ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য

চা-বাগানের পোকাধ্বংসকারী পাখি ‘গলাফোলা-ছাতারে’

বিশ্বজিৎ ভট্টাচার্য বাপন, ডিভিশনাল সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০২০
চা-বাগানের পোকাধ্বংসকারী পাখি ‘গলাফোলা-ছাতারে’ চা-গাছের ঝোপে বসে আছে গলাফোলা-ছাতারে। ছবি: ইনাম আল হক

মৌলভীবাজার: ঝোপের পাখি সে। ওখানেই জীবনপ্রবাহ তার।

লোকালয়ে আসে না। চা-বাগানের চা-গাছগুলোকে সে ঝোপ হিসেবে ব্যবহার করে সেখানেই দিব্বি টিকে আছে। বিনিময়ে পোকা নিধন করে ফ্রি সেবা সে দিয়ে যাচ্ছে প্রকৃতিকে।

চা-বাগানের পোকা নিয়ন্ত্রণে বড় অবদান রয়েছে তার। চা-গাছের এক ঝোপ থেকে অন্য ঝোপে সে পোকা ধরার জন্য ঘুরে বেড়ায়। প্রতিদিন একেকটি পাখি প্রায় অর্ধশতাধিক চা-গাছের পোকা ধ্বংস করে। ১৫ সেন্টিমিটার দৈর্ঘ্যের এ পাখির নাম গলাফোলা-ছাতারে। এর ইংরেজি নাম Puff-throated Babbler এবং বৈজ্ঞানিক নাম Pellorneum ruficeps.

বাংলাদেশ বার্ড ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা এবং প্রখ্যাত পাখি গবেষক ইনাম আল হক বাংলানিউজকে বলেন, ‘সিলেট-চট্টগ্রাম বনের পাখি ‘গলাফোলা ছাতারে’। তবে চা বাগানগুলোতেও এ পাখিটিকে বেশি দেখা যায়। চা-বাগানের মধ্যেও আমি বহু ছবি তুলেছি। এই পাখিটা পোকা খাওয়া পাখি। তবে আরেকটা বিষয় বলে রাখি-সব ছাতারে (Babbler) কিন্তু পোকা খাওয়া পাখি। আমাদের পাখিদের একটি বড় পরিবার হলো ছাতারে। এরা সাধারণত বড় ঘাসের বন, ঝোপঝাড় এবং গহীন বন সব জায়গাতেই আছে, কিন্তু বিভিন্ন জাতের। কোনোটা গহীন বনে, কোনোটা ঘাসে সেই রকম। ’

‘চা-বাগান হলো ঝোপ জাতীয় গাছ। তাই ঝোপের পাখি যারা তাদের চা-বাগানে পাওয়া যায়। বিশেষ করে যখন চা-বাগানে পোকা মারার ওষুধ দেওয়া হয় না, ‍ওষুধ দেওয়ার ৪/৫ দিন পরে যখন আবার পোকা বেরোতে শুরু করে ও গিয়ে পোকা ধরতে থাকে। আর আমাদের বনে সব জায়গাতেই পাওয়া যায়, মাঝেমধ্যে দেখা যায় মাটি দিয়ে সে হাঁটছে। ’

তিনি আরও বলেন, ‘আরেকটা বৈশিষ্ট্য হলো- ওর রয়েছে খুবই সুরেলা ও মধুর ডাক। সে ডাকের সময় তার গলাটা ফুলিয়ে ফেলে। তাই ওর নাম গলাফোলা-ছাতারে। আমাদের দোয়েলের মতো প্রায়। হালকা মেটে রংয়ের। যেহেতু সে মাটিতে হাঁটে, ঝোপের ডালে ডালে পোকা খুঁজে বেড়ায় সেই জন্য ওই রংয়েই ও শরীর। যাতে ওর শত্রু ওকে দেখতে না পায়। ওর শরীর মেটে রংয়ের, তবে শরীরে ছিটে দাগ আছে। চোখের ওপর দিয়ে লম্বা রঙের টান আছে। ’

কাঠি-খুঁটি দিয়ে সে ঝোপঝাড়ে বাসা বানায়। আমি ওকে বাসা বানাতে দেখেছিও। সে অত্যন্ত পরিশ্রম কর্মঠ একটা পাখি। সারাদিন সে হেঁটে বেড়াচ্ছে, ঘুরে বেড়াচ্ছে, ডাকছে। অনেক পাখি আছে সারাদিন সে অতো কাজ করে না। কিছুক্ষণ খাবার খোঁজার পরে বসে থাকে বা ঘুমায়। অনেক পাখি দিনে বিশ্রাম নেয়। কিন্তু এই পাখিটা অনেক হেঁটে বেড়ায়। ফলে বনের পোকা নিয়ন্ত্রণ করতে সে বেশ দক্ষ বলেও জানান এ পাখিবিদ।  

রাসায়নিক এবং প্রাকৃতিক কীটনাশকের প্রসঙ্গ টেনে ইনাম আল হক বলেন, ‘চায়ের বাগানে এই পাখিটা যত থাকবে, তত কিন্তু আমরা উপকৃত হবো। চা-বাগানে পোকা নিয়ন্ত্রণ করার জন্য অনেক রকমের রাসায়নিক কীটনাশক ব্যবহার করা হচ্ছে। কিন্তু আমরা যদি রাসায়নিক কীটনাশকের বিপরীতে প্রাকৃতিক কীটনাশক হিসেবে চা-বাগানে গলাফোলা-ছাতারে যদি ব্যাপক সংখ্যায় থাকে তাহলে কোনো দিনই আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং পোকার নিয়ন্ত্রিত হয়ে আমাদের লাভ হবে। কৃত্রিম পোকা নিয়ন্ত্রণের এই এক অসুবিধা যে, ওটা বেশি প্রয়োগ করা হলে আমরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবো। কিন্তু পাখি যখন পোকা নিয়ন্ত্রণ করে তখন আমাদের ক্ষতির দিকটা একেবারে নেই। পাখি বেড়ে গেলে কিন্তু আমাদের কোনো ক্ষতি হবে না। আমরা স্বাস্থ্যসম্মত চা-ই খেতে পারবো। ’

একে আমরা প্রাকৃতিক ভারসাম্য বলি। এর মানে কিছু ধ্বংস করলো কিছু রেখে দিল। আর রাসায়নিক কীটনাশক দিয়ে সেই প্রাকৃতিক ভারসাম্যটাই আমরা নষ্ট করে ফেলি। বিষ প্রয়োগ করতে করতে চা- পাতাকে এত বেশি বিষাক্ত করে ফেললাম যে, আমরা নিজেরাই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি, মাটিকে ধ্বংস করে দিচ্ছি। চা-বাগানে পাখিরা যে পোকা নিয়ন্ত্রণ করে যাচ্ছে তার ওপরও আমাদের গুরুত্ব দিতে হবে বলে যোগ করেন তিনি।

চা-বাগানসহ প্রাকৃতিক বনে অন্য ছাতারেও সংখ্যায় কমে এসেছে। তবে গলাফোলা-ছাতারে বেশ ভালো আছে। আমাদের বন এবং চা-বাগানের ঝোপঝাড় উজারসহ বিভিন্ন ধরনের অত্যাচারের পরও গলাফোলা ছাতারে বেশ ভালোভাবেই টিকে আছে। একটা গলাফোলা-ছাতারে দিনে কম করে হলেও প্রায় ৫০টি পোকার ধরে খায়। এজন্য চা-বাগানে কিছু প্রাকৃতিক ঝোপঝাড় কেটে না ফেলার পরামর্শ দেন প্রখ্যাত পাখিবিদ ইনাম আল হক।

বাংলাদেশ সময়: ১০১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ১১, ২০২০
বিবিবি/এএটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।