ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

গ্রিক পুরাণের ‘অ্যাটলাস’, কাঁধে পৃথিবীর বোঝা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৭
গ্রিক পুরাণের ‘অ্যাটলাস’, কাঁধে পৃথিবীর বোঝা মানচিত্রের গল্প

একাদশ অধ্যায়
গেরারডুস মার্কেটার-এর এই আদি মানচিত্র প্রকাশের এক বছর পরে তার এক প্রতিযোগী প্রকাশ করেন তিরিশটি বিভিন্ন মানচিত্রের একটি সঙ্কলন। এটির প্রথম সংস্করণ প্রকাশিত হয় ১৫৭০ সালে। কাটতির কারণে মাত্র তিন মাসের মধ্যে বের করতে হয় দ্বিতীয় সংস্করণ। ক্রমে ক্রমে চল্লিশ সংস্করণ। বলা হয় এটিই প্রথম যথার্থ মানচিত্র-সঙ্কলন।

তবে এটি ইউরোপের জন্য। কারণ এরও ১৮০০ বছর আগে ‘চিনের টলেমি’ নামে খ্যাত পেই ঝু আঠারোটি মানচিত্রের ঠিক এমনই একটি সঙ্কলন তৈরি ও প্রকাশ করেছিলেন।

সেটি ইতিহাস থেকে অজ্ঞাত কারণে হারিয়ে গেছে। তবে ভূমিকা লেখা পৃষ্ঠাগুলো এখনও রয়ে গেছে জাদুঘরের প্রযত্নে। জানা গেছে, দশম শতকের পর চিনে এ ধরনের সঙ্কলন-মানচিত্রবিদ্যার বিশেষ গুরুত্ব পরিলক্ষিত হয়। এক্ষেত্রে অবশ্য মার্কেটার-এর অন্য রকমের কৃতিত্ব রয়েছে। তিনি কাঠ খোদাইয়ের বদলে সব মানচিত্রই ছাপাতেন তামার এনগ্রেভিংয়ে। মার্কেটার-এর মানচিত্র সঙ্কলনটি তিন খণ্ডে ছিল। প্রথম দুটি খণ্ড প্রকাশিত হয় ১৫৮৫ এবং ১৫৯০ সালে। তৃতীয় বা শেষটি তার মৃত্যুর এর বছর পরে ১৫৯৫ সালে।

সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ হলো আজও যে আমরা মানচিত্র-সঙ্কলনকে অ্যাটলাস বলি, তা কিন্তু মার্কেটার-এর সুবাদেই। তার প্রতিযোগীর যে সঙ্কলনটির কথা উল্লেখ করা হয়েছে, সেটির নাম ছিল ‘থিয়েট্রাম ওরবিস টেরারাম’। যার বাংলা করলে দাঁড়ায় ‘বিশ্বের মঞ্চ’। মার্কেটার তার সঙ্কলনের নাম দিয়েছিলেন, ‘অ্যাটলাস’: গ্রিক পুরাণের সেই বীর, যার কাঁধে পৃথিবীর বোঝা, তিনি পরিণত হলেন পৃথিবীর চিত্রাবলির ধারকে এবং চিত্রিত হলেন আধুনিক মানচিত্রের প্রচ্ছদে।

পৃথিবীর মানচিত্রের সূত্রে ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশের মানচিত্র-চর্চার প্রসঙ্গ অনুল্লেখিত থাকাটা সমীচীন হবে না। মুঘলরা সূক্ষ্ম চিত্রকর্মে বিশ্বসেরা ছিলেন, একথা সবারই জানা। তাদের ‘মিনিয়েচার আর্ট’ জগতের বিস্ময়। মুঘল নৃপতিগণ, বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাজাহান, আওরঙ্গজেব, সকলেই ইতিহাস-ভূগোল-দর্শন-ধর্ম ইত্যাদি জ্ঞানের ভাণ্ডার ছিলেন। তাদের মহান আত্মজীবনী/জীবনী সেসবের প্রমাণবহ। সমগ্র ভারতবর্ষের ভূগোল ও প্রকৃতি তাদের আগ্রহ লাভ করেছিল।

তবে আধুনিক মানচিত্রের ব্যকরণসিদ্ধ বিকাশ ঔপনিবেশিক ইংরেজ আমলের একেবারে গোড়ার দিকেই সম্পন্ন হয়েছিল। ‘সার্ভে অব ইন্ডিয়া’-এর প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন জেমস রেনেল নামে একজন ইংরেজ  নৌ-সৈনিক। ১৭৬৫ সালে পলাশী-উত্তর কালে কোম্পানির অধীনস্থ বাংলার তদানীন্তন গর্ভনর রবার্ট ক্লাইভ তাকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন বাংলা মুলুকের একটি মানচিত্র তৈরি করতে।  

নৌ-সেনা হলেও রেনেল জরিপের কাজে অভিজ্ঞ ছিলেন। সাত বছর ধরে তিনি সদলবলে ঘুরে ঘুরে জরিপ করলেন তৎকালের বিশাল বাংলা, যাকে আমরা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা সমেত অখণ্ড বাংলা বলে জানি। পূর্ববঙ্গের প্রান্তদেশ এবং সুন্দরবনের অভ্যন্তর ভাগও তার জরিপ থেকে বাদ পড়ে নি। রেনেল মনে করতেন, ‘মানচিত্রে শূন্যস্থান চোখে বড়ই পীড়াদায়ক। ’ স্বভাবতই তার সেই বিস্তারিত অনুসন্ধানে ফাঁক বা ফাঁকি কোনোটিই ছিল না। কিন্তু ঝুঁকি ছিল প্রচুর। তার দল একবার বাঘের মুখেও পড়েছিল। বাঘ একজন জরিপ-সদস্যকে তুলে নিয়েও যায়। আরেক বার চিতাবাঘের সঙ্গে সরাসরি লড়াই করতে হয় খোদ রেনেলকেই। তৃতীয় বিপর্যয় ছিল দুর্দান্ত ডাকাত দলের কবলে পড়ার ঘটনা। তাদের আক্রমণে রেনেল ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলেন।

ক্লাইভ স্বদেশে পাঠানো প্রতিবেদনে বলেছিলেন, ‘রেনেলের দেহ আক্রান্ত। ’ পূর্ণ বিবরণে জানা যায়, রেনেল তখন পূর্ববঙ্গে বা আজকের বাংলাদেশে। প্রত্যন্ত এলাকায় মানচিত্রের কাজে নিয়োজিত অবস্থায় আহত রেনেলকে চিকিৎসার জন্য বহন করে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে তখন ঔপন্যাসিক থ্যাকারের পিতামহ বিখ্যাত ‘সিলেট থ্যাকারে’ ছিলেন। তার কন্যা জেনেট সেবাশুশ্রূষা করে রেনেলকে বাঁচিয়ে তোলেন। তখনই দুইজনের মধ্যে গভীর ভালোবাসা জন্মায় এবং কলকাতায় অচিরেই তাদের বিয়ে হয়। মানচিত্র প্রণয়নের কাজে লিপ্ত হয়ে প্রেম-প্রণয়-বিয়ের ঘটনাও অকিঞ্চিৎ নয়।

পূর্ববর্তী পর্ব
ফ্ল্যান্ডার্স শহরের গেরারডুস মার্কেটার
পরবর্তী পর্ব
রেনেলের ’বেঙ্গল অ্যাটলাস’

বাংলাদেশ সময়: ২০৫৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৭
এমপি/জেএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।