ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ফিচার

‘মে দিবস টিবস বুঝি না, কাজ না করলে ভাত জুটবে না’

মো. আমিরুজ্জামান, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৯ ঘণ্টা, মে ১, ২০২৩
‘মে দিবস টিবস বুঝি না, কাজ না করলে ভাত জুটবে না’

নীলফামারী: মে দিবস কী, তা জানেন না উত্তরের বাণিজ্য কেন্দ্র নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কল-কারখানা ও ক্ষেত-খামারে খেটে খাওয়া বেশির ভাগ শ্রমিক।  

তাদের সাফ কথা, ‘হামরা কাজ করি পেটের ভাত জোটাই।

কাজ করি মজুরি নিই। দিবস-টিবস হামরা বুঝি না। কাজ না করলে ভাত জুটবে না। সকাল থেকে সন্ধ্যা কিংবা রাত পর্যন্ত গায়ে খেটে সংসার চালাই। ’ 

নারী শ্রমিকরা বলেন, ‘কর্মক্ষেত্রে হামরা হয়রানির শিকার হই। মজুরির ক্ষেত্রেও করা হয় বৈষম্য। তবুও হামরা প্রতিবাদ করতে পারি না। কেউ হামার পাশত দাঁড়ায়ও না। ’

উত্তরের ব্যবসা-বাণিজ্যের শহর নীলফামারীর সৈয়দপুর। এখানে ঘরে ঘরে গড়ে উঠেছে মিনি কারখানা। কারখানায় সকাল থেকে রাত অবধি চলে ঠকঠক, টুংটাং শব্দ। এসব কারখানায় নারী-পুরুষ বিরতিহীনভাবে কাজ করছেন। ট্রাংক, বালতি, মোমবাতি, আগরবাতি, শোকেস, ফাইল কেবিনেট, সাবান, গুল, জর্দাসহ নানা পণ্যের কারখানায় কাজ করছেন হাজার হাজার নারী-পুরুষ। এসব কারখানার মালিকরা শ্রমিকদের কাজের বিনিময়ে টাকা দিয়ে থাকেন। ফলে কর্মঘণ্টা তাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়।  

শহরের গুল, তামাক ফ্যাক্টরি, বেশ কিছু কল-কারখানার শ্রমিক ও ক্ষেতমজুররা জানেন না মে দিবস কী? এদিনেও কাজ করেন তারা। কারণ একটাই, কাজ না করলে মজুরি মেলে না। বসে থাকলে আয় হবে না।
 
বিভিন্ন কল-কারখানার শ্রমিকরা জানান, মে দিবসের মিছিল, রং খেলা, আলোচনা অনুষ্ঠান বা গানের অনুষ্ঠানের চেয়ে কাজ করে মজুরি বুঝে নেওয়া অনেক ভালো।

সৈয়দপুরে বালতি ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন আকরাম হোসেন (৩৪)। বাড়ি উপজেলার বোতলাগাড়ী ইউনিয়নের জানেরপাড়ে। তাকে প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। বিনিময়ে তাকে প্রতিদিন তিনবেলা খাবার এবং সপ্তাহে মজুরি দেওয়া হয় এক হাজার টাকা। সপ্তাহ শেষে ওই টাকা তুলে দেন বাবা-মায়ের হাতে।  

আকরাম হোসেন বলেন, ‘মে দিবসে শ্রমিকরা কর্মঘণ্টা  আট ঘণ্টা করার দাবিতে আন্দোলন করে জীবন দিয়েছেন। এদিনে শ্রমিকদের অধিকার আদায় হয়েছে বলে শুনেছি। ’

শহরের বিভিন্ন চানাচুর, সেমাই, বস্তা তৈরি, কয়েল ফ্যাক্টরি, কারচুপি কারখানাসহ বিভিন্ন শিল্প কারখানা ও প্রতিষ্ঠানে জড়িত শিশু শ্রমিকের সংখ্যা ১০ হাজার। তবে অভাব-অনটনে এ সংখ্যা প্রতিবছর বাড়ছে।  

বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখা গেছে, বহু নারী-পুরুষ ও শিশু শ্রমিক চুক্তির ভিত্তিতে বা দৈনিক হাজিরায় কাজ করছেন। তাদের দেখভাল করার জন্য সৈয়দপুরে শ্রমিককল্যাণ কেন্দ্র থাকলেও বাস্তবে এর কোনো ভূমিকা নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। শ্রমিক নির্যাতন, কাজের ঘণ্টা ও শ্রমিকদের চিকিৎসা সংক্রান্ত বিষয় দেখার কথা থাকলেও তা করা হয় না।

এ শহরের নিয়াতমপুরে হালকা প্রকৌশল শিল্পে কাজ করেন আহাত আলী (২২)। ভোর থেকে রাত অবধি লোহা লক্করের কাজ করেন। অথচ কাজ শেষে তার মজুরি মেলে মাত্র ৩০০ টাকা। একটি গুল ফ্যাক্টরিতে কাজ করে আজগার আলী নামে এক কিশোর। সকালে মায়ের সঙ্গে গুল ফ্যাক্টরিতে কাজ করতে আসে। এখানে কৌটায় গুল ভরা ও লেবেল লাগানোর কাজ তার। এ কাজ করার সময় গুলের গুঁড়া নাকে চোখে লেগে দম বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়। কাজ শেষে তার মায়ের হাতে ৩৫০ টাকা দেওয়া হয়। সংসারে অভাব, তাই করার কিছুই নেই তার।

শান্তিবালা (৪২), সূর্য্যবান (৩২), মায়া বেগম (৩৭), আসমা খাতুন (৪৭) ও কিরণবালা (৫১) উপজেলার বোতলাগাড়ি ইউনিয়নে মাঠে দলবেধে কাজ করেন। তারা বলেন, ‘পুরুষের সমান কাজ করি আমরা। কিন্তু মজুরি দেওয়া হয় অর্ধেকেরও কম। এ ক্ষেত্রে পুরুষরা ৫০০ টাকা পেলেও আমাদের দেওয়া হয় মাত্র ২০০ টাকা। পুরুষরা বিড়ি-সিগারেট থেয়ে দম নেয়, কিন্তু আমাদের কাজে কোনো ফাঁকি নেই। কাজ ফুরানি (চুক্তি) নিয়েছি। সারা বছরই হামাক কাম করি খাবার লাগে ব্যাহে। ’

এ প্রসঙ্গ সৈয়দপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফয়সাল রায়হান বলেন, ‘মানুষ এখন আগের চেয়ে অনেক সচেতন। শ্রমিকরা তাদের অধিকার আদায়ে সব সময় তৎপর। তারপরও কোনো অসঙ্গতি পরিলক্ষিত হলে উপজেলা প্রশাসন ব্যবস্থা নেবে। ’

বাংলাদেশ সময়: ১৩১৩ ঘণ্টা, মে ১, ২০২৩
এসআই


 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।