ঢাকা, বুধবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিক্ষা

ইবিতে পুষ্টিহীন খাবারে শুধুই ক্ষুধা নিবারণ!

তারিকুল ইসলাম, ইবি করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৫০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২
ইবিতে পুষ্টিহীন খাবারে শুধুই ক্ষুধা নিবারণ! খাবারে মশা, মাছি, শামুকসহ অন্যান্য পোকামাকড় পাওয়া যায় প্রায়ই, ডানে নিচের ছবি

ইবি: নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে উঠে আসা ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের (ইবি) শিক্ষার্থী তাসিন। তিন বছর ধরে আছেন সাদ্দাম হোসেন হলে।

হল থেকে এক প্লেট খিচুড়ি, আলু ভর্তা দিয়ে নাশতা করে ক্লাসে চলে যান। দুপুরে ক্লাস শেষ করে হলে ২২ টাকায় সারেন দুপুরের খাবার। তরকারিতে ছোট এক টুকরো মাছের সঙ্গে দুই-এক টুকরা আলু বা পেঁপে বা লাউ থাকে।  

রাতের বেলায়ও একই মেন্যু দিয়ে খান। এতেই তৃপ্তির ঢেকুর তুলতে বাধ্য হচ্ছেন তাসিন। বাড়ি থেকে শ’পাঁচেক টাকা বেশি এলে কখনো এক টুকরো ব্রয়লার মুরগির মাংস সঙ্গে আলুর ঝোল দিয়েও খেয়ে থাকেন।

তাসিনের মতো অনেক শিক্ষার্থী আছেন, যারা নিয়মিত হলে ২২ টাকার টোকেনের খাবার খান। এ খাবারে অতৃপ্ত থাকলেও সাধ্যের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই তাদের। খাবারের মধ্যে পুষ্টি কতটুকু, রান্না পরিচ্ছন্ন নাকি নোংরা পরিবেশে হচ্ছে, এসব দেখার সুযোগ নেই। শুধুমাত্র বেঁচে থাকার তাগিদে এ খাবার খেয়েই দিন পার করতে হচ্ছে।

তবে এ খাবার তাদের শরীরের মোট আমিষের চাহিদা কতটুকু পূরণ করতে পারে, তা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ে বর্তমানে আটটি আবাসিক হলে সাড়ে চার হাজার শিক্ষার্থী অবস্থান করছেন। হলে অবস্থান করা প্রায় অর্ধেক শিক্ষার্থী ডাইনিংয়ে খেয়ে থাকেন। বাকি শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসের ভেতরের হোটেলে বা রুমে রান্না করে খান। সম্প্রতি হলগুলোর ডাইনিংয়ে রান্নার জন্য রাখা তরকারি থেকে শুরু করে রান্নার পরিবেশ, পরিবেশনায় বিভিন্ন সমস্যা চোখে পড়ে। এসব সমস্যার জন্য শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছে বলে জানিয়েছেন শিক্ষার্থী ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।

ছেলেদের পাঁচটি হলে মাছ, মাংস, ভাজি, ভর্তাসহ বিভিন্ন রকমের খাবার রান্না হয়। মাছের মধ্যে বেশিরভাগ সময় রুই-মৃগেল, মাংসের মধ্যে ব্রয়লার সব সময় এবং মাঝে মধ্যে গরু-খাসির মাংস রান্না করা হয়। করোনার আগে হলগুলোতে শুধুমাত্র ২২ ও ২৫ টাকার টোকেন দেওয়া হতো। গত বছর ক্যাম্পাস খোলার সঙ্গে সঙ্গে খাবারের দাম বাড়ানো হয়। দাম বাড়লেও কমে যায় খাবারের মান। বর্তমানে খাবারের মেন্যু ভেদে ২২, ২৫, ৩০, ৩৫, ৪০ খাবারের টোকেন বিক্রি করা হয়। ২২ টাকার খাবারের মধ্যে থাকে পাংগাশ মাছ, ছোট রুই অথবা মৃগেল মাছ। এক টুকরো মাছের সঙ্গে সবজি হিসেবে বেশিরভাগ সময় দেওয়া হয় আলু, লাউ/পেঁপে। এর সঙ্গে কোনো ভর্তা-ভাজি দেওয়া হয় না। ভর্তা, ভাজি কিংবা সবজি খেতে চাইলে অতিরিক্ত গুণতে হয় পাঁচ টাকা। ৩০ টাকা মূল্যের খাবারে ভাজি/ভর্তার সঙ্গে এক  ব্রয়লারের মাংস ও এক টুকরোআলু দেয়া হয়। মাংসের সাথে বিকল্প হিসেবে মাছ, ডিমও রাখা হয়। ৩৫ টাকার খাবারে মাঝারি সাইজের রুই মাছের সঙ্গে আলু, বেগুন/মিষ্টি কুমড়া/শীতকালীন সবজি দেওয়া হয় এবং বিকল্প হিসেবে ব্রয়লার মুরগির মাংস দেওয়া হয়। ৪০ টাকার খাবারে বড় রুই/মৃগেল মাছ এবং বিকল্প হিসেবে ব্রয়লার মুরগি ভুনা দেওয়া হয়। মাঝে মধ্যে গরু-খাসির মাংস রান্না করলে দাম রাখা হয় ৫০-৬০ টাকা। ছাত্রীদের হলের মেন্যুও প্রায় কাছাকাছিই থাকে।

মেন্যু ভেদে খাবারের দাম ঠিক করলেও খাবারের মানের প্রশ্ন থেকেই যায়। শিক্ষার্থীদের অভিযোগ মাছ এবং ভাজিতে যেসব সবজি দেওয়া হয়, সেগুলোতে পুষ্টিগুণ একেবারে নেই বললেই চলে। যেসব সবজি দুই থেকে চারদিন আগের, সে সবজিগুলোই ডাইনিংয়ে নিয়ে আসা হয়। পুরোনো বাসি সবজি রান্না করলে অনেক সময় সেদ্ধও ঠিকঠাক হয় না। তাছাড়া মাছ, মাংসগুলোও তেমন ভালো মানের দেওয়া হয় না। অনেক সময় নষ্ট মাছ তেলে শক্ত করে ভেজে তরকরিতে দেওয়া হয় বলে অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। অভিযোগ সম্পূর্ণ সত্য নয় দাবি ডাইনিং ম্যানেজারদের। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী বাজারের বিভিন্ন দোকানিদের কাছে এর সত্যতা পাওয়া যায়।

এতো গেলো সবজির কথা। এবার আসা যাক ভাত এবং ডালের ব্যাপারে। চালের দাম বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে হলে কমে গেছে ভাতের মান ও পরিমাণ। শিক্ষার্থীদের অভিযোগের ভিত্তিতে ডাইনিংয়ে দেখতে গেলে মেলে সত্যতা। টেবিলে বড় গামলার মধ্যে রাখা ভাতগুলো অত্যন্ত নিম্নমানের চালের। ভাত টিপ দিয়ে দেখা যায়, ওপরে একদম নরম ভেতরে শক্ত। রান্নার পর ২০ মিনিট পার হয়ে গেলেই এ ভাত আর খাওয়ার মতো থাকে না। আবার কিছু ভাত থাকে একেবারেই শক্ত এবং গন্ধযুক্ত। কমমূল্যের এসব চাল কিনে চালানো হচ্ছে ডাইনিং।  
অন্যদিকে আবাসিক হলগুলোর ডাইনিংয়ে গড়ে ৩০০ শিক্ষার্থীর জন্য রান্না করা হয় মাত্র এক কেজি ডাল। গামলা ভরা পানিতে হলুদ আর তেলের পাতলা স্তর দেখে বোঝার উপায় নেই, তা ডাল নাকি থালাবাটি ধোয়া পানি।

বিশ্ববিদ্যালয়ের লালন শাহ হলের ডাইনিংয়ে গত ১৬ সেপ্টেম্বর সারাদিনে মোট দেড় হাজার শিক্ষার্থী খেয়েছেন। ওইদিন সেখানে ডাল রান্না করা হয় পাঁচ কেজি। তার মধ্যে সকালে এক কেজি, দুপুরে দুই কেজি এবং রাতে দুই কেজি। সে হিসাবে প্রতি কেজি ডাল খেতে হয়েছে ৩০০ জনের বেশি শিক্ষার্থীকে। ছেলেদের অন্যান্য হলেও একই চিত্র। এভাবে ছেলেদের তিন হলে গড়ে ৩০০ শিক্ষার্থীর জন্য এক কেজি করে ডাল রান্না করা হয়।

তরকারি ও ডাল রান্নায় যেসব তেল-মসলা ব্যবহার করা হয়, তা অত্যন্ত নিম্নমানের। ডাইনিংয়ে অধিকাংশ পুষ্টিগুণ সম্পন্ন তেলের পরিবর্তে ব্যবহার করা হয় অপেক্ষাকৃত কম দামি ক্ষতিকারক তেল। সয়াবিনের পরিবর্তে পামওয়েল ব্যবহারেরও অভিযোগ শিক্ষার্থীদের। তবে বরাবরের মতো অভিযোগ অস্বীকার করেছেন ম্যানেজাররা। পুষ্টিবিদদের মতে পরিণত একজন মানুষের খাবারে দৈনিক ২২০০ ক্যালরি প্রয়োজন। কিন্তু হলের খাবারে এক হাজারেরও কম ক্যালরি পাওয়া যায়। আর খাবারে আমিষ নাই বললেই চলে। বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে শরীরে প্রয়োজনীয় আমিষ ও স্নেহের ঘাটতির কারণে শিক্ষার্থীদের গবেষণা ও পড়াশোনার স্বাভাবিক চিন্তাশক্তি হারিয়ে যাচ্ছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের ফলিত পুষ্টি ও খাদ্য প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. শেখ শাহিনুর রহমান বলেন, এই বয়সে শরীরের ওজনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শিক্ষার্থীদের কার্বোহাইড্রেট, প্রোটিন, ফ্যাট, ভিটামিন, মিনারেল ও পানিজাতীয় খাবার খাওয়া উচিত। চার বর্ণের শাকসবজি ফলমূলে এ উপাদানগুলে পাওয়া যায়। এ উপাদানগুলো থেকে শরীরে ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট পাওয়া যায়। যা এন্টি-অক্সিডেন্ট উৎপাদন করে শরীরে রোগ প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে। তাজা সবজি দুই/চারদিন রেখে দিলে এর ফাইটোনিউট্রিয়েন্ট নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে এতে ই-কোলাইসহ বিভিন্ন ক্ষতিকারক ব্যাকটেরিয়া আক্রমণ করে। এসব খাবার খেলে আমাদের দেহে দুর্বল, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব, গ্যাস্ট্রিকসহ বিভিন্ন রোগের দেখা দেয়। তাছাড়া পোড়া তেলে ফ্রি-রেডিক্যাল থাকে, যা শরীরে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়।
খাবারের মানের বিষয়ে জানতে চাইলে লালন শাহ হলের ডাইনিং ম্যানেজার সাবু চৌধুরী বলেন, বাজার থেকে আমরা সব সময় টাটকা সবজি কিনে এনে রান্না করি। তবে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে আমাদের এতটা দেওয়া সম্ভব হয় না। তাছাড়া অনেকেই সবজি খেতে চান না। হল প্রশাসন শিক্ষার্থী প্রতি যে বরাদ্দ দেয়, তা নগণ্য। এ টাকা দিয়ে খাবারের মান খুব বেশি ভালো করা সম্ভব হয় না। বরাদ্দ বাড়ালে খাবারের মান বাড়বে এবং দামও কমবে।

পুষ্টিহীন খাবারের সঙ্গে সঙ্গে আবাসিক হলের ডাইনিংয়ের নোংরা পরিবেশ শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য আরো ঝুঁকিতে ফেলেছে। অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে রান্না এবং নোংরা পানিতে প্লেট ও গ্লাস পরিষ্কারসহ নানা অভিযোগ রয়েছে হলগুলোর ডাইনিংয়ে।

শহীদ জিয়াউর রহমান হলের শিক্ষার্থী রায়হান বলেন, রান্নার আশেপাশের জায়গাগুলো অপরিষ্কার থাকায় বিভিন্ন সময় খাবারের মধ্যে শামুক, পোকা-মাকড় পাওয়া যায়। রান্নায় ব্যবহার করা চাল, সবজিও ঠিকমতো ধোয়া হয় না। কোনো কোনো সময় রান্না করা সবজির ভেতর থেকেও পোকা পাওয়া যায়। নোংরা পরিবেশ ও অস্বাস্থ্যকর রান্না করা হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরের হোটেলগুলোতেও। অপরিচ্ছন্ন, অস্বাস্থ্যকর খাবার খেয়ে পেটের পীড়া, গ্যাস্ট্রিক আলসার বাধিয়ে আমাদের চিকিৎসা কেন্দ্রে যেতে হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ের চিকিৎসাকেন্দ্রের চিকিৎসক নজরুল ইসলাম বলেন, ক্যাম্পাসের খাবারে প্রয়োজনের এক-তৃতীয়াংশ ক্যালরিও থাকে না। প্রোটিন ও ফ্যাট থাকে না বললেই চলে। উল্টো এ খাবার খেয়ে স্বাস্থ্য সমস্যা ও শারীরিক দুর্বলতা নিয়ে অনেক শিক্ষার্থী চিকিৎসা নিতে আসে।

এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভোস্ট কাউন্সিলের সভাপতি ও খালেদা জিয়া হলের প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন আরা সাথী বাংলানিউজকে বলেন, দ্রব্যমূল্যে বাড়ায় ডাইনিং ম্যানেজাররা খাবারের মূল্য বৃদ্ধি করতে চাচ্ছে। তবে আমরা তাদের এখনই দাম বাড়াতে নিষেধ করেছি। খাবারের দাম না বাড়াতে পারায় হয়তো তারা খাবারের মান কমিয়ে ফেলছে। এটা প্রতিটি হল প্রশাসনের পর্যবেক্ষণ করা উচিত। বিষয়টা নিয়ে বসবো।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৮ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৩০, ২০২২
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।