ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

যশোরের যশ খেজুরের রস

উত্তম ঘোষ, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২, ২০১৫
যশোরের যশ খেজুরের রস ছবি: বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

যশোর: কুয়াশায় ঢাকা শীতের সকাল। গ্রামের মাঠে-ঘাটে তখনও সূর্যের আলোর দেখা না মিললেও গাছিরা বেরিয়ে পড়েছেন খেজুর রস আহরণে।

সারিবদ্ধ খেজুর গাছে উঠে রস ভর্তি হাঁড়ি (ছোট কলস) নামিয়ে আনছেন।

এভাবে কয়েকটি গাছের রস এক সঙ্গে করে আট থেকে ১০ হাঁড়ি পূর্ণ করে ঘাঁড়ে বাঁক বাঁধিয়ে গাছি রওনা হচ্ছেন বাড়িতে। গাছি বধূরা ওই রস ছেঁকে (ময়লা পরিষ্কারের জন্য) মাটির চুলায় তাফালে (অ্যালুমিনিয়ামের বিশেষ পাত্র। যাতে রস জ্বাল দেওয়া হয়) জ্বালিয়ে তৈরি করছেন সুস্বাদু নলেন গুড়।

সোমবার (৩০ নভেম্বর) ভোর সাড়ে ৫টার দিকে যশোর সদর উপজেলার তেজরোল গ্রামে গিয়ে চোখে পড়ল এমনই দৃশ্য। বৃদ্ধ গাছিদের পাশাপাশি স্কুল পড়ুয়া ছাত্ররাও বের হয়েছে রস আহরণে। সকালে বেশিরভাগ বাড়ির শিশু-কিশোরদের দেখা গেলো জিরান রস দিয়ে মুড়ি খেতে। আর গাছি বধূরা রস জ্বালিয়ে নলেন গুড় ও পাটালি তৈরিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন।

একবার খেজুর গাছ কাটলে পরপর দুই/তিনদিন রস পাওয়া যায়। এর মধ্যে প্রথম রাতে যে রস হয় তাকে স্থানীয়ভাবে জিরান রস বলা হয়। এভাবে কয়েকদিন পর পর গাছ কেটে প্রথম রাতভর জমা রস দিয়ে তৈরি হয় নলেন গুড়।     

সংশ্লিষ্টদের মতে, খেজুর রসের গুড়ের জন্য যশোরের সুনাম রয়েছে সারাদেশে। শীত এলেই এ জেলার সর্বত্র খেজুরের রস আহরণ ও গুড় তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে গাছি ও গাছি বধূরা। তাইতো আবহমান বাংলার রূপ-প্রকৃতির বাস্তব অভিজ্ঞতার বর্ণনা দিয়ে যশোরের স্থানীয় এক কবি লিখেছেন-

‘‘ঠিল ধুয়ে দে বউ গাছ কাটতি যাবো
খাজুর গাছে চোমর বারুইছে
তোরে আইনে দেব
সন্ধ্যের রস ঝাড়ে আইনে
জাউ নান্দে খাব’’

যা আজ যশোরাঞ্চলের লোকের মুখে মুখে গান হিসেবে ফিরছে। তবে কালের আবর্তে আর ইট ভাটার আগ্রাসনে হারিয়ে যেতে বসেছে 'যশোরের যশ খেঁজুরের রস'।

এখনো নলেন গুড় ও পাটালির জন্য খ্যাতি রয়েছে যশোর সদর উপজেলার খাজুরা, তেজরোল, এনায়েতপুর, লেবুতলা, পান্তাপাড়া, যাদবপুর, গোবরা, জহুরপুর, মাঝিয়ালি, মথুরাপুর, তেলকূপ, মির্জাপুরসহ বিভিন্ন গ্রামের। তবে এক সময় এসব এলাকার বিস্তীর্ণ জমির আইল ও রাস্তার দুইধারে ছিল সারি সারি খেজুর গাছ।

তেজরোল গ্রামের মশিয়ার হোসেনের ছেলে সপ্তম শ্রেণি পড়ুয়া বকুল হোসেন (১৩) বাংলানিউজকে জানায়, তার বাবা একজন গাছি। খেজুর গাছ কাটেন)। তবে প্রতিদিন সকালে সে (বকুল হোসেন) রস সংগ্রহের কাজে বাবাকে সহায়তা করে।

স্থানীয় গাছি মতিয়ার রহমান বলেন, চলতি মাসের শুরুতে (অগ্রহায়ণ) এ অঞ্চলে খেজুর গাছ কাটা শুরু করেছেন। তবে পুরোপুরি শীত না পড়ার কারণে গাছে রস কম হচ্ছে। পৌষ মাসের শুরুতে রস বাড়বে বলে আশা করছেন তিনি।

একই গ্রামের ওসমান লস্কর (৬৮) নামে অপর এক গাছি বাংলানিউজকে বলেন,
এক কেজি নলেন গুড় তৈরির জন্য দেড় ঠিলে (ভাঁড়/হাঁড়ি) জিরান রসের প্রয়োজন। আমার ১৪টি খেজুর গাছ তিনপালা (সপ্তাহে তিনদিন) কাটলে সপ্তাহে কমপক্ষে ১৫ কেজি গুড়/পাটালি উৎপাদিত হয়। কোনো ধরনের ভেজাল ছাড়া তৈরি এ নলেন গুড়/পাটালি প্রতি কেজি ১৮০ টাকা থেকে ২২০ টাকা পর্যন্ত দরে বিক্রি করা হয়।

খেজুরের গুড়ের জন্য তেজরোল গ্রামের বারিক লস্করের পরিবার এখনও নাম করা। তার বাড়িতে গিয়ে বারিক লস্করকে (৭৫) বড় চুলায় রস জ্বালাতে দেখা গেল। আর রসের তাফালের চারপাশে বসে আগুন পোহাচ্ছেন তার নাতি-নাতনিরা।

তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বছর ১৫ আগেও তাদের চার পণেরও বেশি (এক পণ মানে ৮০টি) খেজুর গাছ ছিল। তবে সময়ের আবর্তে এখন সেই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ১০০টিতে। ফলে তার একার পক্ষে এতো গাছ কেটে রস সংগ্রহ করা সম্ভব না। এজন্য তার তিন ছেলে শাহিনুর, মিজানুর ও হোসেনকেও এ কাজে (গাছ কাটা) সম্পৃক্ত করেছেন।

স্থানীয় নিয়ামত লস্করের (৭০) বাড়িতে গিয়ে দেখা যায়, তিনি ও তার স্ত্রী হাঁড়ি ভর্তি খেজুর রস ছেঁকে চুলার ওপরে থাকা তাফালে ঢালছেন। এরপর চুলায় আগুন ধরিয়ে জ্বাল ধরিয়ে দিলেন। প্রায় ৪০ মিনিট একটানা জ্বালানোর পর লাল গুড়ের দেখা মিললো। তখন ভালো করে নেড়ে আরও ১০ মিনিট জ্বালানোর পর গুড় ছেঁকে একটি মাটির জ্বালাতে (গুড় বীজ মারার মাটির তৈরি পাত্র) ঢালা হলো।

এবার খেজুর গাছের ‘ডাল’ দিয়ে তৈরি খুন্তি দিয়ে জ্বালার একপাশে ঘঁষে সাদা করা হলো (স্থানীয়দের ভাষায় বীজ মারা)। এবার পুরো গুড় ভালো করে নেড়ে পাটালি তৈরির জন্য তৈরি বিশেষ স্থানে ঢালা হলো। এরপর ঘণ্টা দুয়েক পরে পাটালি শক্ত হলে ছুরি দিয়ে ভাগ ভাগ খণ্ড করে বিক্রির জন্য বাজারে নেওয়া হলো।

যশোরের বিখ্যাত নলেন গুড়: আশ্বিন মাসের শেষ কিংবা কার্তিক মাসের শুরুর দিকে জেলার খাজুরাসহ আশপাশের এলাকার গাছিরা কোমরে দড়া (পাটের আঁশের তৈরি মোটা দঁড়ি) বেঁধে, মাথায় ‘ফেটা’ আর পিঠে ‘ঠুঙে’তে ধারালো দা নিয়ে গাছে ওঠেন। এবার খেজুর গাছ থেকে রস আহরণের প্রথম ধাপ অথ্যাৎ স্থানীয় ভাষায় গাছ তোলা/ঝড়া (গত বছর গাছের যে পাশে কেঁটে রস আহরণ করা হয়েছে তার উল্টোপাশের বাকল কেটে চেঁছে পরিষ্কার) শুরু করেন। এর কিছুদিন পরে একই গাছ আবারও চাঁছা হয়।

পরবর্তী সপ্তাহে গাছের কাটা অংশে বিশেষ কায়দায় বাঁশের তৈরি নল বসিয়ে মাটির হাঁড়ি বসিয়ে দেওয়া হয়। স্থানীয়ভাবে মৌসুমের প্রথম দিনের রসকে চাঁচের রস বলা হয়। তবে তার পরের সপ্তাহ থেকে গাছ কাটলে প্রথম দিন যে জিরান রস আসে ওই রসের তৈরি গুড়-পাটালি তুলনামূলক লালচে হয়। এই গুড়কে নলেন গুড় কিংবা পাটালি গুড় বলা হয়। তবে প্রতিবার গাছ কাটার দ্বিতীয় দিনে আহরণ করা রসকে বলা হয় ঘোলা রস। এই রস জ্বালিয়ে উৎপাদিত গুড়কে ঝোলা গুড় কিংবা চিট গুড় বলা হয়।

যশোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক নিত্য রঞ্জন বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, যশোর জেলায় প্রায় ১০ লাখ খেজুর গাছের মধ্যে সাত লাখ গাছ থেকে রস আহরণ করা হয়। তবে ইট ভাটাসহ নানা প্রতিকূলতায় খেজুর গাছ কমে যাচ্ছে।



যশোরে খেজুর গাছ ও তাল গাছ সংরক্ষণে একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে খেজুর গাছ লাগানো হয়েছে। এছাড়া বেসরকারি উদ্যোগে খেজুর গাছ লাগানো হয়েছে বলেও জানান তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ০২, ২০১৫
এসআই

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।