ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিক্ষা

স্টাডি সেন্টারের আড়ালে ক্যাম্পাস, টিউশন ফি ৪০ লাখ!

শিক্ষা ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০২১
স্টাডি সেন্টারের আড়ালে ক্যাম্পাস, টিউশন ফি ৪০ লাখ!

ঢাকা: স্টাডি সেন্টারের আড়ালে মোনাশ কলেজের নামে শাখা ক্যাম্পাস চালাচ্ছে ইউনিভার্সাল কলেজ বাংলাদেশ (ইউসিবি)। শুধু টিউশন ফি বাবদ তিন বছরের জন্য এক শিক্ষার্থীর কাছ থেকেই নেওয়া হচ্ছে ৪০ লাখ টাকা!

এক বছর পর ক্রেডিট ট্রান্সফারের প্রলোভন দেখানো হচ্ছে।

বলা হচ্ছে, মোনাশ ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়া বা মালয়েশিয়ায় সরাসরি দ্বিতীয় বর্ষে লেখাপড়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে, যার অনুমোদন নেই এই প্রতিষ্ঠানের।

শুধু তাই নয়, প্রথম বছরের পরীক্ষায় কোনো শিক্ষার্থী যদি উত্তীর্ণ না হয় তবে মোনাশে ভর্তি না করিয়ে তাকে বিশ্বের ‘অন্য কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে’ ভর্তির অফারও দিয়েছে তারা।

ইউসিবি বলছে, স্টাডি সেন্টারের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যক্রম ও পরীক্ষার জন্য সহায়তা করা হয়। স্টাডি সেন্টার কোনো পাঠ্যক্রমও নির্ধারণ করে না। অথচ আবার তারাই বলেছে এক বছর পর ক্রেডিট ট্রান্সফার করে অস্ট্রেলিয়া বা মালয়েশিয়ায় মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সরাসরি দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হতে পারবেন শিক্ষার্থীরা। তাদের এমন স্ববিরোধী বক্তব্যে পরিষ্কার হয় যে, মোনাশ স্টাডি সেন্টারের নামে ইউসিবি মূলত বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের অনুমোদনহীন শাখা ক্যাম্পাস পরিচালনা করছে। এরইমধ্যে ৪২ জন শিক্ষার্থীও ভর্তি করিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। মোনাশ স্টাডি সেন্টারে ভর্তি হওয়া নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষার্থী জানান, এক বছর দেশে মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিষয় পড়ানো হবে তাদের। তিন বছরের জন্য ৪০ লাখ টাকা শুধু টিউশন ফি নিচ্ছে। ডিপ্লোমাসহ তিন বছরের জন্য বিভিন্ন বিষয়ে ভর্তি করানো হয়েছে। দেশে এক বছর পড়ার পর সরাসরি অস্ট্রেলিয়া বা মালেশিয়ায় গিয়ে মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দ্বিতীয় বর্ষে লেখাপড়া করা যাবে বলেও জানিয়েছে ইউসিবি।

ইউসিবির মিডিয়া রিলেশনস থেকে লিখিতভাবে জানানো হয়, শিক্ষার্থীরা এক বছর পর মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে না পারলেও, তাদের অন্য কোনো আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয় বা দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ করে দেওয়া হবে। তবে এক বছরের পড়ালেখা করার পর পরীক্ষায় উত্তীর্ণ না হলে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন প্রক্রিয়ায় তারা ভর্তির সুযোগ করে দেবে, তা নিয়ে বিস্তারিত জানায়নি ইউসিবি। এতে করে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে নেওয়া বিপুল পরিমাণ টিউশন ফি কিংবা তাদের শিক্ষাজীবন ঝুঁকিতে পড়লো কিনা এমন প্রশ্নের কোনো উত্তর দেয়নি ইউসিবি।

স্টাডি সেন্টারে কী পড়ানো হচ্ছে, বাংলাদেশে যা পড়ানো হচ্ছে তা বিদেশে পাড়ানো হবে কিনা— এসব জানতে চাইলে ইউসিবি জানায়, ইউসিবির ক্লাসে যোগদানের পর, কোনো শিক্ষার্থী একবার যখন মোনাশ প্রথম বর্ষের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়, তখন সে মোনাশ ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়া বা মোনাশ ইউনিভার্সিটি মালেশিয়ায় (শিক্ষার্থীর পছন্দ অনুযায়ী) সরাসরি দ্বিতীয় বর্ষে যোগ দিতে পারে।

ইউসিবি একবার বলেছে এক বছর পড়ার পর সরাসরি মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের অস্ট্রেলিয়া বা মালেশিয়ায় দ্বিতীয় বর্ষে ভর্তি হওয়া যাবে, আরেকবার বলেছে ক্রেডিট ট্রান্সফার করা হয় না। আবার বলেছে, কেউ এক বছরের লেখাপড়ায় উত্তীর্ণ না হলে বিদেশের অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ করে দেওয়া হবে। ইউসিবি নিজেদের স্টাডি সেন্টার বা প্রস্তুতির জন্য সহায়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে উল্লেখ করলেও সরাসরি দ্বিতীয় বর্ষে পড়ার সুযোগ দেওয়া কীভাবে সম্ভব সেটার ব্যাখ্যা নেই মোনাশের লিখিত বক্তব্যে।  বাংলাদেশে বসেই সরাসরি মোনাশ কলেজে ভর্তি হওয়া যাচ্ছে কিনা জানতে চাইলে ইউসিবি জানায়, ইউনিভার্সাল কলেজ বাংলাদেশে (ইউসিবি) অধ্যায়নের পর, শিক্ষার্থীরা একবার মোনাশের চূড়ান্ত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হলে, তারা নিশ্চিতভাবে মোনাশ ইউনিভার্সিটি অস্ট্রেলিয়া বা মোনাশ ইউনিভার্সিটি মালয়েশিয়ায় ভর্তির সুযোগ পাবে।

ইউসিবির এ ধরনের কার্যক্রম উচ্চশিক্ষা নিয়ে উপহাসের শামিল বলে মনে করছেন শিক্ষাবিদ সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন স্টাডি সেন্টারের নামে মোনাশের শিক্ষাক্রম পরিচালনা একদিকে মূল আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক, অন্যদিকে পর্যাপ্ত বিশ্ববিদ্যালয় থাকতে বাণিজ্যিকভাবে বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নামে স্টাডি সেন্টারকে ‘এক বছরের’ শিক্ষাক্রম পরিচালনার সুযোগ করে দেওয়া মানেই দেশের উচ্চশিক্ষাকে তাচ্ছিল্য করা।

জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আলমগীর বলেন, ‘যদি আমাদের উচ্চশিক্ষায় এতই দৈন্যতা দেখা দেয়, তাহলে অক্সফোর্ড বা ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব নামে শাখা ক্যাম্পাস খোলা যেতে পারে। তখন তুলনা করা যাবে। তা না করে দেশের উচ্চশিক্ষাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে ব্যবসা করার সুযোগ তৈরি করা হচ্ছে। স্টাডি সেন্টার অনেকটা কোচিং সেন্টারের মতো। এটি আমাদের প্রয়োজন আছে বলে আমার মনে হয় না। ’

ইউজিসির সদস্য অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ চন্দ বলেন, ‘স্টাডি সেন্টার ইউজিসি সমর্থন করে না। তাছাড়া ২০১০ সালের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় আইনে শাখা ক্যাম্পাস স্থাপনের কথা বলা আছে। স্টাডি সেন্টার করার কথা বলা নেই। ’

বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে ব্যবসা করার সুযোগ দিতে এটি করা হয়েছে বলে অভিযোগ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতিসহ সংশ্লিষ্টদের।

বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবির হোসেন বলেন, ‘প্রয়োজন না থাকলেও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাডি সেন্টার করা হচ্ছে। অনেক আগেই ইউজিসি মোনাশের স্টাডি সেন্টার পরিদর্শন করে বন্ধ রেখেছিল। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় অলাভজনক প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচালিত হয়। অথচ বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা এনে এদেশে চালাতে কোনো কিছুই লাগে না। একটা রুমের মধ্যে চালালেই হয়। স্টাডি সেন্টার লাভজনক প্রতিষ্ঠান। তারা তো ব্যবসা করবে, বিদেশে টাকা চলে যাবে। এসব বিষয়ে আমরা সমিতি থেকে সরকারের কাছে লিখিত আপত্তি জানিয়েছি। দরকার না থাকার পরও বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের শাখা খোলা একটি দুরভিসন্ধি। এতে উচ্চশিক্ষার সীমাহীন ক্ষতি হবে। সার্টিফিকেট বাণিজ্য বাড়বে। এটা বন্ধ হওয়া উচিত। ’

শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানায়, ২০১৪ সালের বিধিমালাটি আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হওয়ায় শিক্ষা মন্ত্রণালয় একটি কমিটি গঠন করে। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে ওই কমিটি মন্ত্রণালয়ে প্রতিবেদন দাখিল করে। প্রতিবেদন দাখিলের পর ওই বছরের মার্চে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ওই বৈঠকে কমিটি যে সুপারিশ করেছে, তা সংশোধন করে নতুন করে প্রতিবেদন জমা দেওয়ার কথা বলা হয়। বিধিমালা সংশোধনেরও উদ্যোগ নিলেও করোনা পরিস্থিতির কারণে তা চূড়ান্ত হয়নি।

আর ওই পরিস্থিতির মধ্যেই ২৫ ফেব্রুয়ারি বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি স্টাডি সেন্টার পরিচালনার অনুমতি দেওয়া হয়। অনুমতি পাওয়ার পর ইউজিসির কাছ থেকে শিক্ষা কার্যক্রমের অনুমোদন না নিয়েই শিক্ষার্থী ভর্তি করায় মোনাশ স্টাডি সেন্টার।

ইউজিসি সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, প্রতি বছর অনেক বিশ্ববিদ্যালয়ের আসন খালি থেকে যাচ্ছে। করোনার সময় পরিস্থিতি আরও নাজুক হয়ে পড়ে। অথচ এ সংকটের মধ্যেই স্টাডি সেন্টারের অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ০৮২৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ২১, ২০২১
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।