ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ফিচার

নদীর বুকে চর ও আমাদের অর্ধেক জীবন (ভিডিও)

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২, ২০১৬
নদীর বুকে চর ও আমাদের অর্ধেক জীবন (ভিডিও) ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

রবীন্দ্রনাথ ‘আমাদের ছোট নদী’ কবিতায় বৈশাখ মাসে বাংলার নদীর যে চিরন্তন রূপ বর্ণনা করেছেন সে রূপ এখন বাংলার প্রমত্ত পদ্মা, মেঘনা যমুনায়ও দেখা যায়না। দেশের ছোট ছোট নদীগুলোর অস্তিত্ব ইতিমধ্যে প্রায় বিলিন।

বৈশাখ মাসতো দূরের কথা, আষাঢ় মাসেও অনেক ছোট ছোট নদীতে হাটু জলও থাকেনা। বৈশাখতো বটেই পৌষ মাঘ মাসেও মেঘনা, যমুনা, তিস্তা যেন শুষ্ক মরুভূমি।



গ্রামে জন্ম ও শৈশব। সেখানে দেখেছি চর দখল করার জন্য বর্ষা-ঢাল নিয়ে রক্তারক্তি। চরের বুকেই চলতো এ লড়াই। গ্রামসুদ্ধ লোক জড়িয়ে পড়তো এ মারামারিতে। আজ আর সে দিন নেই। নদীর বুকে চরের এতো আধিক্য-কার চর কে নেয়।



পদ্মার বুকে এখন বৈশাখ মাসে হাঁটুজলও জোটেনা। কখনো পা ভেজানোর জন্য হাঁটতে হয় অনেকটা পথ। যমুনা বুকেও একই চিত্র।

পদ্মা-মেঘনা যমুনার বুকে এখন ‘পার হয়ে যায় গরু, পার হয় গাড়ি’ দুই ধার উঁচু তার, পুরোটাই পাড়ি।


নদীর বুকে ভাসেনা সেই সব রঙ্গিন সাম্পান-নৌকা। এমনকি মাছ ধরার নৌকাও খুব বেশি চোখে পড়েনা। সবই যেন আশ্রয় নিয়েছে সোনালী অতীতের খাতায়-পাতায়।

শৈশবে যখন নৌপথে গ্রাম থেকে শহরে গিয়েছি, লঞ্চ বা ট্রলারের পেছনে দেখেছি শত শত শিকারি পাখির ছোটাছুটি। জলে বুকে ভেসে ওঠা মাছ ধরতেই তাদের এ ছুটে চলা। বহুদূর পর্যন্ত উড়ে যেতো পাখির দল। প্রয়োজন মিটলেই একটা দুইটা মাছ নিয়ে ঘরে ফিরে যেতো সেই সব পাখিরা। আসতো নতুন পাখি। তারাও চলে যেতো। কোথায় গেল সেই সব পাখিরা আজ?



গত ক’দিনে মোট চারবার ঢাকা-বরিশাল আসা-যাওয়া করেছি। গ্রীনলাইন দিনের বেলা লঞ্চ সার্ভিস চালু করেছে। ঢাকা-বরিশাল দিনের বেলা নৌপথে যাত্রার সুযোগ তিন দশক আগেই উঠে গেছে। তাই সূর্যের সাথে ঘরে ফেরার  লোভ সামলাতে পারিনি। রথ দেখা আর কলা বেচা –দু-ই হলো। নৌভ্রমনও হলো, ঘরে ফেরাও হলো।

কিন্তু নদীর সেই চিরচেনা রূপ আজ শুধুই অতীত। শুষ্ক মৌসুম, তাই স্রোত না থাকাই স্বাভাবিক। কিন্তু নদীর সেই চঞ্চলা রূপ আজ আর নেই। শুধু ক্ষণে কয়েকটি লঞ্চ, ট্রলার ও কার্গো ভেসেলই চোখে পড়লো। চারবারের যাওয়া-আসায় পাঁচটির বেশি পাখি আমার চোখে পড়েনি।



কোনো এক সন্ধ্যায় দেখলাম নি:সঙ্গ দুটি পাখি ঘরে ফিরছে। সারা দিনের শিকার-চেষ্টায় হয়তো তারা সফল নয় ব্যর্থ। কিন্তু এ ব্যর্থতা কি পাখির না আমাদের যার নদী বুকে চালিয়েছি দু:শাসন। জীবনের সমস্ত জঞ্জাল আমার নদীতে বিসর্জন দিয়ে আমরা এখন আত্মবিসর্জনের পথে। নদী দুষণ করে আমরা কেড়ে নিয়েছি নদীর প্রাণ। নির্বিচার মৎস্য ও জলসম্পদ আহরণের ফলে নদী আজ নিস্ব ও নি:সঙ্গ।   



নদীর নাব্যতা রক্ষায় সরকার জায়গায় জায়গায় ড্রেজিং করছে। ড্রেজিং করে নদীর নাব্যতা হয়তো ফিরিয়ে আনা সম্ভব। কিন্ত তা কতদিনের জন্য? নদীতে পানি থাকলে নাব্যতা আসবে কোত্থেকে?

ভিডিও:


একেকটি নদী যেন কালের সাক্ষী হয়ে ইতিহাসে আশ্রয় নিতে চলেছে। খরস্রোতা একেকটি নদী আজ মরতে বসেছে।

শুধু দক্ষিণে নয়। নদীর একই চিত্র দেখেছি শত বছরের ঐতিহ্যের সাক্ষী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ ধন্য পদ্মায়ও। পদ্মা এখন শান্ত নদী। মাছ ধরার নৌকাও তেমন নেই। জেলেদের কপালে হাত। বর্ষায় কিছু মাছ মেলে। তাই দিয়ে সংসার চলে। শুষ্ক মৌসুমে তারা কৃষি কাজ করে বা শহরে এসে রিকসা চালিয়ে বেগার খেটে বাল-বাচ্চার পেট চালায়।



গোধুলির আধো-আলোতে চোখে পড়লো দুই একটা নৌকায় জেলেরা জাল টানছে। দিনের শেষে শেষ চেষ্টা করে যাচ্চে যদি দুইটা আইড় অথবা একটা ইলিশ পড়ে যায় জালে। রূপালি ইলিশের সোনালী স্বপ্নে এভাবেই কাটে পদ্মা পারে জেলে জীবন।


শত বছরের হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পদ্মার নাব্যতায় কোনো বাধা সৃষ্টি করেনি। পদ্মায় পড়েনি কোনো চর। পদ্মা বহমানই ছিল তার চিরন্তন ধারায়। কিন্তু লালন শাহ এসেই সবকিছু কেন যেন ওলট পালট। পাকশির পদ্মার প্রায় এক-তৃতীয়াংশই আজ জলশূন্য। চর পরে গেছে পদ্মায়। তীর এগিয়ে এসেছে মাঝ নদীতে। নদী তাই আজ সংকীর্ণ। মাঝনদীতে শাক-সবজীর আড়ৎ, বাদাম-চানাচুরের পসরা। দোষ হয়তো ‘লালন শাহ্’র না। নদীতে যদি পানিই না থাকে তবে ‘হার্ডিঞ্জ’ আর ‘লালন’কে দোষ দিয়ে কী হবে?



পাকশির পদ্মা থেকে গিয়েছি লালমনিরহাটের তিস্তায়। খুঁজে পেয়েছি মরা নদীকে। পা ভেজানোর মতো পানিও নেই অনেক জায়গায়।  

তিস্তা সেতু পার হওয়ার সময় হৃদয় শুকিয়ে যায় বেদনায়। প্রমত্ত তিস্তা আজ পুরোটাই চর। নৌকাওতো দূরের কথা, হাসের সাতার কাটার মতো পানিও নেই। পাশাপাশি দুটি ব্রিজ (সড়ক ও রেল) যেন দাঁড়িয়ে প্রহসণ করছে। পানিই নেই অথচ সেতু। সেতু সংলগ্ন পুরো নদীই আজ জলশূন্য। চরের কোথাও কোথাও জমে আছে কিছু পানি।



কবির ভাষা কিছুটা পরিবর্তন করে---তিস্তা আজ যেন চিক চিক করে বালু কোথা নেই পানি। তবুও আশা হয়তো প্রাণ ফিরে পাবে হারানো তিস্তা। জীবন ফিরে পাবে মানুষ।

যখন যমুনা পাড় হলাম দেখলাম শুষ্ক এক নদীকে। সিরাজগঞ্জের দিকে কিছুটা পানি থাকলেও টাঙ্গাইলের পাশে প্রায় পুরোটাই শুষ্ক চর। চার কি:মি: সেতু পার হওয়ার সময় যে আনন্দ পাওয়ার কথা তা নদীর দিকে তাকিয়ে উবে গেল। এ যমুনা আমার না। এ যমুনার উত্তরাধিকার বাংলা না। বাংলার চিরচেনা যমুনা আজ হারিয়েছে তার ভরা যৌবন।



নদীর পাড়ে বাড়ি আমার। প্রতিদিন ভোরে ঘুম থেকে উঠে নদীতে কুলি করতাম। সারাদিনের ধূলি-বালি-কাদা মাখা শরীর নদীতে পরিষ্কার করে তবেই ঘরে ফেরতাম। বাড়িতে বোন জামাই এসেছে। ঘরে মাছ নেই। মা বলতেন যা তোর রইস চাচার কাছ থেকে ইলিশ নিয়ে আয়। জালে আটকা পড়া সদ্য ধরা পড়া ইলিশটি নিয়ে বাড়ি ফিরেছি। ইলিশ পানির ওপর বেশিক্ষণ বাঁচে না। কিন্তু বাড়িতে ফিরতে ফিরতে দুই একটা লাফ দিয়েছে-এরকমও হয়েছে কখনো কখনো।



আমার শৈশব অর্ধেক কাটে নদীতে অর্ধেক স্থলে। এটাই নদীর পাড়ের চিরন্তন শৈশব।

কিন্তু কেন নদী আজ এতো অভিমানি? কেন ক্রন্দনের জন্য দুফোটা অশ্রুও নেই তার চোখে?

নদীতে বাধ দিয়ে নদী ভরাট করে চলেছে আমাদের সকল কর্মযজ্ঞ। এমনকি নদীর বুকে চলতে গিয়েও কত যে বর্জ বিসর্জন! সবই তো মুখ বুজে মেনে নিয়েছে। কিন্তু এভাবে আর কত?



দেশ বিভক্তির পর ভারত কর্তৃক ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণের ফলে আমাদের নদী হারিয়েছে তার চিরন্তন স্রোতধারা। এতে সব নদীই কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কিন্তু দোষ কেবল ফারাক্কার নয়। অত্যাচার আমরা বেশি বৈ কম করিনি।

ভিডিও: ২


যে নদীর পাড়ে আমার বাড়ি, সে বাড়ি এখনো আছে। শুধু নদীটাই হারিয়ে গেছে-দূরে সরে গেছে। সংকীর্ণ হতে হতে তা এখন ম্রীয়মান। এভাবেই নদীর সাথে আমাদের সম্পর্কগুলোর চির অবসান ঘটতে চলেছে। নদীর সাথে সম্পর্কহীনতা মানে জীবন থেকে দূরে সরে যাওয়া। নদীবিহীন জীবন যে আমাদের অর্ধেক জীবন।

বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৬
/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।