ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অর্থনীতি-ব্যবসা

বেঁধে দেওয়া দামের প্রভাব পড়েনি বাজারে

গৌতম ঘোষ, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৪২ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৩
বেঁধে দেওয়া দামের প্রভাব পড়েনি বাজারে

ঢাকা: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে রাখতে তিনটি কৃষিপণ্যের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। তবে বাজারে অস্থিরতা কমাতে ডিম, আলু ও পেঁয়াজের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য নির্ধারণ করে দিলেও রাজধানীর বাজারগুলোতে তা কার্যকর হয়নি।

মূলত অসাধু ব্যবসায়ীদের সিন্ডকেটের কারণে দাম লাগামহীনভাবে বেড়েছে। ফলে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে নিন্ম আয়ের মানুষদের।

এদিকে পাইকারি বাজারে বা আড়তে দাম না কমলে পণ্য তিনটির দাম খুচরা বাজারে কমা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন খুচরা ব্যবসায়ীরা। অন্যদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরা বলছেন, ফার্ম ও কোল্ডস্টোরেজে সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর না হলে, আমরা কীভাবে দাম কমাব? এজন্য সরকারকে আগে মূল জায়গায় বেঁধে দেওয়া দাম কার্যকর করতে হবে। পড়ে খুচরা বাজারে মনিটরিং করতে হবে।

শনিবার (১৬ সেপ্টেম্বর) রাজধানীর সুত্রাপুর, রায়সাহেববাজার, শ্যামবাজার ও নয়াবাজার ঘুরে দেখা গেছে, এই বাজারগুলোর কোনোটিতেই সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য তিনটি বিক্রি হতে দেখা যায়নি। সেখানে প্রতিকেজি আলু খুচরা মূল্য ৫০ টাকা, দেশি পেঁয়াজ মানভেদে ৮০ থেকে ৮৫ টাকা, ভারতের পেঁয়াজ ৭০ টাকা এবং ডিম আকারভেদে প্রতি হালি ৫০ থেকে ৫৩ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে।

পাইকারি বাজার শ্যামবাজারে প্রতি কেজি আলু ৪৫ টাকা আর প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৭২ থেকে ৭৪ টাকা এবং ভারতের পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬২ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। ঢাকায় ডিমের সবচেয়ে বড় আড়ৎ গুলিস্থানের কাপ্তান বাজার। সেখানে ১০০ ডিম ১১৮০ টাকায় বিক্রি হতে দেখা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, পণ্য তিনটির নির্ধারিত দর বাস্তবায়নে খুচরা বাজারে অভিযান চালিয়ে তখনই বেশি সুফল পাওয়া যাবে যখন পাইকারি বাজার, কোল্ড স্টোরেজ, ফার্ম ও আড়তদারদের ধরা হবে। সেখানে কঠোর অভিযান না চালালে নির্ধারিত দর বাস্তবায়ন করা খুবই কঠিন হবে। কারণ, এর আগে সয়াবিন ও চিনির দর বেঁধে দেওয়া হলেও তা কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

খুচরা ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার যে ডিম, আলু ও পেঁয়াজের দর নির্ধারণ করে দিয়েছে, সেটা শুনেছি কিন্তু সেই দামে কীভাবে বিক্রি করব? পাইকারি বাজারে, আড়তে এসব পণ্যের দাম বেশি। সেখানে দাম না কমলে খুচরা বাজারে কীভাবে কমবে? আড়ত থেকে যে দামে ডিম, পেঁয়াজ ও আলু কিনি তাতে সামান্য মুনাফায় বিক্রি করি। তাহলে সরকার যে দর নির্ধারণ করেছে, সে দরে কীভাবে বিক্রি করব?

অন্যদিকে শ্যামবাজার ও কাপ্তান বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ী জানান, আমরা কী করবো পেঁয়াজ আমদানিতে খরচ বেশি, দেশি পেঁয়াজের মজুদ প্রায় শেষের দিকে ফলে বেশি দামে কিনতে হচ্ছে। রাজধানীর বাজারে আলুর সরবরাহ কম কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু ছাড়ছে না। দামও বেশি নিচ্ছে, আমরা কীভাবে কম দামে দেব? আর ডিমের দাম মূলত ফার্ম পর্যায়ে বাড়ায়। সেখানে আমাদের কোনো হাত নেই। আমাদের কাছে না এসে মূল জায়গায় সরকারকে নজর দিতে হবে। সেখানে যদি দামটা নির্ধারণ করতে পারে তাহলে আমরাও সরকার নির্ধারিত দামে দিতে পারব।

রায়সাহেব বাজারের ডিম ব্যবসায়ী আবুল বাসার বাংলানিউজকে বলেন, আজকে আড়ত থেকে ১০০ ডিম ১১৮০ টাকায় কিনেছি। সে হিসেবে প্রতি পিসের দাম পড়ে ১১ টাকা ৮০ পয়সা। এর সাথে খরচ ২০ টাকা যোগ হয় তখন দাম পড়ে ১২০০ টাকা। আমরা পাইকারি বিক্রি করছি ১২৩০ টাকা। একে প্রতি হালির দাম পড়ে ৪৯ টাকা ২০ পয়সা। আর খুচরায় ১০০টি ডিম ১২৫০ টাকা বিক্রি করলে হালি ৫০ টাকা পড়ে। কিন্তু পাড়া মহল্লায় সেটা বিক্রি হচ্ছে ৫২ থেকে ৫৩ টাকা হালি।

তিনি বলেন, সরকার যে দাম নির্ধারণ করেছে, সেটা কার্যকর হতে এ সপ্তাহ লেগে যাবে। তাও আবার যদি আড়তদাররা দাম কমায় তাহলে আমরা কমাতে পারব। ডিমের মূল জায়গা হলো ফার্ম ও আড়তদার। তারা যদি ১০০টি ডিম ১১০০ টাকা দাম নেয়, তাহলে আমরা সরকারের দামে বিক্রি করতে পারব। খুচরায় ব্যবসা নেই, ব্যবসা করে আড়তদাররা।

সুত্রাপুর বাজারের খুচরা আলু ও পেঁয়াজ বিক্রেতা বলরাম সাহা বাংলানিউজকে বলেন, আজকে দেশি পেঁয়াজ প্রতি কেজি ৭২ থেকে ৭৪ টাকা কিনে বিক্রি করছি ৮০ টাকায়। ভারতীয় পেঁয়াজ ৬০ থেকে ৬২ টাকায় কিনে বিক্রি করছি ৭০ টাকায়। এরমধ্যে প্রতি কেজিতে আমাদের ২ টাকা খরচ রয়েছে। আর আলু ৪৬ টাকা কিনে ৫০ টাকা দরে বিক্রি করছি। আলুর দাম সরকার ঘোষণা দেওয়ার পর এক টাকা বেড়েছে। আর পেঁয়াজের দাম আগেই কেজিতে ১০ টাকা কমেছে। ১৫ দিন আগেও পেঁয়াজ ৯০ থেকে ৯৫ টাকা কেজি বিক্রি করেছি।

দাম বাড়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, শ্যামবাজারে আলুর আমদানি কম। আর কৃষকের কাছে পেঁয়াজ নেই, সব চলে গেছে বড় ব্যবসায়ীদের হাতে। একই সঙ্গে দেশি পেঁয়াজের মৌসুমও শেষের দিকে। ব্যবসায়ীরা বেশি দামের আশায় পেঁয়াজ পচাবে কিন্তু ছাড়ছে না। সরকার যদি বাজার তদারকি ভালোভাবে করে তাহলে দুই-তিন দিনের মধ্যে দাম কমে আসবে। তবে মনিটরিং করতে হবে বড় বড় ব্যবসায়ীদের ও কোল্ড স্টোরে। তাদের প্রেসার দিলে কাজ হবে। আমাদের প্রেসার দিলে আমরা লাভ না হলে বিক্রি বন্ধ করে দেব। কিন্তু এতে কী লাভ হবে? তাই সরকারকে জায়গা মতো বলপ্রয়োগ করতে হবে। তাহলে আমরাও সরকার নির্ধারিত দামে পণ্য বিক্রি করতে পারব।

শ্যামবাজারের ইয়াসীন বাণিজ্যালয়ের পাইকারি আলু ব্যবসায়ী সুজন সাহা বাংলানিউজকে বলেন, রাজশাহী থেকে সর্বশেষ কেনা আলুর দাম পড়েছে প্রতি কেজি ৩৮ টাকা ৪০ পয়সার মতো। এরপর পরিবহন ও শ্রমিকের খরচ আছে। তাতে ৪০ টাকার নিচে পাইকারিতে আলু বিক্রি করা যাচ্ছে না। মোকামে দাম বেশি থাকায় বাড়তি দরে আলু কিনতে হচ্ছে। তবে আলুর সরবরাহ স্বাভাবিক আছে।

তিনি বলেন, বিক্রমপুরের প্রতি বস্তা আলু (৬০ কেজি) ২৩০০ টাকা, যা প্রতিকেজির দাম পড়ে ৩৮টাকা। আর রাজশাহীর প্রতিবস্তা (৬৫ কেজি) ২৬০০ টাকা। প্রতিকেজির দাম পড়ে ৪০ টাকা। গত কয়েক তিন ধরে বাজারে আলুর সরবরাহ কম। যেখান প্রতিদিন শ্যামবাজারে ১০টি গাড়ি আসতো, সেখানে ৩টি আসছে। কোল্ড স্টোরেজ থেকে আলু ছাড়ছে ধীরে। মূলত বড় ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে দাম বাড়াচ্ছে। এই কোল্ড স্টোরেজে গিয়ে আলু ছাড়ার ব্যবস্থা করতে হবে এবং সেখানে সরকার নির্ধারিত দাম কার্যকর করতে হবে তাহলে দাম কমে যাবে।

শ্যামবাজারের সাদাফ বাণিজ্যালয় মালিক সাগর হোসেন বাংলানিউজে বলেন, আমরা সরকার নির্ধারিত দামে বিক্রি করব, কিন্তু সরকারকে সরবরাহ বাড়াতে হবে। সরবরাহ থাকলে দাম অটোমেটিক কমে যাবে। দাম কমাতে হলে সরকারকে আমাদের কাছে না যারা, চাঙ্গের মালিক তাদের কাছে যেতে হবে। মাঠ পর্যায়ে যেসব অঞ্চলে পেঁয়াজ উৎপাদন বেশি হয় সেখানে যেতে হবে। আমাদের তো কোনো সমস্যা নেই। দাম বাড়লেও আমাদের কমিশন ৩০ পয়সা, কমলেও একই থাকছে।

কাপ্তান বাজারের পাইকারি ডিম ব্যবসায়ী অগর মন্ডল বলেন, খামার থেকে এখন ডিম কম আসছে। ডিমের সরবরাহ কম, এ কারণে দাম বেড়েছে। কম দামে আনতে পারলে ভোক্তাদের কম দামে ডিম দিতে পারব। আমরা তো খামারিদের কাছ থেকে কম দামে আনতে পারছি না, মুরগির খাবারের দাম বৃদ্ধির পর যাতায়াত ভাড়া বেড়েছে। ফলে খামারিদেরও ডিম বাড়তি দামে বিক্রি করতে হচ্ছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ পোলট্রি ইন্ডাস্ট্রিজ অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব খন্দকার মো. মোহসিন বলেন, দেশে জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরের দিকে ডিমের দাম বাড়তি থাকে। তবে সরকার ডিমের যে দর নির্ধারণ করে দিয়েছে, সে দরে আমরা ডিম বিক্রি করতে পারব যদি আমাদের শুধু ডিম বিক্রি করার জন্য সরকার একটা জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয়। তাহলে ডিম বেশি হাতবদল হবে না। এতে খরচ কমবে।

প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তর জানিয়েছে, একটি ডিমের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ৫০ পয়সা হলে খুচরা বাজারে তা ১২ টাকার বেশি হওয়ার কথা নয়। এ হিসেবে এক হালি ডিমের দাম হয় ৪৮ টাকা। কিন্তু বাজারে তা বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। সূত্র জানিয়েছে, ডিমের বাজারে কারসাজির মাধ্যমে অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি করে বাড়তি মুনাফা করায় ছয় কোম্পানি ও চার বাণিজ্যিক অ্যাসোসিয়েশনকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এদের বিরুদ্ধে মামলা করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশন। একই অবস্থা আলুর ক্ষেত্রেও। বেশি মুনাফার আশায় ব্যবসায়ীরা হিমাগার থেকে আলু বের করছেন না।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ কোল্ড স্টোরেজ অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি মোস্তফা আজাদ চৌধুরী বলেছেন, যেসব ব্যবসায়ী আলু সংরক্ষণ করেছেন, তারা দাম বাড়াচ্ছেন। খুচরা বাজারে আলুর দাম ৩৬ টাকা কেজির বেশি হওয়া উচিত নয়।

তিনি বলেন, বাজার তদারকিতে সরকারের গাফিলতি আছে। তদারকির নামে সরকারি কর্মকর্তারা ফোন করে আলুর বাজারের তথ্য নিচ্ছেন, সরাসরি বাজারে গিয়ে খোঁজ নেন না। বিশেষ করে হিমাগারগুলোতে সরাসরি তদারকি না করলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না।

প্রসঙ্গত, দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি হঠাৎ করে অনেক বেড়ে গেছে। গত আগস্টে সার্বিক খাদ্য মূল্যস্ফীতি হয়েছে ১২ দশমিক ৫৪ শতাংশ। জুলাইয়ে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৭৬ শতাংশ। অর্থাৎ, আগস্টে খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেড়েছে ২ দশমিক ৭৮ শতাংশ। এ অবস্থায় গত বৃহস্পতিবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ‘নিত্যপ্রয়োজনীয় কৃষিপণ্যের উৎপাদন, চাহিদা ও মূল্য পরিস্থিতি পর্যালোচনা’ শীর্ষক বৈঠকে আলু, পেঁয়াজ ও ডিমের দর নির্ধারণ করে দিয়েছে। বেঁধে দেওয়া দর অনুযায়ী,  খুচরা পর্যায়ে প্রতিটি ডিমের দাম হবে সর্বোচ্চ ১২ টাকা অর্থাৎ এক হালি ৪৮ টাকা, প্রতি কেজি আলু ৩৬ টাকা এবং দেশি পেঁয়াজ ৬৫ টাকা। কিন্তু দর বেঁধে দেওয়ার দুই দিন পরেও শনিবার বাজারে গিয়ে নির্ধারিত দরে কোনো পণ্য বিক্রি হতে দেখা যায়নি।

বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি বলেছেন, ডিম, আলু ও দেশি পেঁয়াজ সরকার নির্ধারিত দামের চেয়ে বেশি দরে বিক্রি করলে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম যাতে সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে থাকে সে জন্য চেষ্টা করা হচ্ছে।

সরকারের বিপণন সংস্থা ট্রেডিং করপোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি) প্রতিদিন রাজধানীর খুচরা বাজার মনিটরিং করে একটা প্রতিবেদন তৈরি করে। বৃহস্পতিবারের প্রতিবেদনেও তারা এসব পণ্য বেশি দামে বিক্রির তথ্য তুলে ধরে। সংস্থাটির তথ্য বলছে, বৃহস্পতিবার বাজারে ফার্মের বাদামি ডিম প্রতি হালি ৫০ থেকে ৫৩ টাকা, আলু ৪৪ থেকে ৫০ টাকা, দেশি পেঁয়াজ ৭০ থেকে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও বাজারে প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৮০ থেকে ৯০ টাকা কেজিতেও বিক্রি হতে দেখা গেছে।

বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৭ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ১৬, ২০২৩
জিসিজি/এমজেএফ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।