধরে উত্তর দেন। এতো কথা আমি মাধবকেও বলতে চাই তবে পারি না, ঝড়ো হাওয়ার দাপটে আটকে যায়। মেঘ জমে বর্ষণ হয় না, কথা জমে, বলে ওঠা হয় না। শীতলদা একটা মুক্ত আকাশ যেখানে দু’হাত মেলে ওড়ার স্বাদ পাওয়া যায়।

সেদিন ছিলো উষাদির গায়ে হলুদ। পরীক্ষা দিয়ে ওদের বাড়ি যেতে যেতেই রাত সাড়ে আটটা বাজলো। যথারীতি মাধবকে ফোনে পাওয়া যাচ্ছে না। সকাল থেকেই ডাইভার্ট দেখাচ্ছে। আমি জানি সে বাড়িতেই আছে। এও জানি, শীতলদাও আছেন। আমার বুক ধড়ফড় করছে, তা মাধবের ওপর রাগে নাকি শীতলদাকে দেখার উত্তেজনায় বুঝতে পারছি না। রাগ হলে আমি নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলি, হন্যে হয়ে মাধবকে খুঁজতে খুঁজতে ছাদে গেলাম। একগাদা বন্ধু-বান্ধবী নিয়ে মাধব মেতে আছে। ইচ্ছে হচ্ছে সব তছনছ করে ফেলি। সবার মাঝখান থেকে মাধবকে টেনে একপাশে নিয়ে এলাম, ফোন কী করেছো? ডাইভার্ট কেন?
-    এতে রেগে যাওয়ার কী আছে? থাকতেই পারে ডাইভার্ট।  
-    মানে কী? মাধব আমাকে বোধহয় তোমার আর প্রয়োজন নেই, মুক্তি দাও আমাকে।
-    সামান্য ফোন ডাইভার্ট পেয়েই উন্মাদ হয়ে গেছো? পাগলামি করো না, সবাই দেখছে।

সে আমাকে ধরে সবার সামনে নিয়ে গেলো। পরিচয় করিয়ে দিলো ছোট বোন মণীষার বান্ধবী হিসেবে। আমি কারও দিকে না তাকিয়ে ফিরে চলে আসতে আসতে শুনলাম নারীকণ্ঠে কেউ মাধবকে বললো, এতো ক্রেজি হয়ে আছে কেন মেয়েটা?
মাধব বললো, আমাকে ফোন করেছিলো। ধরিনি বলে।
-    মণীষার বান্ধবী তোমাকে কেন ফোন করবে? পছন্দ করে নাকি তোমাকে হুম?
-    হ্যাঁ, মনে হয়।  
-    তুমি করো?
-    আরে ধুর, মাথা খারাপ!

একথা মাধব বললো? মাধব? আর কোনো কথা নেই। কী লাভ এখানে থেকে। দরকার নেই, এ তো কোনো সম্পর্কই না। দ্রুতবেগে দৌড়ে মূল দরজা দিয়ে বের হয়ে যাচ্ছিলাম, শীতলদা ধরে ফেললেন, কি হয়েছে তোমার? এভাবে কোথায় যাচ্ছো। ঠিক আছো তুমি?
আমি ছাড়িয়ে নিয়ে বললাম, শীতলদা আমি যাবো। এখানে থাকার কোনো প্রশ্ন নেই।
- জ্বলছো কেন দূর্গা?
- শীতলদা, অনেককিছুই চোখে পড়েছে বহু আগে। আমিই দেখিনি ইচ্ছে করে। বুঝিনি ইচ্ছে করে। কেউ উপেক্ষা করছে মানতে পারবো না বলেই, নিজেকে শূন্যে দেখতে পারবো না বলেই এতোসব দেখিনি, শুনিনি। উপেক্ষা করেছি নিজেকে।
- এতো উত্তাপ তোমার, তাতে নিজেই জ্বলছো...

আমি চুপ হয়ে গেলাম। অনেকক্ষণ চুপচাপ সব। শীতলদাও চুপ হয়ে দাঁড়িয়ে।
-    চলো তোমায় বাড়ি পৌঁছে দেই।
-    আমি যেতে পারবো।
-    রাত হয়েছে, পারবে না। চলো।
-    রাত অনেক আগেই হয়েছে শীতলদা, ভোরের আলোও দেখেছি। আলোটা না হয় না-ই স্পর্শ করি।  
-    কী বললে বুঝিনি মেহরুন।
-    শীতলদা, আপনি বোঝেন, আপনি বুঝেছেন। আপনি সবকিছু আগে থেকেই টের পান আমি জানি।

আমার দিকে গভীর চোখদু’টো প্রসারিত করলেন তরুণ রবীন্দ্রনাথ। তার ঠোঁটে স্মিত হাসি নেই, জ্বলছে হীরের দু’টো চোখ। বললেন, সাবধানে বাড়ি যাও। আর গিয়ে আমাকে জানাও। চিন্তায় থাকবো।

অনুভূতিহীন শরীর-মন নিয়ে হাঁটছি, কোন পথে হাঁটছি জানি না। বাড়ি যাবো না। বাড়ি গেলেই চার দেয়াল আমাকে খেতে আসবে। ভালোই হলো, মাধব নেই। সে অধিকারের জোর গায়ে নিলেও সম্পর্কের তকমা গায়ে লাগাতেই চায়নি। কী দরকার অযথা সম্পর্ক বয়ে বেড়ানো, কষ্ট নেওয়ার আর দেওয়ার। এই তো বেশ। মোবাইল স্ক্রিনে রাত বারোটার বেশি বাজে। এতো রাতে মেহরুন ঘরের বাইরে ভাবাই যায় না! সিম কার্ডটা ভেঙে ফোনটা ছুঁড়ে ফেললাম পথের ধারের শ্যাওলা পড়া ডোবায়। সেখানে কতোক্ষণ বসে ছিলাম জানি না। কেন যেনো একবার মনে হলো মাধব কী আমায় খুঁজবে? ফোনে না পেয়ে আগামীকাল আবার বকবে আমাকে? ধুর মনের ভুল। এসব ভাববো কেন? সে আমার কেউ নয়, না আমি তার কেউ। ফের হাঁটা শুরু করলাম। হয়তো রাত প্রায় শেষ। বহুদিন পর বাড়ির গলিটা পার হতে ভয় লাগলো না। রোজকার মতো আজও শুনশান গলির মোড়। তুষার ছেলেটাও নেই। বুক ভরে নিঃশ্বাস নিতে পারছি। যেনো দুনিয়া পুরোটাই আমার নিজের বাড়ি। এরইমধ্যে খটাস খটাস জুতোর আওয়াজ দ্রুত বেগে এগিয়ে এলে যখনই পেছনে তাকাবো ওমনি ঘাড়ে প্রচণ্ড আঘাত লাগলো। ধারালো অস্ত্র যেনো ঘাড় থেকে মাথাটা খসিয়ে দিলো আমার। মুখ চেপে ধরে মুখে স্কচটেপ আটকে দিলো তারা। প্রাণপণে চিৎকার করছি, কিন্তু কেউ শুনছে না। কয়েকবার বোধহয় মাধবের নামও বলেছিলাম। ধপাধপ পিঠে আর কোমরেও পড়লো কয়েক কোপ। কিসের যেনো শব্দ পেয়ে দুই ঘাতক আমাকে টিনের বেড়ার পেছনে ফেলে চলে গেলো। আমার কাটা ঘাড়ে রক্তের গরম স্রোত বইছে। আমি মারা যাচ্ছি। হলদে ভোরে যখন শীতলদা আমায় নিতে এলেন মনে হলো আরেকবার বাঁচি। কিন্তু তা কী হয়? 

আমি শীতলদার বুকে গাল মিশিয়ে মরে গেলাম।  

বাংলাদেশ সময়: ১১০১ ঘণ্টা, মে ২৭, ২০১৬
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ