ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গল্প

কয়লা ‍| মাহফুজ পারভেজ

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৭ ঘণ্টা, মে ৯, ২০১৬
কয়লা ‍| মাহফুজ পারভেজ

তিনি আজকাল ভীষণ রাগ করেন। কারণে অকারণে।

চিৎকার চেঁচামেচিতে অন্যদের বুক কাঁপে ধরফর। বয়স চল্লিশের পর থেকেই তার এই পরিবর্তন শুরু হয়েছিল। দশ বছর ধরে তার স্ত্রী মোমেনা বেগম এসব দেখে দেখে ক্লান্ত। বিরক্ত। বিষন্ন। কিন্তু কোনো উপায় পাওয়া গেল না লোকটার মেজাজ ভালো করার। তবে সবসময় না। মাঝে মাঝে অসহ্য অবস্থা হয়ে যায়। আবার মাঝে মাঝে খুব শিশুর মতো আচরণ করেন। তখন মোমেনার মায়া হয়। কিন্তু বড় ছেলে মুখ উল্টে বলে-উ’হ। হাসলেই হলো? রাগ উঠলে তো আমরা সব কলাপাতা। ছিঁড়ে টুকরো করে। হাসবো না। মেয়েও মুখ গোমরা করে রাখে।

    বিশেষ এক জায়গায় চাকরি করতেন বলে ‘শ’ দিয়ে দুই অক্ষরের বকাটা তার বেশি পছন্দের অথবা মুখে এসে যায়। কিছুতেই নিজেকে আটকাতে পারেন না। আটকাতে চানওনি।

চেঁচামেচি করে সারা বাড়ি মাথায় তুলেন। কাজের ছেলে, স্ত্রী, ছেলে মেয়ে সবাই এলো কাছে ভয়ে ভয়ে। হাত পা ছুঁড়ে বলেন- হেশ শশ্-এইশ্ শীল পাটা আন। ছেলেমেয়ে কপালে চোখে তুলে দূরে পালায়। স্ত্রী বলেন, কি বলছো?
: ইস! বুঝে না। শ্ শ্ শ্ সিরাজ উদদৌলার আপন বোন।
: আরে বলবে তো কী লাগবে?

কাজের ছেলে দৌড়ে শিল-পাটা নিয়ে এলো রান্নাঘর থেকে। তখন মফিদুর ওকে মারতে যান। এই শ-শ-শ শালিমার বাগ এইটা দিয়ে কি পেপার পড়ে? এই বার স্ত্রী তাড়তাড়ি গিয়ে চশমা খুঁজে আনেন। কাজের ছেলেকে  ইশারা করে দূরে সরান। মফিদুর হেসে বলেন, হে হে হে তুমি তো সত্যি সত্যিই শ্ শ্ শ্ সোনার খনি গো। মুখ কালো করে তিনি পত্রিকাটা এগিয়ে দিয়ে রান্নঘরে যান। কাজের ছেলে একবার  হাসে। একবার মন খারাপ করে। তারপর কথা বলে, নানি, আমি কইলাম পলাইয়া যামু। শ্ শ্ শ শইল্যে আর সয় না। শ্ শ্ শ্ শ শইলডা কুত্তায় কামড়ায়।

: বুড়ো মানুষটাকে অসহায় করে কোথায় যাবি? একটু দম নিয়ে বলেন- যা। বাজারে যা। উনি যা যা পছন্দ করেন সে সব বুঝে কিনে নিয়ে আয়।
: খালি আফনের লাইগা। না অইলে কবে ভাগতাম। বলে বাজারের ব্যাগ হাতে নিয়ে বিড় বিড় করে শ্ শ্ শ্ শইল মাছ আনুম। শ্ শ্ শ্ শশা, শালুক না না –শিম বলতে বলতে যেতে থাকে। ঘর থেকে বের হতেই মফিদুর ডেকে তাকে জিজ্ঞেস করেন, এই এদিকে আয়। কাছে যেতেই বলেন- আজ কী বার রে? কাজের ছেলে ময়না মাথা নিচু করে হাঁটতে হাঁটতে জবাব দেয়- আমাগো প্রত্যেক দিনই হে শ্ শ্ শ্ শনিবার। এটা শুনে মফিদুর কিছু না বলে আবার পেপার নিয়ে চেয়ারে বসেন গিয়ে।
 
রিটায়ার করার পর থেকে নিজের আচরণ বদলাতে চেষ্টা করছেন। নাহলে ছেলে-মেয়ে এবং  স্ত্রী তাকে সহ্য করছেন না আগের মতো। তারও মনে হয় একটু বদলানো দরকার। কিন্তু প্রায়ই পারেন না। যেমন স্ত্রী আজ ছেলের বিদেশ যাবার ব্যাপারে টাকা পয়সার কথা তুলতেই তিনি বলেন- শ্ শ্ শ্- পরে সামলে বলেন শ্যামলী বেগম আমি কি এত টাকার মালিক?
: আমি শ্যামলী বেগম নই। শ্যামলী ছিল তোমার অফিসের সুন্দরী পিএস।
: আচ্ছা নাহয় তুমি শায়লা বেগম। তাতে কী? তাতে কী? আমার টাকা দিতে হবে? খেয়ে পরে বাঁচার বাইরে আমার টাকা কই?
 
    মোমেনা বেগম মুখ অন্যদিকে  ফেরান। মফিদুর রহমান আবার কথা বলেন, শ্ শ্ শ্ শেয়ালের বাচ্চাকে বলো দেশেই লেখাপড়া করে চাকরি করুক। আমার পক্ষে এর বেশি বলা বা করা সম্ভব না। শ্‌ শ্‌ শ্‌ শীত লাগছে। ফ্যান ছাড়ো। দ্রুত হাঁটাহাঁটি করেন ঘরে।
: এই ভরা চৈত্রে শীত? মাথা ঠিক আছে তো? উঠে ফ্যান ছাড়লেন।
: রাগের সময় স্বাধীনভাবে না বকতে পারলে এমনি হয় গো শায়রা বানু। তোমরা রাগ করবে বলে নিজের রাগ নিজের ভেতর মজাই। পচাই। তাই শ-তে অন্য কথা আসে। তোমরা খুশি থাক। বলি না। বলতে পারি না। বুড়ো হলে মানুষের দাম থাকে না।
: ইস! চেষ্টার কি বাহার? বলে চলে গেলেন নিজের কাজে।

     ছেলের যখন চাকরি হলো। বেতন পেয়ে বিরাট ব্যাগ ভর্তি মিষ্টি আর ফুল কিনে বাড়ি ফিরে। এর মধ্যে বাবার সাথে দূরত্ব অনেক পাকাপোক্ত হয়েছে। তবুও বাবাকে মাকে ডেকে একত্র করে। বাবা আনন্দে শিশুর মতো বলেন- শ্‌ শ্‌ শ্‌- শেমাই রান্না করলেও হতো। এত্তগুলি টাকা খরচ করলি কেন বাপ? আচ্ছা দে দে খাই। বলেই গপাগপ দুটো মিষ্টি খেলেন। ছেলের চোখ আনন্দে ভিজে গেল।

    বাবার মুড বুঝে একদিন মেয়ে বললো, বাবা, আমার ভার্সিটির বন্ধুরা একটা সম্মেলনে যাবে। আমিও যেতে চাই। দেশের বাইরে। আমাকে কিন্তু টাকা দিতে হবে। বাবা মুখে কটমট করে বললেন, শ্ শ্ শ্-শান্তি আর পেলাম না। তোমার বাবার এত টাকা আছে? কি যা তা প্ল্যান করে বাড়ি আসো? ওই শ্ শ্ শ্-ইয়ে মানে শকুনগুলির সাথে মিশবে না।

    মেয়ে মন খারাপ করে ঘর ছেড়ে যাবার পর মোমেনা বেগম ঘরে আসেন। কিছু বলেন না। নিজের মত ঘরের জিনিসপত্র গুছাতে থাকেন। একা একা বিড় বিড় করেন। তখন মফিদুর রহমান ডাকেন। এইখানে বস তো। মোমেনা বেগম কাছে গিয়ে চেয়ার টেনে বসেন। নরম গলায় মফিদুর বলেন, কি করা যায় বলতো?
: কিসের কি করা যায়? স্বভাবটা ভালো কর। ‘‘শ”-এর ব্যবহার ছাড়ো।
:হাহাহা। ছাড়তে চাই বলেই তো কত নতুন শব্দ বলি। বুঝ না কিছু? শ্ শ্ শ্- শীলারে কিছু টাকা কিভাবে দেওয়া যায় ব্যবস্থা কর তো।
: শীলা? শীলা কে?
: আরে শ্‌ শ্‌ শ্‌ শান্তি রে! আমাদের মেয়ে। ওকে বিদেশে যাওয়ার টাকা দাও। যাও। বাড়তি ব্যাখ্যা ভালো লাগে না। নিজেকে ভাঙতে ভাঙতে আর পারি না।

    কিছুদিনের মধ্যেই বাড়িটাতে অনেক পরিবর্তন আসে। ছেলে চাকরিসূত্রে অন্য শহরে থাকে। বাড়িতে খুব কম আসে। মেয়ের বিয়ে হয়েছে। স্ত্রী চলে গেছেন চিরকালের ওপারে। কাজের ছেলেটাকে নিয়ে মফিদুল দিন কাটান। সে-ও মফিদুলের মেজাজে অতিষ্ঠ। মেহমান এসেছে বলতেই তিনি খেঁকিয়ে ওঠেন- শ্ শ্ শ্- শিথানে নিয়ে শুয়ে থাকব নাকি? মেহমান এসেছে বসতে দে। চা-নাস্তা দে।
: ঘরে চা পাতা নাই।
: শ্ শ্ শ্ ওই শালিকের বাচ্চা শুধু পানি খেতে দে। যাহ্।

    এক  গ্লাস পানি দিয়ে কাজের ছেলে পলাতক। দু তিন খোঁজ নেই। ফোনও ধরছে না। মফিদুর অস্থির। ছেলে মেয়ে আত্মীয় স্বজন সবাইকে অস্থির করে তুলেছেন। কিন্তু কারো পক্ষেই এসে তার কাছে থাকা সম্ভব না। সপ্তম দিনে কাজের ছেলে ফোন ধরে বলে, বুইড়া মানুষের লগে থাকন এমনেই কষ্টের। তার উরপে ধরেন গিয়া এত বকা বাইদ্য শুনন সম্ভব না। আমি সইজ্য করতে পারতাছি না। আমি আর আসুম না। আমারে মাফ দেন। বলেই ফোন কেটে দেয়। আবার ফোন। এবার কাজের ছেলে বলে, নানা, এত যুদি ফুনে বিরক্ত করেন তাইলে কিন্তু সিম পালডাইয়া ফালামু। আমারে আর ডাইকেন না। আমার ফাইনাল কতা। আমি আপনের কাছে আর আসুমনা। ফোন কেটে দেয়। কদিন পর আবার ফোন করলেন, তোর বেতন নিয়ে যা।
: আসনের সময় আপনের এক সেট জামা কাপড় আর গড়িডা নিয়া আসছি। বেতন লাগবো না। তবু মুন চাইলে এই নম্বরে ফ্লেগ্জি কইরা দেন। রাখি। আর ডিস্টার্ব দিয়েন না।
: আমার জামা কাপড় দিয়ে তোর কি হবে?
: আরে মরার যন্ত্রণা। আমার লাইগ্যা আনছি নাকি? আমার আব্বারে দিছি। হে-ও তো বুইড়া অইছে। আইচ্ছা রাখি। বলে ফোন কেটে দেয়। আর মফিদুর ফোন করেননি। মনে কষ্ট হলো খুব । এত বড় চাকরি করতেন। কত অর্ডারে কত লোক চালিয়েছেন। আর আজ। থাক সে সব দিনের কথা।

    একা একা কদিন রান্না করেন নি। কিনে খেয়েছেন। কাজের ছেলেটা ফিরে আসবে ভেবেছেন। বহু বছরের মায়ায় আটকে ছিলেন। আজ কষ্ট নিয়ে রান্না করতে গেলেন। কিছুই নেই তেল-মসলা-চাল। মনে মনে বকলেন- হেশ্ শ্ শ্-শয়তান। সব নিয়ে গেছে নাকি? আজ না হয় বাজার করে আনবেন। তারপর কাল থেকে রান্না। মনে মনে বলেন, আরে বউ রে অসহায় কইরা কই পালাইলি রে?

    খালি ঘরে খুব কান্না পেল আজ। কিন্তু চোখে পানি আসছে না। গান গাইতে ইচ্ছে করলো- নিজেই মনগড়া সুরে গাইতে লাগলেন-
ও আমার কেউ নাই রে
একা আসছি ভবে আবার একা চলে যাই রে
একা থাকি একা বাঁচি
কত নাম ধরে ডাকি চেয়ে  দেখি কেউ নাই রে।
একা একা বাজার করে আনেন। ডিম ভাজা করে ভাত খান। মনে মনে ভাবেন আর রাগ করবেন না। একটা কাগজে লিখলেন।
রাগ করা ছাড়িলাম
গালাগাল বাদ দিলাম
সকলি হারইলাম।
এতদিনে বুঝিলাম।
মাথার পাশে রেখে বই পড়তে পড়তে ঘুমালেন। কলিং বেল শুনে উঠতে গিয়ে পড়ে গেলেন। রাগে বলেন- হে শ্‌ শ্‌ শ্‌ শত্রু সব। নিজে নিজে হাসেন। নাহ্-বদলনো আর গেল না। নিজেকে। আর তাজমহল বানিয়ে দিলেও কোনো শশশ শাহজাদী আমাকে বিশ্বেস করবে না। ভালোও বাসবে না। কোথায় সেই সব দিন? সুন্দরীদের দেখে মোমের মতো গলে যেত মন। তাদের গদ গদ মাখানি কথায় কত লোকের কত ক্ষতি করেছি। অপমান করেছি। আজ সেই সব শ্ শ্ শ্ শ্যালিকারা খোঁজও নেয় না। সব শিকারি বেগম। শেকড় উপড়ানোর ওস্তাদ। চারিদিকে তাকিয়ে বলেন- আর কাকে বকবো? নিজেকেই বকি। আমি এক বোকা শ্ শ্ শ্ শাহজাহান। সব গেল রে সব গেল। তবু— আবার কলিং বেল। ইস জীবনডা শ্ শ্ শ্ শিক কাবাব করে দিল। যত্তো সব।

আস্তে আস্তে উঠে দরজা খুলেন। ছেলেকে দেখে খুব অবাক হলেন। অনেকক্ষণ তাকিয়ে থাকেন।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, মে ০৯, ২০১৬
এমজেএফ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

গল্প এর সর্বশেষ