ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ক্রিকেট

পাকিস্তানের ‘কুদরত’ বনাম ইংল্যান্ডের ‘প্রসেস’ 

মাহমুদুল হাসান বাপ্পি, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট (স্পোর্টস) | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২১৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২২
পাকিস্তানের ‘কুদরত’ বনাম ইংল্যান্ডের ‘প্রসেস’  সংগৃহীত ছবি

১৮৫৩ সালের মার্চের ঘটনা। অস্ট্রেলিয়া সরকার ঠিক করলো রেললাইন করবে তারা, সেটা গেল মেলবোর্ন ক্রিকেট ক্লাবের মাঠের ওপর দিয়ে।

অগত্যা তাদের সরে আসতে হলো নিজেদের জায়গা থেকে, তৈরি হলো মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ড। এরপর ক্রিকেট ইতিহাসের বড় অনেক ঘটনারই সাক্ষী হয়েছে এমসিজি।

ইমরান খান ‘নায়ক’ হয়ে গিয়েছিলেন ১৯৯২ সালের মার্চে পাকিস্তানকে বিশ্বকাপ জিতিয়ে। ১৮৮৭ সালে প্রথম টেস্ট হয়েছিল এই মাঠে, তাও ওই মার্চেই। শুধুই কি ক্রিকেট? ভিক্টোরিয়া বা অস্ট্রেলিয়ার ফুটবল লিগের ফাইনাল হয়েছে অসংখ্য, এমসিজি সাক্ষী ১৯৫৬ অলিম্পিকেরও।

সময় বদলে ক্যালেন্ডারে পাল্টে গেছে শতাব্দী। ২০২২ সালের নভেম্বরে এসে মেলবোর্ন ক্রিকেট গ্রাউন্ডে হতে যাচ্ছে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের ফাইনাল। টেস্ট ক্রিকেটের ধৈর্যের পরীক্ষার গোড়াপত্তন যেখানে, সেখানে বসছে ‘মারমার, কাটকাট’ ফরম্যাটের সেরার লড়াই; ইংল্যান্ড-পাকিস্তানের।  

দুই দল আলাদা পথচলায় পাড়ি দিয়ে এসেছে পুরো টুর্নামেন্ট। পাকিস্তানের যাত্রা ব্যাখ্যা করতে পারবে, এমন সবচেয়ে উত্তম শব্দটি দলটির কোচ ও কিংবদন্তি স্পিনার সাকলায়েন মুশতাক বলেছেন বিশ্বকাপের ঠিক আগের ইংল্যান্ড সিরিজের সময়।  

তৃতীয় টি-টোয়েন্টির পর পাকিস্তানের ছন্দ হারানো আর ফিরে পাওয়ার ‘গোলকধাঁধাঁ’ নিয়ে প্রশ্ন গিয়েছিল সাকলায়েনের কাছে। তিনি জবাব দিয়েছিলেন, ‘কুদরাত কা নিজাম’ বলে। উর্দুতে বলা কথাটির অর্থ ‘প্রকৃতির ইচ্ছে’ বা এমন।  

তার বলা ওই কথা পড়ে ছড়িয়ে পড়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। কারণ বা প্রেক্ষাপট অবশ্য তৈরি করেছে পাকিস্তানই। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে হার অবধি হজম করা যায়। কিন্তু তারা কি না হেরে বসেছিল জিম্বাবুয়ের কাছেও!

ভাগ্য এরপর আর নিজেদের হাতে থাকেনি পাকিস্তানের। তবে কুদরত বা ভাগ্য ছিল তাদের পক্ষে। অবিশ্বাস্যভাবে দক্ষিণ আফ্রিকা হেরে বসলো নেদারল্যান্ডসের কাছে। এরপর কেবল বাংলাদেশকে হারাতে হতো বাবর আজমদের, তারা করেছেন স্বাচ্ছন্দ্যে।

কিন্তু সেমিফাইনাল? টুর্নামেন্টের সবচেয়ে ছন্দে থাকা দল নিউজিল্যান্ডের সামনে ছিল তাদের। এবার কুদরত বা প্রকৃতির সঙ্গে নিজেরা পারফর্ম করলো পাকিস্তান। ব্যাটে, বলে, ফিল্ডিংয়ে তাদের যেন ভালো অর্থে চেনা দায় হয়ে পড়লো। নিউজিল্যান্ডকে আরও একবার বিদায় নিতে হলো শিরোপা সুবাস পাওয়ার কাছে গিয়েও।

পাকিস্তান অবশ্য এখনও ভরসা রাখছে ‘কুদরত কা নিজামে’। বাবর আজম অকপটেই ম্যাচের আগে বলে যান সংবাদ সম্মেলনে, ‘আমরা আল্লাহতে বিশ্বাস করি...তিনিই আমাদের ফাইনাল জেতাবেন। ’ বাবরকে সংবাদ সম্মেলনে এক সাংবাদিক প্রশ্ন করতে গিয়ে বলেছিলেন, ‘বাবর আজম থেকে ফতেহ আজম (জয়ী নেতা) হওয়া থেকে আর এক ধাপ দূরে আছেন আপনি...’। ভাগ্য আরেকবার মুখ তুলে চাইলে বাবর তা হতে পারবেন কোনো সন্দেহ ছাড়াই।

তবে প্রকৃতি তো আর হাতে তুলে দিয়ে যাবে না। এক্ষেত্রে পাকিস্তানের মূল ভরসা পেস। শাহিন শাহ আফ্রিদির চার ওভারের স্পেল যেকোনো দলের জন্য ভয়ঙ্কর, ইংল্যান্ডের জন্যও ব্যতিক্রম নয়। হারিস রউফ-নাসিম শাহরাও কম যান না।  

ব্যাটিংয়ে পাকিস্তানের ‘অ্যাপ্রোচে গলদ’ দেখেন অনেকে। তারা তা মনে করেন না। বাবর আজম-মোহাম্মদ রিজওয়ানের উদ্বোধনী জুটি আস্তেধীরে ভিত্তিপ্রস্তর গড়ে দেবে, এর ওপর দাঁড়িয়ে রান তুলবেন বাকিরা। পাকিস্তানের ব্যাটিং মোটা দাগে এই। মোহাম্মদ হারিস-শাদাব খানরা পারফর্ম করলে জিতবে তারা, নয়তো বেশির ভাগ সময় নিয়তি হার।

এই জায়গায় এগিয়েই নামবে ইংল্যান্ড। বিশ্বকাপ যাত্রায় তাদেরও পাড়ি দিতে হয়েছে লম্বা পথ। অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ম্যাচ ভেসে গিয়েছিল বৃষ্টিতে, হারতে হয়েছে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষেও। তবুও তাদের স্মৃতিতে সবচেয়ে তরতাজা সেমিফাইনাল।

ভারতের ১৬৯ রানের লক্ষ্য তাড়া করতে অ্যালেক্স হেলস-জশ বাটলারই যথেষ্ট ছিলেন সেদিন। ম্যাচের পর বাটলার বেশ তৃপ্তি নিয়েই মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘আমাদের এগারো নম্বর ব্যাটার কিন্তু আদিল রশিদ!’ মূলত নিজেদের ব্যাটিংয়ের গভীরতাই বুঝিয়েছেন তিনি।

ইংল্যান্ডের ক্রিকেট এখন আলাদাভাবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। নিজস্বতার ছাপ তারা রাখছে সবকিছুতে। সবচেয়ে বেশি মেনে চলেছে ‘প্রসেস’ বা প্রক্রিয়া। তাদের কৌলিন্য ভেঙে মানিয়েছে আধুনিকতা বা বাস্তবতায়। ‘প্রক্রিয়া’ ইংল্যান্ডকে সাফল্যও এনে দিয়েছে ওয়ানডেতে। বাটলার এখন ইয়ন মরগ্যানের মতো টি-টোয়েন্টিতে আনতে পারবেন কি না, ইংলিশদের লড়াইটা এখানেই।

বাটলার অবশ্য ফাইনালের আগে হয়ে থাকলেন বেশ নমনীয়। পাকিস্তান দলকে নিয়ে বললেন, ‘পাকিস্তান দুর্দান্ত দল, তাদের মানসম্পন্ন পেস বোলার তৈরির দীর্ঘ ইতিহাস আছে। রোববার আমরা যে দলের বিরুদ্ধে খেলছি তা আলাদা নয়। ’

বাবর আজমও ব্যতিক্রম নন। মনে করিয়ে দিয়েছেন প্রতিপক্ষের শক্তি, ‘ইংল্যান্ড ভালো দল, তাদের অনেক ভালো খেলোয়াড় আছে। তাদের ভালো পেসার ও ব্যাটসম্যান আছে। আমরা আমাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করব আর দারুণ একটি ম্যাচের অপেক্ষায় থাকব। ’

পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ যতই থাকুক ম্যাচের আগে- অনুমিতভাবেই মাঠের লড়াইয়ে ছাড় দেবেন না কেউ। তবে তাতে বাঁধা হতে পারে বেরসিক বৃষ্টি। মেলবোর্নের আবহাওয়া নিয়ে সুসংবাদ তেমন পাওয়া যাচ্ছে না, অবশ্য আছে রিজার্ভ ডে।

এমসিজি টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম ম্যাচের সাক্ষী হয়েছে। দেখেছে ইমরান খানের নায়ক হওয়াও, ওই বিশ্বকাপের সঙ্গে এবার সবই মিলে গেছে বাবরদের। এখন শুধু হারাতে হবে পাকিস্তানকে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে সামরিক অফিসারদের মধ্যে প্রথম ম্যাচ হয়েছিল মেলবোর্নে। এই মাঠেই বাবর আজম ইমরান খান হয়ে উঠবেন, নাকি বাটলার ইয়ন মরগান; যতই বৃষ্টি থাকুক, তা দেখতে নিশ্চয়ই ক্রিকেট বিশ্বের রোমাঞ্চ কমছে না!

বাংলাদেশ সময়: ২১৩৮ ঘণ্টা, নভেম্বর ১২, ২০২২
এমএইচবি/এমএইচএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।