ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

মানচিত্র নিয়ে পাগলামি-খেয়ালি চিন্তা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮০৪ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৭
মানচিত্র নিয়ে পাগলামি-খেয়ালি চিন্তা মানচিত্রের গল্প।

চতুর্থ অধ্যায়
আসলে খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে তৎকালের সর্বজ্ঞানী গ্রিকদেরও পৃথিবী সম্পর্কে ধারণা ছিল খুবই সীমাবদ্ধ। তার চেয়েও বড় কথা, মানচিত্রের সঙ্গে বাস্তবের অনুপাত বা দূরত্ব পরিমাপের জন্য ‘স্কেল’ ব্যবহারও ছিল তাদের অজানা। তবে হেরোডোটাস-এর নিজের লেখালেখি থেকেও বোঝা যায়, মানচিত্র তৈরির বিদ্যা ধীরে ধীরে গ্রিকদের মধ্যে দানা বাঁধছিল। মানচিত্র বিভাজন, সমান্তরাল রেখার চিন্তা ছাড়া পথের মানচিত্র রচনাইবা কেমন করে সম্ভব, জানতো না গ্রিকরা।

 

খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে অ্যারিস্টোফোনিস-এর দ্য ক্লাইড নামের একটি কমেডি বা প্রহসন নাটকে দেখা যায়: “একটি অদ্ভুত-দর্শন যন্ত্র মঞ্চে হাজির করা হয়েছে। একটি চরিত্র জিজ্ঞাসা করে, এটি কি জমি মাপবার যন্ত্র? যাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছে, তিনি উত্তর দেন, তুমি কি জমি বিতরণের কথা বলছ? তা কিন্তু চাইনিজ গ্লোব, ১৬২৩নয়, এটা গোটা পৃথিবী মাপার যন্ত্র।

অন্যজন তখন বলে ওঠে, দেখছ না গোটা দুনিয়াটাই রয়েছে এর পরিসীমার মধ্যে। এই তো এখানে আমাদের রাজধানী এথেন্স!” এ রকমের হাতুড়ে-জ্ঞান প্রসার পেয়েছিল প্রাচীন ও বিদগ্ধ গ্রিসে, মানচিত্র প্রসঙ্গে, পৃথিবী সম্পর্কে।

সমস্যা হবেই না কেন! ইচ্ছা করলেই মানচিত্রে গোটা পৃথিবীকে সঠিক ও যথাযথভাবে উপস্থাপিত করা যায় না। প্রাচীন পণ্ডিত বোর্হেস এমনই আজব এক মানচিত্রের কল্পনা করেছিলেন, ‘যা হবে সাম্রাজ্যের আয়তনের সমান’। অর্থাৎ স্কেল ১:১। এমন পাগলামি আর খেয়ালি চিন্তা একটি নয়, মানচিত্র রচনার ইতিহাসে অনেক বারই লক্ষ্য করা গিয়েছে।

লুইস ক্যারল-এর কাহিনীতেও এমন স্বপ্নকথা রয়েছে। স্বপ্ন সফলও হল। দেশের এমন একটি মানচিত্র তৈরি করা হল যাতে মানচিত্রের ১ মাইল= দেশের ১ মাইল! কিন্তু সেই মানচিত্র আর খোলা সম্ভব হল না। কারণ চাষিদের আপত্তি। গোটা দেশ যদি ঢেকে দেওয়া হয় মানচিত্রে তাহলে সূর্যের আলো পৌঁছাবে কেমন করে চাষের জমিতে?  শেষ পর্যন্ত বানাতে হল সংকুচিত মানচিত্র। সুতরাং সূচনা হল ছোট মানচিত্র রচনার ধারা এবং সব মানচিত্রই গ্রহণ করল সংকোচনের প্রবণতা; বাস্তবের সঙ্গে তার আকার ও প্রকারের পার্থক্য সুনিশ্চিত।

আসলেই, বাস্তবের এক টুকরো কাগজ বা ধাতুতে পৃথিবীর মানচিত্র আঁকা অত সোজা ব্যাপার নয়। পৃথিবীর মানচিত্র আঁকতে হলে প্রথমে জানা চাই পৃথিবীর আকার, আয়তন, প্রকৃতি ও পরিমাণ। আর সেসব তথ্য ঠিক ঠিক ভাবে জানতে হলে প্রয়োজন দুটি বিষয়: ১. কল্পনা ও উপকথার জগৎ থেকে বেরিয়ে আসা এবং ২. বাস্তব কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করা।

ওয়ার্ল্ড জিমুলার ম্যাপ, ১৫০৭আজ অবশ্য মানুষ চাঁদ কিংবা মহাকাশ থেকে তোলা পৃথিবী নামক গোলকটির ছবি দেখে অভ্যস্ত। কিন্তু একটি সময় ছিল, পৃথিবীতে বাস করে পৃথিবী সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা গড়ে তোলা ছিল মানুষের কাছে দুঃসাধ্য। পৃথিবীকে কেউ তখন পুরোপুরি বা সম্পূর্ণ ভাবে দেখে নি। তখন প্রায়-সবই ছিল কল্পনা-নির্ভর; রূপকথা-উপকথার জন্ম এই পটভূমিতেই।

অনেকের ধারণা ছিল পৃথিবী সমতল। গত শতকের ষাটের দশকেও শোনা গেছে, ব্রিটেনে এই অতি-আধুনিক যুগেও রয়েছে ‘ফ্ল্যাট আর্থ সোসাইটি’ নামে একটি ছোট্ট বিদ্বৎসভা। এর সদস্যরা তখনও বিশ্বাস করতেন যে, পৃথিবী আসলে তাদের সামনে যে টেবিলটি রয়েছে, তার মতই সমতল!

মহাকবি হোমারও ভাবতেন, পৃথিবী সমতল একটি ‘ডিম্ব’ বা ‘থালার মত’, তার চারদিকে জল, যকে বলা যায় চিরন্তন সমুদ্র। আর পৃথিবীর কানার উপর রয়েছে বিশাল এক ‘গম্বুজ’। সেটি ধারণ করে রয়েছেন পৌরাণিক চরিত্র বলশালী ‘অ্যাটলাস’। তা ছাড়া পৃথিবীর ভার বহনের জন্য ‘স্তম্ভ’ও রয়েছে অনেকগুলো। সব মিলিয়ে একটি উপুড় করা অর্ধগোলকের কল্পনার বাইরে পৃথিবী বলতে আর কিছুরই অস্তিত্ব ছিল না। প্রতিদিন মহাসমুদ্র থেকে সূর্য উঠছে, প্রতিরাতে তার ঢেউয়ের নীচে ডুবে যাচ্ছে। চাঁদ এবং অন্যান্য নক্ষত্ররা প্রতিরাত্রে একদিক থেকে অন্যদিকে চলে যাচ্ছে! ফলে সবাই ভেবেছে, পৃথিবী উপুড় করা অর্ধগোলক!

১৭৪১ সালে আঁকা প্রাচীন গ্রিসের মানচিত্র। বিশ্ব বা ‘ইউনিভার্স’কে গ্রিক ভাষায় বলা হয় ‘কসমস’, যার অর্থ সুশৃঙ্খল। প্রাচীন মেসোপোটেমিয়ার লোকেরাও চন্দ্র-সূর্য-নক্ষত্রের উদয়-অস্ত দেখে বুঝে নিয়েছিলেন এর মধ্যে একটা বিশেষ ভারসাম্য ও ছন্দ আছে; আছে প্রবল শৃঙ্খলা। আরো গভীরভাবে ভাবতে ভাবতে মানুষের মধ্যে সময়ের একটি ধারণা জন্মায়, মানুষের চোখে ও চেতনায় ঋতুচক্র ধরা পড়ে। বলতে গেলে জ্যোতির্বিজ্ঞানের সেটাই সূচনা।

পরবর্তী পর্ব
গোলাকার-অধরা পৃথিবীও পরিমাপযোগ্য

পূর্ববর্তী পর্ব
ব্যাবিলনে মাটির ফলকের মানচিত্র

বাংলাদেশ সময়: ১৩৫৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৮, ২০১৭
এমপি/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।