বগুড়া: সবজি খ্যাত বগুড়া জেলায় ফসলি মাঠ ফেলে রাখেন না চাষিরা। আর তাই মৌসুমি বিভিন্ন সবজি আবাদের পর এবার একযোগে নেমে পড়েছেন আগাম আলু রোপণে।
সোমবার (৯ ডিসেম্বর) বগুড়া জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-সহকারী পরিচালক মো. ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।
বগুড়া জেলায় চাষিরা ফসলি মাঠ ফেলে রাখেন না। এখন মৌসুমি বিভিন্ন সবজি আবাদের পর এবার একযোগে নেমে পড়েছে আলু চাষে। কেননা আলুতে অতিরিক্ত মুনাফা চাষিদের আকৃষ্ট করে থাকে।
বগুড়ার শাজাহানপুর, শিবগঞ্জ, নন্দীগ্রাম, শেরপুর সদরসহ প্রায় ১২টি উপজেলাতে বিস্তীর্ণ মাঠের রোপা-আমন ধানগুলো কাটা মাড়াই শেষের পথে। এখন একযোগে তাদের বিস্তীর্ণ ফসলি মাঠে বিভিন্ন জাতের আলু চাষে ব্যস্ত রয়েছেন এখানকার চাষিরা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, আলু এক প্রকার ঠান্ডা জলবায়ুর অর্থকরী ফসল। আলু চাষের জন্য বেলে দোঁ-আশ বা দোঁ-আশ মাটি সবচেয়ে উপযোগী। বাজারে এখনও আলুর দাম বেশ চরা। প্রতিবছর বগুড়ার ১২টি উপজেলায় কমবেশি আগাম আলুর চাষে মাঠে নামেন চাষিরা। এ জেলার চাষিরা রোপা আমন ধান মাঠে থাকতেই অতিরিক্ত মুনাফার আশায় তাদের সবজি আবাদি জমিগুলো ফেলে না রেখে আগেভাগেই আলু চাষ শুরু করেন।
সরেজমিনে দেখা যায়, মাঠে মাঠে চাষিরা একদিকে তাদের জমিগুলো প্রস্তুত করতে হাল দিচ্ছেন, আলগা মাটি সমান করতে জমিতে মই দিচ্ছেন, অন্যদিকে আলু বীজ বপনে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন কেউ কেউ। জেলার সর্বত্রই পুরোদমে চলছে আলুর জমি প্রস্তুতের কাজ। অনেক এলাকায় জমি তৈরির কাজ শেষ করেছেন চাষিরা। অনেকেই জমিতে আলু লাগানোর কাজও শেষ করেছেন। এবছর কিছু মুনাফালোভী ডিলারের যোগসাজশে অতিরিক্ত টাকা হাতিয়ে নিতে সিন্ডিকেট গড়ে তোলা হয়েছিল।
নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি টাকা দিয়ে বীজ কিনতে হয় বলে মন্তব্য করেন অনেক চাষি। খাওতা আলুর পাশাপাশি এ বছর বীজের দাম তুলনামূলক বেশি মন্তব্য চাষিদের।
বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার মিলাদুন্নবী নামে এক চাষি বাংলানিউজকে জানান, নভেম্বর মাসের শেষের দিকে একযোগে তার ১২ বিঘা জমিতে আলু চাষের জন্য জমি প্রস্তুতের কাজ সম্পন্ন করেন তিনি। এখন মাঠের সিংহভাগ জমিতে আলু চাষ সম্পন্ন হয়েছে। এ বছর আগে বীজ ব্যবসায়ীরা তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করেছে। বর্তমানে বাজার থেকে তারা লাল পাকরি আলুর বীজ কিনছেন প্রতিকেজি ৬৫-৭০ টাকা দরে এবং কার্ডিনাল প্রতিকেজি ৬০-৬৪ টাকা দরে। অনেক বেশি টাকায় বীজ কিনেও লাভের আশায় বুক বেধেছেন তারা। কঠোর পরিশ্রম আর অর্থ ব্যয় শেষে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছনোই এখন স্বপ্ন তার।
তিনি বলেন, আগাম মৌসুমে আলুতে ভালো দাম বেশি পাওয়া যায়। ফলন ভালো হলে অধিক মুনাফার মুখ দেখা যাবে। বীজের দাম বেশি থাকায় এবং শ্রমিকের মজুরি বাড়ায় গতবারের চেয়ে এবার আলু চাষের খরচ বেড়েছে বলে জানান এ কৃষক।
শিবগঞ্জ, সদর ও শেরপুর উপজেলার চাষি ডাবলু শেখ, কামরুল ইসলাম, সাজ্জাত মিয়া বাংলানিউজকে জানান, এ উপজেলাগুলোর সিংহভাগ জমির ধান কাটা সম্পন্ন হয়েছে। যেসব জমির ধান কাটা হয়ে গেছে বা যেগুলোতে মৌসুমি বিভিন্ন সবজি লাগালো হয় এমন জমিগুলোতে আলু চাষে ব্যস্ত সময় কাটছে চাষিদের। এ মৌসুমে আলুতে ভালো দাম পাওয়া যাবে বলে আশা করছেন তারা।
এ জেলার অনেক চাষি অতিরিক্ত মুনাফা পাওয়ার লক্ষ্যে আগাম আলু চাষ করে থাকেন। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে আলু বীজের দাম তুলনামূলক অনেক বেশি বলেও মন্তব্য তাদের। সরকারের উচিত বীজের বাজার নিয়ন্ত্রণ করা। তা না হলে চাষাবাদ করা কষ্টকর হয়ে পরবে চাষিদের জন্য।
চাষিরা অভিযোগ করে বলেন, এবার চাষাবাদের শুরুতেই সব কোম্পানি ও বিএডিসির ডিলাররা সিন্ডিকেট করে কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে বীজ আলুর (৪০ কেজি) বস্তা প্রতি ২ হাজার ৫শ’ থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত বেশি নিয়ে এসব আলু বিক্রি করেছে। অথচ স্থানীয় কৃষি অফিসের কর্তারা রহস্যজনক কারণে নীরব ছিলেন। এমনকি এই অফিসের কর্তাদের ম্যানেজ করেই অসাধু ডিলাররা এই নৈরাজ্য চালাচ্ছেন বলে দাবি করেন অনেক চাষি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-সহকারী পরিচালক মো. ফরিদুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, চলতি মৌসুমে বগুড়া জেলায় উপশী ও স্থানীয় মিলে ৫৫ হাজার ৫শ ৫০ হেক্টর জমিতে আলু চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর মধ্যে উপশী ৪৭ হাজার ৫০ ও স্থানীয় সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে চাষ করা হবে। যার মোট উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১১ লাখ ৯৩ হাজার ৬শ ১৬ মেট্রিক টন।
তিনি জানান, হেক্টর প্রতি জমিতে দেড় (১৫শ’ কেজি) মেট্রিক টন বীজের প্রয়োজন। এ হিসাবে জেলায় প্রায় ৮৫ হাজার মেট্রিক টন বীজের চাহিদা রয়েছে। ইতোমধ্যে প্রায় ৫০ হাজার হেক্টর জমিতে আলু লাগানো সম্পন্ন হয়েছে।
বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) বগুড়া আঞ্চলিক কার্যালয়ের উপ-পরিচালক (বীজ বিপণন) মো. জাকির হোসেন বাংলানিউজকে জানান, বগুড়া ও জয়পুরহাট জেলার জন্য ৬ হাজার ৪শ টন আলুর বীজের মার্কেটিং চাহিদা পাঠানো হয়েছিল। যা দেশের মোট ২২টি হিমাগারের মধ্যে ১৬টি থেকে বীজের এ চাহিদা পূরণ করা হয়েছে। চাষিদের অনেকেই নিজেরাই তাদের চাহিদা মোতাবেক বীজ বিভিন্ন হিমাগারে সংরক্ষণ করে রাখেন। বিএডিসির অধীনে বগুড়া ও জয়পুরহাট অঞ্চলে প্রায় ৫৫০ জন ডিলার রয়েছে।
তিনি বলেন, বিএডিসির ডায়মন্ড, গ্রানোলা, কারেজ, কার্ডিনাল, লেডিরোসেটা, ভুলু মিয়া ও রোজাগোল্ড জাতের এ ও বি গ্রেডের এবং এস্টারিক জাতের এ ও বি গ্রেডের প্রতি কেজি বীজ বর্তমানে ডিলার পর্যায়ে ৫৯ থেকে ৬০ টাকা ও চাষি পর্যায়ে ৬৫ থেকে ৬৬ টাকা বিক্রির দাম নির্ধারণ করা হয়েছে বলে জানান তিনি।
নির্ধারিত দামের অতিরিক্ত টাকায় আলুর বীজ বিক্রি করলে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১১, ২০২৪
কেইউএ/এএটি