ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো এক ঝাপটা শীতল হাওয়া

হোসাইন মোহাম্মদ সাগর, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮৫৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০২৩
উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো এক ঝাপটা শীতল হাওয়া

মস্কো (রাশিয়া) থেকে: রাশিয়ার মাটিতে ফ্লাইট ল্যান্ড করলো সকাল ৭টা ৪০ মিনিটে। আমি জানালার পাশে বসে।

বাইরে বরফের চাদর নেই, তবে সারি সারি ওক আর পাইন গাছের বনে গাছগুলো মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। হিমেল হাওয়া আর শেষ রাতের আবছা অন্ধকারে গাছপালা সব ঝিমিয়ে আছে। দেখলে মনে হয়, পুরো পৃথিবীই যেন এখনো ঘুমিয়ে। শুধু রাত জাগা পাখি হয়ে আকাশের এ মাথা থেকে ও মাথা উড়ে উড়ে শেষ পর্যন্ত একটা গন্তব্য পেলাম আমরা কয়েকজন রাত্রিচর।

আমি চারপাশে একবার তাকিয়ে দেখলাম, চারদিকে বিস্তীর্ণ বন। গাছগুলো এতই ঘন যে, মনে হলো যেন তারা আকাশকে ছুঁয়ে গেছে। আমি প্লেন থেকে এখনো বের হইনি, তবে জানালা দিয়ে তাকিয়ে যা বুঝতে পারলাম, বাইরে প্রচণ্ড ঠাণ্ডা। কিন্তু আমার মনের মধ্যে আনন্দের ঝড় বয়ে যাচ্ছে। যে দেশ নিয়ে এত স্বপ্ন, যে দেশে মানুষ একবার পা রাখার জন্য দিগ্বিদিক ছুটে বেড়ায়, আমি সে শহরে পা রাখতে চলেছি। এ তো স্বপ্নই।

প্লেন থেকে বের হয়ে যখন এয়ারপোর্টের ভেতরে ঢুকলাম, সামনেই চোখে পড়লো সুন্দর এক দৃশ্য। ছোট্ট একটা মেয়ে তার বাবা-মায়ের হাত ধরে এগিয়ে চলেছে সামনে, এর থেকে সুন্দর আর কী হতে পারে। পেছন থেকে তাদের একটা ছবিও তুললাম না জানিয়ে। কেন জানি দৃশ্যটা আমাকে ভীষণ আকৃষ্ট করলো। দুটি মানুষকে মনে করিয়ে দিলো খুব করে। খুব ছোটবেলায় এভাবেই আম্মুর হাত ধরে একটি ছবি উঠিয়েছিলাম। আর জীবনের প্রথম যৌবনে বা অনেকটা ছেলেবেলাতেই যে নারী হৃদয়ের প্রেমকাটায় হৃদয় আটকেছিল, তাকে কোনো একদিন এমন একটা ছবি পাঠিয়েছিলাম। সে ছবির রেশ হয়তো নিজের অজান্তেই এখনো রয়ে গেছে হৃদয়ে। আজ এতদিন পর তা যেন হুট করে মনে পড়ে গেল।

স্মৃতিদের গোধূলি লগ্ন থেকে বের হলাম। সামনে দিয়ে এক এক করে প্লেনের সব যাত্রীরা এগিয়ে যাচ্ছে। নিজ দেশে অপরিচিত জাতি-বর্ণের লোক দেখে তারা অনেকেই বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখলো আমাদের। দেখলাম আমরাও। দেখলাম লম্বা পায়ের মেয়েরা কেমন হনহন মুহূর্তের মধ্যেই ছুটে চলে যায় এপাশ থেকে ওপাশে। তারপর তাদের দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে মোবাইলটা হাতে নিলাম ওয়াইফাইয়ের খোঁজে। বিমানবন্দরে ফ্রি ওয়াইফাই আছে ঠিকই, তবে তার পাসওয়ার্ড মিলবে ফোনকল বা এসএমএসের মাধ্যমে। কী এক ঝামেলা! এ ভিন দেশে গ্রামীণফোন আর টেলিটক নিজেদের নেটওয়ার্ক ছাড়াই কাজ করবে কেন শুনি! অগত্যা মোবাইল পকেটে রেখে সবাই এগোলাম ফ্রেশ হওয়ার জন্য। বাইরে আমাদের রিসিভ করার জন্য কেউ এসেছে কি না, তখনো জানি না!

আমরা দুজন ছেলে ফ্রেশ হয়ে এসে অপেক্ষা করছি দলের মেয়েদের জন্য। এর মধ্যে কেবিন ক্রু অ্যালিনা তার অন্যান্য সহযোগী আর ক্যাপ্টেনদের সঙ্গে নিয়ে বেরিয়ে গেলেন সুন্দর হাসিতে বিদায় জানিয়ে। আমরা চারজনও বেরোনোর জন্য প্রস্তুত। বেশ ছিমছাম এয়ারপোর্টের ভেতর হাঁটতে বেশ ভালোই লাগলো। রাশিয়ার শীতের হাওয়ার দাপট তখনো গায়ে মাখিনি। ছিমছাম এয়ারপোর্টের ভেতর আবহাওয়া বেশ সুন্দর। সেই সুন্দরকে সঙ্গে নিয়েই চললাম সামনে।

একটু পথ এগোতেই দেখলাম সবার হাতে লাগেজ। সামনে ইয়া লম্বা রেখায় ইমিগ্রেশন কাউন্টার। কম করে হলেও ৫০টা কাউন্টার তো হবেই। যদিও খোলা আছে কয়েকটি। সেগুলোতেই সবার ভিড়। আমরা একটু এগিয়ে একজন পুলিশ অফিসারকে জিজ্ঞাসা করলাম, লাগেজ সংগ্রহ করবো কোনদিক থেকে এবং কীভাবে? মূলত ইমিগ্রেশনের আগে সবার হাতে লাগেজ দেখেই মনে এ প্রশ্ন জেগেছিল। তবে শান্ত স্বভাবের পুলিশ অফিসার বেশ আকারে-ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলেন আগে ইমিগ্রেশন, এরপর রাশিয়ান ভাষাতেই বললেন অনেক কিছু। কিন্তু হায়, আমরা রাশিয়ান ভাষার ‘র’-ও বুঝি না। আর তারা বোঝে না ইংরেজি।

পাশেই দেখলাম কিছু ছেলে-মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কথাবার্তায় আর চেহারা ভঙিমায় বুঝলাম তারা সম্ভবত ভারতীয় ও এখানকার স্টুডেন্ট। তাই এগিয়ে কথা বললাম তাদের সঙ্গেই। ধারণা সত্য। পাঁচ থেকে সাতজনের টিমে সবাই তারা ভারতীয় ও এখানে লেখাপড়া করছেন। কথা হলে তারাই বললেন- আগে ইমিগ্রেশন, তারপর লাগেজ কালেকশন।

আমাদের কথা হতে হতেই এক লেডি সিকিউরিটি অফিসার এসে আমাদের ইমিগ্রেশনের কাউন্টার দেখিয়ে দিলেন। মূলত ওই কাউন্টারটা ফাঁকা হয়ে যাওয়াতেই এদিকে ভিড় না বাড়িয়ে আমাদের ওদিকে ডাকা হলো। দুটি কাউন্টারে প্রথমে ইমিগ্রেশনে ঢুকলেন শফিকুল ভাই আর জিনিয়া আপু। আমরা বাকি দুজন তখন লাইনে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছি, আর আমাদের দিকে লেডি সিকিউরিটি অফিসারের বারবার আঁড় চোখে তাকানো পর্যবেক্ষণ করছি। এটা সত্যি যে, ফরমাল ড্রেসের সঙ্গে কালো কোর্টে বেশ মানিয়েছে সিকিউরিটি অফিসারটিকে। এমন সিকিউরিটি অফিসার যদি বাংলাদেশে থাকে, তবে কথায় কথায় যে মানুষের মন চুরি হয়ে যাবে মুহূর্তেই, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বেশ কিছুক্ষণ সময় যাওয়ার পর ইমিগ্রেশনে ডাক এলো আমাদের। এখানেও লেডি অফিসার! তবে তিনি বেশ রুক্ষ চেহারার। বোর্ডিং পাসসহ পাসপোর্ট এগিয়ে দিলাম তার দিকে। ইমিগ্রেশন কাউন্টারের এক পাশ বন্ধ। ভেতর থেকে খুলে দিলে তবেই ওপাশে যাওয়া। আর এপাশে যে দরজা দিয়ে ঢোকা, তাও আবার দোকানের দরজায় লাগানো শাটার সিস্টেমের। চাইলেই ভেতর থেকে বন্ধ করে দেওয়া যায় মুহূর্তেই। ইমিগ্রেশন অফিসারের নামটা খেয়াল নেই; যদিও ড্রেসের সঙ্গে ব্যাচ লাগানো ছিল, তবে তা রাশিয়ান ভাষাতে। ভদ্রমহিলা আমার পাসপোর্ট নিয়ে অনেকক্ষণ পর্যবেক্ষণ করলেন। কম করে হলেও পাঁচ থেকে সাত মিনিট তো হবেই। তারপর জিজ্ঞেস করলেন- হুসাইন? আমি বললাম- না, ইটস হোসাইন। তবুও তিনি তিন থেকে চারবার আমায় হুসাইন বলেই আখ্যায়িত করলেন। হঠাৎ দেখি ওপর থেকে আমার ইমিগ্রেশন কাউন্টারের ঝাঁপ হুট করে নিচে নামতে শুরু করেছে। বেশ ভয় হলো- এ বুঝি আটকে দিল! তাই বলে এভাবে নাম নিয়ে আটকাবে! এ তো মানা যায় না। কিন্তু না, এ যাত্রায় মনে হয় বেঁচে গেলাম। ঝাপটা অর্ধেকের একটুখানি কম নেমে বন্ধ হয়ে গেল। এরপর আমার দিকে ঠাঁয় তাকিয়ে থাকলো ভদ্রমহিলা। এতটা সময় তাকিয়ে থাকলো যে, আমার নিজেরই বিরক্ত ধরে গেল! বাধ্য হয়েই নিজের চেহারার দিকে আঙুল নির্দেশ করে বললাম- ‘নাইস ফেস, ইজেন্ট ইট?’

রুক্ষ চেহারায় এবার একটু হাসি ফুটলো। বিড়বিড় করে রাশিয়ান ভাষাতেই কথা বললো পাশের কাউন্টারের ইমিগ্রেশন অফিসারের সঙ্গে। তারপর একবার আমার পাসপোর্টের দিকে, একবার আমার দিকে দৃষ্টি। কম করে হলেও পাঁচ থেকে ছয়বার। এরপর একটা পেপারে সিগনেচার নিয়ে তার অর্ধেক পেপার আমায় দিয়ে ভেতর থেকেই খুলে দিলেন দরজা। সবুজ বাতি জ্বলে উঠলো কাউন্টারে। সব মিলিয়ে প্রায় ১৫ মিনিট পর ভদ্রমহিলা বলে উঠলেন, ইউ মে গো!

ইমিগ্রেশনে এত দীর্ঘ সময় লাগার পর এয়ারপোর্টে আর দাঁড়াতে মন চাইলো না। ওদিকে প্রোগ্রামে জয়েন করতে হবে আজকেই। তাই দ্রুত হোটেলে ফেরার তাড়াও আছে। সেজন্য সবাই দ্রুত লাগেজ কালেক্ট করেই বেরিয়ে পড়লাম বাইরের উদ্দেশে। বেরুতেই দেখি নিউ জেনারেশনের স্টিকার হাতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করেছে ডেনিয়েল। পরিচয় পর্ব সেরে ডলার এক্সচেঞ্জ আর সিম নেওয়ার জন্য জানালাম তাকে। ডেনিয়েল জানালো- এয়ারপোর্টে ডলারের রেট পাওয়া যাবে কম, আর মোবাইল সিমের দামও বেশি। এর থেকে আমরা যে হোটেলে থাকবো, সেখানেই এসবের ব্যবস্থা আছে। তাই সুবিধা সেখান থেকেই। এ বলে আমাদের জন্য গাড়ি রেডি করতে গেলেন তিনি। আমরা পা রাখলাম এয়ারপোর্টের মূল দরজার বাইরে। এক ঝাপটা শীতল হাওয়া এসে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালো আমাদের। মন-প্রাণ ভরে নিজেদের সঙ্গে মেখে নিলাম সকালের প্রথম প্রহরের রাশিয়ান শীতল হাওয়া!

আরও পড়ুন...
সাদা রাতের শহরে

বাংলাদেশ সময়: ০৮৪৯ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৪, ২০২৩
এইচএমএস/আরবি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।