ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

দেশজ ডিজাইনের স্বর্ণালংকার সংরক্ষণের মাধ্যমে জিআই সনদ নেওয়ার তাগিদ

সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৪
দেশজ ডিজাইনের স্বর্ণালংকার সংরক্ষণের মাধ্যমে জিআই সনদ নেওয়ার তাগিদ ছবি: জিএম মুজিবুর

ঢাকা: ঐতিহ্যবাহী স্বর্ণালংকার দেশের সংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ। এগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে, সমন্বয়ের মাধ্যমে একত্রিত করতে প্রয়োজন স্বর্ণালংকার ইনস্টিটিউটের।

পাশাপাশি ঐতিহ্য ধরে রাখতে নিজস্ব ডিজাইনের স্বর্ণালংকারগুলো সংরক্ষণ করতে হবে। সেসব ডিজাইনগুলো দিয়ে জিআই (ভৌগোলিক নির্দেশক) সনদ নেওয়ার তাগিদ দিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

এক সেমিনারে তারা বলেছেন, বর্তমানে দেশে বিনিয়োগের নিরাপদ জায়গা হলো স্বর্ণ খাত। জুয়েলারিশিল্পে বিনিয়োগ করা মানে ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ। দিন দিন এ শিল্পে বিনিয়োগ বাড়ছে। তাই নারীদেরও এই শিল্পের সঙ্গে সম্পৃক্ত করতে হবে। ভবিষ্যতে আমাদের দেশটা হবে স্বর্ণের একটি বড় জায়গা। যেখান থেকে স্বর্ণালংকার রপ্তানি হবে। বাংলাদেশে উৎপাদিত স্বর্ণালংকার বিদেশে রপ্তানি করতে হলে আইন বা নীতিতে কিছুর পরিবর্তন আনতে হবে। সরকার এ বিষয়ে পদক্ষেপ নেবে। একই সঙ্গে এ শিল্পে সরকার যদি ভ্যাট-ট্যাক্স কমায়, তাহলে সরকারের রাজস্ব আয়ও বাড়বে।

বৃহস্পতিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) সকালে রাজধানীর ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশন সিটি বসুন্ধরার (আইসিসিবি) নবরাত্রি হলে ‘বাজুস জুয়েলারি সামিট-২০২৪’-এর ‘আমাদের অলংকার আমাদের ঐতিহ্য’ শীর্ষক উদ্বোধনী সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন।

এর আগে সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের প্রফেসর এমেরিটাস ও খ্যাতিমান চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী, ইউনেস্কো আর্টিস্ট ফর পিস ও বিশ্ববরেণ্য ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেলসহ অতিথিদের নিয়ে ফিতা কেটে তিন দিনের এ ফেয়ার উদ্বোধন করেন বসুন্ধরা গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বাজুস) প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীর।  

বাজুস প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীরের সভাপতিত্বে সেমিনারে উপস্থিত ছিলেন চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী, ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল। অতিথি হিসেবে মহিলা আওয়ামী লীগ সভাপতি মেহের আফরোজ চুমকি, বাজুসের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর মমতাজ বেগম, বসুন্ধরা গ্রুপের পরিচালক আহমেদ ইব্রাহিম সোবহান, খ্যাতিমান অভিনেত্রী রোকেয়া প্রাচী, নিউজ টোয়োন্টিফোর টেলিভিশনের প্রধান বার্তা সম্পাদক শাহনাজ মুন্নী, উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স (উই) সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। এসময় অতিথিদের সম্মাননা স্মারক তুলে দেন বাজুস প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীর।  

চিত্রশিল্পী রফিকুন নবী বলেন, নারীদের সঙ্গে স্বর্ণের সম্পর্ক বেশি। আমাদের সংস্কৃতির উপকরণগুলো বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। এগুলো সমন্বয়ের মাধ্যমে একত্রিত করতে হবে। আমরা ঐতিহ্য থেকে সরে যাওয়ায় অন্যান্য দেশ সে সুযোগটা নিচ্ছে। এজন্য আজকে কথা হচ্ছে স্বর্ণালংকার ইনস্টিটিউটের। এটা করতে পারলে আমাদের নিজস্ব যে সংস্কৃতি, পশ্চিমা সংস্কৃতির কাছে হারিয়ে যাচ্ছে সেটা সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। তাহলে আমাদের ঐতিহ্য সংরক্ষিত হবে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশটা হবে স্বর্ণের একটি বড় জায়গা। যেখান থেকে স্বর্ণালংকার রপ্তানি হবে। এজন্য একটি ইনস্টিটিউট প্রয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের এই শিল্প নিয়ে অনেক কাজ আছে। যদি ইনস্টিটিউট হয় তাহলে সবাই সেখানে যেতে পারবে৷ তবে ডিজাইনের দিকে বেশি জোর দিতে হবে। অলংকার বলতে অলংকরণ, সেটা মূলত ডিজাইন।  

ফ্যাশন ডিজাইনার বিবি রাসেল বলেন, আমার কাজ হলো যতো কারুশিল্প আছে সেগুলো দেখা। দেশের প্রতিটি জেলায় ভিন্ন ভিন্ন ডিজাইনের গহনা রয়েছে। সেগুলোকে তুলে আনতে হবে। আমি গহনা বিক্রি করে দেশের তাঁতশিল্পকে রক্ষা করছি। স্বর্ণ শুধু নারীর নয়, একটি সংসারের সম্পদ। আমি যেহেতু ডিজাইনার সেটা নিয়েই কথা বলবো, আমাদের যেটা আছে সেটাকে তুলে ধরতে হবে। প্রতিযোগী অনেক থাকবে। আমাদের নিজস্ব কিছু ডিজাইন আছে সেগুলোকে সংরক্ষণ করতে হবে। সেসব ডিজাইনের জিআই সনদ নিতে পারি।

মেহের আফরোজ চুমকি বলেন, আমি প্রথম এ ধরনের একটি মেলায় এলাম। আমি ব্যবসায়ী বা ভালো ক্রেতাও নই। তারপরও প্রতিবছর কিছু না কিছু স্বর্ণালংকার কিনে থাকি। প্রাচীনকালে ছেলেরা বেশি গহনা পরতো। জুয়েলারিশিল্পে বিনিয়োগ করা মানে ভবিষ্যতের জন্য বিনিয়োগ। গার্মেন্টস খাতে যে উন্নতি হয়েছে সেটা আশপাশের দেশগুলো থেকে অনেক এগিয়ে। তাহলে স্বর্ণে কেন আমরা পিছিয়ে থাকবো?

তিনি বলেন, আমাদের নারীরা এখন বিদেশে গিয়ে স্বর্ণালংকার কিনে থাকেন। আবার পাচারও হয়ে যাচ্ছে। সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। নারীরা নয়, পুরুষরাও এখন সুন্দর সুন্দর গহনা পরে। স্বর্ণের গ্রহণযোগ্যতা উত্তরোত্তর বাড়বে। সবার নাগালের মধ্যে যাতে আসে সে ধরনের ডিজাইন তৈরি করতে হবে।

সাবেক সংসদ সদস্য জিন্নাতুল বাকিয়া বলেন, নারীদের প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ স্বর্ণ কারিগর হিসেবে তৈরি করতে হবে। নারীরাই নারীদের কাজ ভালো বোঝে। তাই এ কাজে নারীদের সম্পৃক্ত করতে হবে। স্বর্ণের দাম বাড়লেও চাহিদা কমেনি। দিন দিন স্বর্ণের দাম বাড়ছে। তাই স্বর্ণ কিনলে লোকসান নেই। স্বর্ণ আর জমি কিনলে লোকসান হয় না। এটা বৃদ্ধ বয়সের সম্বল। তাই স্বর্ণকে নিদানের ধন বলা যায়।

কণ্ঠশিল্পী মমতাজ বেগম বলেন, তিন বছর ধরে এ মেলা হচ্ছে। বাজুসের প্রেসিডেন্টে সায়েম সোবহান আনভীরের নেতৃত্বে এগিয়ে যাচ্ছে বাজুস। দক্ষ নেতৃত্বের জন্য বাজুস যে লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে সেটা অর্জন করতে পারবে। নারীদের সম্পদ ও ভবিষ্যৎ হলো স্বর্ণ। এজন্য প্রচারের জায়গাটা আরও বাড়াতে হবে। আমাদের কাজের সুযোগ করে দেবেন। পুরোনো গহনার ব্যবহার সম্পর্কে আরও ভালো জানতে হবে।  

শাহনাজ মুন্নী বলেন, স্বর্ণ ঐতিহ্য ও পবিত্রতার একটি অংশ। গহনা নারী বা স্ত্রী ধন। গহনার প্রতি সবার আকর্ষণ চিরকাল ছিল। স্বর্ণের গহনা এখন স্মার্ট ও ফ্যাশনের। এখানে বিনিয়োগ দিন দিন বাড়ছে। কারণ বিপদের সময় কাজে লাগে। সেজন্য বিনিয়োগের নিরাপদ জায়গা হলো স্বর্ণ। এছাড়া স্বর্ণ রিসাইকিলিং করে ফ্যাশন অনুযায়ী পরিবর্তন করা যায়। বাংলাদেশের স্বর্ণালংকার বিদেশে রপ্তানি হবে, এজন্য আইনি ও নীতির কিছুর পরিবর্তন আনতে হবে। আমি আশা করছি সরকার সে অনুযায়ী পদক্ষেপ নেবে।  

বাজুসের সাধারণ সম্পাদক বাদল চন্দ্র রায় বলেন, সোনায় বিনিয়োগ আসলে একটা শক্ত কথা। কারণ আমি যখন ব্যবসায় আসিনি তখন স্বর্ণের দাম ছিল (ভরি) ১৪৫ টাকা। এখন সেই স্বর্ণের দাম দাঁড়িয়েছে এক লাখ টাকার বেশি। স্বর্ণের দাম কখনো কমবে না, বরং বাড়বে। স্বর্ণ এমন একটা ধাতু যা মানুষের মধ্যে বন্ধন সৃষ্টি করে। এটাতে ইমোশন কাজ করে। স্বর্ণই একমাত্র বিপদের সঙ্গী। রাত ২টা বাজলেও স্বর্ণ দিয়ে টাকা পাওয়া যাবে। যেটা ব্যাংক থেকে পাওয়া যাবে না।  

তিনি বলেন, আমাদের মূল বক্তব্য হচ্ছে কীভাবে আমরা এই শিল্পটাকে গড়ে তুলতে পারি। আমাদের প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীরের নেতৃত্বে গত তিন বছরে আমরা যে একটা প্লাটফর্ম তৈরি করতে পেরেছি, এটা প্রশংসার দাবিদার। আগে আমরা এরকম প্লাটফর্ম তৈরি করতে পারিনি। তবে সরকারের সহযোগিতা থাকলে রপ্তানি পর্যায়ে নিয়ে যেতে চাচ্ছি।  

বাদল চন্দ্র রায় বলেন, চামড়া ও পোশাকশিল্প রপ্তানি করছে। অথচ স্বর্ণশিল্প একটা পুরোনো শিল্প, তারপরও আমরা পিছিয়ে আছি। এখান থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। আজকে প্রধানমন্ত্রী স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখছেন। আমরাও এই শিল্পটাকে বাজুস প্রেসিডেন্ট সায়েম সোবহান আনভীরের নেতৃত্বে স্মার্ট শিল্পে নিয়ে যেতে পারবো। আর এ শিল্পে সরকার যদি ভ্যাট-ট্যাক্স কমায় তাহলে সুবিধা হয়। সরকার ভাবছে এটা করলে রাজস্ব আয় কমে যাবে। আমি জোর গলায় বলতে পারি, সরকারের রাজস্ব আয় বাড়বে।  

দেশের অর্থনীতিতে অনবদ্য ভূমিকা রাখা বাংলাদেশের জুয়েলারি শিল্পের সবচেয়ে বড় আয়োজন বাজুস ফেয়ার ১০ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলবে। প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত বাজুস ফেয়ার ক্রেতা-দর্শনার্থীদের জন্য উম্মুক্ত থাকবে।  

বাজুস ফেয়ারে প্রবেশ টিকিটের মূল্য জনপ্রতি ১০০ টাকা। তবে পাঁচ বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের টিকেট লাগবে না। এবার বাজুস ফেয়ারে ৯টি প্যাভিলিয়ন, ১৭টি মিনি প্যাভিলিয়ন ও ১৫টি স্টলে দেশের স্বনামধন্য ৪১টি জুয়েলারি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৬২৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৮, ২০২৪
জিসিজি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।