মাদারীপুর: ইংরেজ শাসনামলে ইংরেজদের অত্যাচারের মধ্যে একটি হলো নীলচাষিদের ওপর নির্মম নির্যাতন। দেশের বিভিন্ন স্থানে এখনও সেই অত্যাচারের সাক্ষী হিসেবে টিকে আছে নীলকুঠির ধ্বংসাবশেষ।
জোর করে চাষিদের দিয়ে নীল চাষ করানো এবং চাষিদের ওপর নির্মম অত্যাচারের জন্য নীলকুঠিতে থাকতো আলাদা কক্ষ। মাদারীপুর সদর উপজেলায় এখনো টিকে আসে সেই দুঃসহ স্মৃতি বিজড়িত একটি নীলকুঠি। বর্তমান প্রজন্মের কাছে নীলকুঠি ইংরেজ শোষণের ইতিহাস বহন করে।
মাদারীপুর সদর উপজেলার ছিলারচর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর গ্রাম। শিবচর-মাদারীপুর আঞ্চলিক সড়কের ছিলারচর থেকে আউলিয়াপুর গ্রামের জন্য আলাদা একটি গ্রামীণ সড়ক। ওই সড়ক দিয়ে একটু এগুলেই আউলিয়াপুর বাজার। বাজারের সঙ্গেই আছে নীলকুঠির (নীল তৈরির কারখানা) ধ্বংসাবশেষ। তৎকালীন ডানলপ নামে এক ইংরেজ এ নীলকুঠির তত্ত্বাবধানে ছিলেন। এজন্য ‘ডানলপ সাহেবের নীলকুঠি’ নামেই পরিচিত এ নীলকুঠি। তবে স্থানীয়দের মুখে ফিরতে ফিরতে আজ অনেকেই এটিকে ‘ঢলক সাবের’ নীলকুঠি ডাকেন।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইংরেজ শাসনামলে মাদারীপুরে নীলচাষের জন্য ‘নীলকুঠির’ নামে একটি খামার স্থাপন করে ইংরেজ নীলকররা।
চাষাবাদের জন্য উর্বর ভূমি হওয়ায় সেসময় জেলার ছিলারচর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর নামে এ গ্রামে নীলকরদের আস্তানা গড়ে ওঠে। ধারণা করা হয়, ১৮০০ সালের আগে আউলিয়াপুর গ্রামে নীল তৈরির এ খামারটি গড়ে তোলা হয়।
খামারের দেখভালের দায়িত্বে ছিলেন ডানলপ। ১৮৪৭-৪৮ সালে নীল চাষের ফলে স্থানীয় কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হলে নীল চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন তারা। তখনই নির্মম অত্যাচার-জুলুমের শিকার হন কৃষকরা।
আউলিয়াপুর গ্রামের প্রায় ১২ একর জমির ওপর নীলকুঠি স্থাপন করেছিলেন ডানলপ। মাদারীপুর জেলা সদর থেকে ১২ কিলোমিটার দূরের আউলিয়াপুর গ্রাম সংলগ্ন ছিলারচর নদী তীর পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল নীল তৈরির এ খামার। যার বেশির ভাগ মিশে গেছে মাটির সঙ্গে। এখন যতটুকু অবশিষ্ট রয়েছে, তাই ইংরেজ শাসনামলে নীল চাষিদের ওপর নির্মম নির্যাতনের ইতিহাস বহন করে।
স্থানীয়রা জানান, এ নীলকুঠি দেখতে দূরদূরান্ত থেকে অনেকেই আসেন। মাঝে মধ্যে স্কুলের ছাত্ররা আসে পিকনিক করতে। অনেক সময় বিদেশিদেরও দেখা যায় এখানে। গ্রামের বয়স্করা মনে করেন, এ নীলকুঠি অভিশপ্ত এক জায়গা। তবে নীলকুঠির যতটুকুই এখন অবশিষ্ট রয়েছে, তা নিঃসন্দেহে একটি ইতিহাসের সাক্ষী। এ নীলকুঠির সঙ্গেই রয়েছে খ্যাতিমান আউলিয়া হজরত শাহ সুফী খাজা ইউসুফ শাহ আহসানের দরগা শরিফ। অযত্ন-অবহেলায় এ দরগা শরিফটিও আজ জরাজীর্ণ।
ইতিহাস থেকে জানা গেছে, ইংরেজদের অত্যাচারে যখন অতিষ্ঠ এ অঞ্চলের কৃষকরা, তখন ফরায়েজি আন্দোলনের মুখপাত্র হাজী শরীয়তুল্লাহ এবং মুহাম্মদ মুহসীনউদ্দীন দুদু মিয়া নীলকুঠিয়ালদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করেন। গড়ে তোলেন প্রতিরোধ। এসময় বৃহত্তর ফরিদপুর, ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, কুমিল্লা, নোয়াখালীসহ বিভিন্ন অঞ্চলের হাজার হাজার মানুষ ফরায়েজি আন্দোলনের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন। কৃষকদের ওপর নির্মম নির্যাতন তারা মেনে নিতে পারেননি। ইংরেজ ও জমিদারদের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করাই ছিল নীল বিদ্রোহে হাজী শরীয়তুল্লাহর উদ্দেশ্য।
হাজী শরীয়তুল্লাহর মৃত্যুর পর তার ছেলে পীর মহসীন উদ্দিন দুদু মিয়ার সঙ্গে নীলকরদের যুদ্ধ হয়। তাদের প্রতিরোধের ফলেই এ এলাকা থেকে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় নীলকররা। স্বাধীন হন নির্যাতন-নিপীড়নে শিকার এ অঞ্চলের কৃষকরা।
আউলিয়াপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. মকবুল বলেন, ইংরেজ ঢলক সাব (ডানলপ) এ নীলকুঠি বানাইছিল। এ গ্রামের ১২ একর জায়গায় নীলকুঠি ছিল। এ এলাকায় নীল চাষও করা হইতো। পরে এখানে নীল বানাইতো। দিন দিন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে নীলকুঠি। এখন কিছু অংশ টিকে আছে। অনেকেই নীলকুঠি দেখতে আসে।
তিনি আরও বলেন, আমার দাদার কাছে শুনেছি, এ এলাকায় সাতটা কুঠি আছিল। এখন যেটা আছে, এটাই সবচেয়ে বড় ছিল। এ নীলকুঠিতেই ঢলক সাব থাকতো। এইটা ইংরেজ আমলের ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে আছে। আমাদের গ্রামের পূর্বপুরুষেরা নীল চাষের জন্য অনেক অত্যাচার সহ্য করছিল।
১৭৭৭ সালের দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম নীল চাষ শুরু হয়। উইকিপিডিয়া সূত্রমতে, ১৭৭৭ সালের দিকে ভারতীয় উপমহাদেশে লুই বোননড নামে এক ফরাসি নাগরিকের মাধ্যমে নীলের চারা এ অঞ্চলে রোপণ করা হয়। এরপর ১৮৩০ সালের মধ্যে সারা বাংলায় এক হাজারেরও বেশি নীল তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়। নীলকররা কৃষকদের নিজস্ব জমিতে খাদ্যশস্যের পরিবর্তে নীল চাষ করতে বাধ্য করতেন। মাদারীপুর সদর উপজেলার আউলিয়াপুর গ্রামে সেই নীল তৈরির কারখানা স্মৃতি হিসেবে এখনো টিকে আছে।
বর্তমানে প্রায় বিলুপ্ত ডানলপ সাহেবের নীলকুঠির পূর্ব দিকে রণখোলা, পশ্চিমে আউলিয়াপুর বাজার, উত্তরে কালীতলা ও দক্ষিণে আউলিয়াপুর দরগা শরিফ। রণখোলা নামক স্থানেই নীলকরদের সঙ্গে যুদ্ধ হলে পরাজিত হয়ে পালিয়ে যান এ এলাকার নীলকর ও তার লোকজন। তাতে মুক্তি পান কৃষকরা। ১২ কক্ষ বিশিষ্ট এ কুটির মাঝামাঝি অংশে রয়েছে একটি চুল্লি, যেখানে নীল তৈরি করা হতো। এর পাশেই রয়েছে প্রায় ৪০ ফুট উঁচু একটি চিমনি। বইয়ের পাতায় পড়া নীলচাষের ইতিহাসের সাক্ষী নীলকুঠি প্রত্যক্ষ দর্শনে অনেকেই আসেন এখানে। ঘুরে আসতে পারেন আপনিও।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩৭ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৬, ২০২৪
এসআই