ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

তবুও ‘যুদ্ধাহত’ নন ফেরিওয়ালা অমূল্য!

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫২৯ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬
তবুও ‘যুদ্ধাহত’ নন ফেরিওয়ালা অমূল্য! ছবি: বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন/ বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

সকালের আলো ঝিলিক দেয় ভাঙাঘরের ছিদ্র দিয়ে। নানা আবর্জনায় পরিপূর্ণ ছোট ঘরটা। ছিদ্র হয়ে যাওয়া টিন, ভাঙা বেড়া, দুর্বল চৌকাঠ আর নড়বড়ে দরজা- এগুলো নিয়েই কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে আছে ঘরটি।

শ্রীমঙ্গল (মৌলভীবাজার): সকালের আলো ঝিলিক দেয় ভাঙাঘরের ছিদ্র দিয়ে। নানা আবর্জনায় পরিপূর্ণ ছোট ঘরটা।

ছিদ্র হয়ে যাওয়া টিন, ভাঙা বেড়া, দুর্বল চৌকাঠ আর নড়বড়ে দরজা- এগুলো নিয়েই কোনোক্রমে দাঁড়িয়ে আছে ঘরটি। তার একটি কোণে ক্লান্তি কাটানোর বিছানাটি যে আছে ভালো করে না দেখলে তাও বোঝার উপায় নেই। এ সবের  মাঝেই গ্রীষ্ম-বর্ষা-শীতের প্রতিটি রাত কেটে যায় তার।

সকাল ছয়টায় ছোট-খাটো নানান পসরা নিয়ে বেরিয়ে পড়া দৈনিক নামমাত্র রোজগারের তাগিদে। চলতি পথে মুখন্ত মুখগুলোর হাসি প্রিয়জনহারা বুকের বেদনাটুকুকে কিছুটা ম্লান করে দেয়। কিছুটা ঝংকার তোলে আনন্দের। শরীরে একাত্তারের রক্তাক্ত যুদ্ধের যন্ত্রণাদায়ক ক্ষত; তবু আজও ‘যুদ্ধাহত’ তালিকায় নাম তুলতে পারেননি তিনি।

প্রতিদিন কাঁধে করে ভ্রাম্যমাণ দোকান দিয়ে ঘুরে বেড়ানো এই ফেরিওয়ালা মুক্তিযোদ্ধার নাম অমূল্য দেবনাথ। যার গেজেট নং ১৮৩৬। মুক্তিবার্তা নং ০৫০৪০২০০৯৬। গেরিলা যোদ্ধা (এফ এফ) নং ৯৯১৪। জীবনযুদ্ধের দুঃসহ গ্লানি আর দরিদ্রতা যার সর্বাঙ্গে।

শ্রীমঙ্গল উপজেলার বিশজন ‘যুদ্ধাহত’ কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধার নাম নিয়ে রয়েছে নানান গুঞ্জন-বিতর্ক। এই বিশজনের চলমান নৌকায়ও একটুখানি ঠাঁই হয়নি অমূল্য’র। সেই বিশজনের মধ্যে কারও বিরুদ্ধে রয়েছে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার অভিযোগ, কারও বিরুদ্ধে অবৈধ উৎকোচের মাধ্যমে নিজের নাম তালিকাভুক্ত করার অভিযোগ, কারও বিরুদ্ধে ডাক্তারি সনদে জাল সই বসিয়ে যুদ্ধাহত হয়ে যাওয়ার অভিযোগ, আবার কারও বিরুদ্ধে সরাসরি রাজাকারের অভিযোগও রয়েছে। বিশজন ‘যুদ্ধাহত’ মুক্তিযোদ্ধার মধ্যে ছয়জন বর্তমানে মৃত।  

পায়ের ক্ষত দেখাচ্ছেন অমূল্যমঙ্গলবার (১৩ ডিসেম্বর) থেকে বৃহস্পতিবার (১৫ ডিসেম্বর) উপজেলার বিভিন্ন মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে কথা বলে ‘যুদ্ধাহত’ মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে নানান চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া যায়। তবে সবাই এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন একাত্তরে অমূল্য দেবনাথের শারীরিক এ ক্ষতচিহ্নের কথা। ‘যুদ্ধাহত’ তালিকায় তার নাম অন্তর্ভুক্ত না হওয়ার বিষয়ে তারা সবাই কম-বেশি সমব্যথী।

শরীরজুড়ে একাত্তরের দুর্বিসহ ক্ষত, তবুও ‘যুদ্ধাহত’ তালিকায় নাম ওঠেনি অমূল্য দেবনাথের – এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ‘যুদ্ধাহত’ বিষয়টি নিয়ে বাংলানিউজের পক্ষ থেকে সরেজমিন অনুসন্ধান চালানো হয়। ফেরিওয়ালা অমূল্যকে অনেক খোঁজাখুঁজির পর তার বাড়িতে না পেয়ে খুঁজে পাওয়া যায় কালিঘাট চা বাগানের ১০ নম্বর শ্রমিক লাইনে।

অধিকাংশই মানুষই যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অমূল্য দেবনাথকে একজন উদাসী ‘ফেরিওয়ালা’ হিসেবেই জানেন। প্রতিদিন ফেরি নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে পৌঁছে নিজের স্বার্থক ‘মুক্তিযোদ্ধা’ শব্দটি নামের আগে ব্যবহার করতে পারেননি।

বাংলানিউজকে অমূল্য দেবনাথ বলেন, ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে শ্রীমঙ্গলের আশিদ্রোন ইউনিয়নের ভুজপুর এলাকাটি তখন রুহুল আমিন রাজাকারের দখলে ছিল। এই এলাকাকে রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যমুক্ত করতে আমরা সকাল ৮টায় ভয়াবহ যুদ্ধে নামি। আমার বাম পায়ে তখন গুলি এসে লাগে। আমার সঙ্গে তখন আহত হন আব্দুল রশিদ নামের আরেক মুক্তিযোদ্ধা।

আসাম প্রদেশের কাচার জেলার লোহারবন প্রশিক্ষণ শিবিরে আমরা গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন অমূল্য। পহেলা ডিসেম্বর থেকে দু’সপ্তাহ পর্যন্ত রশিদপুর পাহাড়ের উপর আত্মগোপন করে গেরিলা যুদ্ধে অংশ নেন।

আক্ষেপের সঙ্গে তিনি বলেন, আমি টাকা-পয়সা দিতে পারিনি, তাই যুদ্ধাহত হিসেবে নামও তুলতে পারিনি। আমার কোনো নিজস্ব জায়গা-জমিও নেই। অন্যের জমিতে এই ভাঙাঘরে একাই থাকি। প্রতিদিন বেচা-বিক্রি করতে কাকডাকা ভোরে বের হয়ে যাই। আশে-পাশের গ্রামে গ্রামে ঘুরি। আবার সন্ধ্যায় ফিরে আসি।

উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার কুমুদ রঞ্জন দেব বাংলানিউজকে বলেন, অমূল্য আমার সঙ্গের একজন মুক্তিযোদ্ধা। রশিদপুর চা বাগানের ডাক্তারকে দিয়ে গুরুতর আহত অমূল্য’র চিকিৎসা আমরা করিয়েছি। তার তখন বাঁচার কথাই ছিল না- এতো জখম ছিল।    

ব্যক্তিগত জীবনে ফেরিওয়ালা যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা অমূল্য দেবনাথ একছেলে ও একমেয়ের জনক। স্ত্রী ললিতা দেবনাথ মারা গেছেন বছর দশেক পূর্বে।  

বাংলাদেশ সময়: ১১২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬
বিবিবি/এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।