ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বইমেলা

‘উইথআউট বর্ডার’ 

নয়নের আলোয় দেখি বর্ডারলেস বিশ্ব 

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৭
নয়নের আলোয় দেখি বর্ডারলেস বিশ্ব  উইথআউট বর্ডার

বইটির বিষয়বস্তু আগেই জানা ছিলো। তাই হোঁচট খাইনি। কিন্তু নাম দেখে অনেকেই হয়তো ভাবতে পারেন এটি হয়তো সমসাময়িক আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা কোনো বই। অথবা হতে পারে মধ্যপ্রাচ্য বা অন্যকোনো ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট নিয়ে লেখা কোনো প্রবন্ধ সমগ্রও।

আর সব শেষে লেখক হয়তো একটি শান্তিময় বিশ্বের কথা বলবেন, যেখানে তিনি ইনিয়ে-বিনিয়ে এক বর্ডারলেস রাষ্ট্রব্যবস্থার পক্ষেই সাফাই গাইবেন। যেখানে রাষ্ট্র হবে উইথআউট বর্ডার তথা একটি ‘গ্লোবাল ভিলেজ’ মাত্র।

 

আদমসন্তানরা ওই সীমানাবিহীন গ্রামে অবাধে  যাতায়াত করবেন। বিজিবি, বিএসএফসহ বিশ্বের অপরাপর দেশের সব সীমান্তরক্ষী বাহিনী তাদের নিজ নিজ সীমান্ত চৌকি ছেড়ে ওই গ্লোবাল ভিলেজে বড়জোর চৌকিদারের চাকরি নিতে পারেন। দেয়াল, কাঁটাতারের বেড়া, টহল, পাসপোর্ট-ভিসা, ইমিগ্রেশন-অভিবাসী বলতে কিছুই থাকবে না।  

লেখকের দাবি, তার ‘উইথআউট বর্ডার’ কোনো রাজনৈতিক বইতো নয়ই; জ্ঞানের বইও নয়। তার দাবি, এটি শুধুই একটি ভ্রমণের বই। যারা জ্ঞানপিপাসু তাদেরকে লেখক এই বই থেকে দূরে থাকতে বলেছেন। কিন্তু আমি বলি ভিন্ন কথা। ভ্রমণের বই-ই আসল জ্ঞানের বই। এখানে আরোপিত কোনো জ্ঞান থাকে না। যা থাকে তার পুরোটাই লেখকের চোখে দেখা ‘বিশ্ব দর্শন’। পাঠক আর লেখকের চোখ এখানে এক হয়ে যায়। পাঠকের শরীরটি পড়ে থাকে তার পড়ার টেবিলে অথবা শিয়রে, কিন্তু আত্মা-মন-হৃদয় পাঠকদেহ ছেড়ে অনুপ্রবেশ করে পর্যটক-লেখকের মধ্যে। এক ভ্রমণ বিষয়ক লেখাতেই এমনটি ঘটে থাকে। এখানে লেখক আর পাঠক এক হয়ে যান। কিন্তু কবি শুধু নিজের মনের কথাই বলেন আনমনে। পাঠকের কবি মন থাকলেই তা ধারণ করতে পারেন। গল্প-উপন্যাসেও তাই।   

এই বিশ্বকে দেখার-জানার জন্য ভ্রমণের চেয়ে সহজ কোনো উপায় আর নেই। সমস্ত বিশ্বকে মলাটবন্দি করে আপন দুই হাতের মাঝে সপে দিতে পারেন শুধুই একজন ভ্রমণকারী-পর্যটক। আগ্রা ফোর্টে দাঁড়িয়ে শাহজাহানের চোখে তাজমহলকে দেখাতে পারেন শুধুই একজন ভ্রমণকারী। আইফেল টাওয়ার থেকে পুরো প্যারিসকে দেখাতে অথবা পিরামিডের ভাঁজে ভাঁজে সভ্যতার পদচিহ্নের সন্ধান দিতে পারেন শুধুই একজন পর্যটক। অথবা দজলা-ফোরাতের কিনারে দাঁড়িয়ে একটি সভ্যতা গুঁড়িয়ে দেওয়ার আওয়াজ শোনাতে পারেন শুধুই একজন পর্যটক।  

‘উইথআউট বর্ডার’এর লেখক সময়ের সঙ্গে সঙ্গে বোধ করি একজন পর্যটক হয়েই গেছেন। নবকুমার এই পর্যটক দেখেছেন বিশ্বের অনেক কিছুই, গিয়েছেন বহুদেশে। তার দেখা ও অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার তার নিজস্ব বয়সকে অতিক্রম করেছে বহু আগেই। সামনে রয়েছে অনেকটা পথ। হয়তো আমরা একদিন পেয়েও যেতে পারি সৈয়দ মুজতবা আলী অথবা হালের মঈনুস সুলতানকে।   
 
লেখক তার ‘উইথআউট বর্ডার’এ তুলে এনেছেন দক্ষিণ এশিয়া অথবা আরও সুনির্দিষ্ট করে বলতে গেলে বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালের কথা। পথ চলতে চলতে লেখক কথা বলেছেন তার সহযাত্রীদের সঙ্গে। কিন্ত বর্ণনার ঢং এমন যে, মনে হবে সে আলাপ-চারিতায় উপস্থিত ছিলেন স্বয়ং পাঠকও। তাই বর্ণনাটি হয়ে উঠেছে জীবন্ত।  

লেখকের যাত্রাপথ অনেক দীর্ঘ- প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার। চারটি দেশের সাড়ে চারহাজার কিলোমিটার পথ চলতে গিয়ে তুলে এনেছেন পথের দু’ধারে সাজিয়ে রাখা মিষ্টি-মন্ডার দোকান থেকে শুরু করে ঐতিহাসিক স্থাপনা, সবুজ প্রান্তর, বিচিত্র পোশাকধারী নারী, পাহাড়-সমতল, ধবল-ধূসর বরফের প্রান্তরসহ আরও অনেক কিছু। কিন্তু একজন ভ্রমণকারী তখনই পর্যটক হয়ে ওঠেন যখন তার চোখে সবচেয়ে ভালো লাগে মানুষের সৌন্দর্যকে। বইটির লেখক মাজেদুল নয়নের লেখায় বারবার ফুঠে উঠেছে মানুষের বৈচিত্র্যময় সৌন্দর্যের কথা।  

পথ চলতে চলতে চারটি দেশের যা কিছু দেখা ও জানা সম্ভব তার পুরোটাই পাই মাজেদুল নয়নের বর্ণনায়। দুই জোড়া বাঙালি চোখে বাংলাদেশ ছাড়া বাকি তিনটি দেশের যা কিছু নতুন ও বৈচিত্রপূর্ণ মনে হয়েছে তার কাছে, এর কোনোকিছুর সঙ্গেই অবিচার করেননি। সযত্বে তুলে এনেছেন তার বইয়ে।

২০১৫ সালের ১৫ নভেম্বর ভুবনেশ্বর থেকে যাত্রা করে বিবিআইএন মটর র‌্যালি। লেখক এই র‌্যালির একজন হিসেবে বাংলাদেশ থেকে অংশ নেন। তার ভ্রমণকাহিনী মূলত এই মটর র‌্যালির ভ্রমণ অভিজ্ঞতার সমাহার। সর্বমোট ২০টি গাড়ির এ শোভাযাত্রা ভারত, নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশের প্রায় সাড়ে চার হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে। সে বছরের ০২ ডিসেম্বর এটি কলকাতায় শেষ হয়।  

এর আগে, ২০১৫ সালের জুন মাসে এই চারটি দেশের মধ্যে সড়ক পথে যাত্রীবাহী, ব্যক্তিগত ও পণ্যবাহী যান চলাচলের জন্য যে মোটরযান চুক্তি হয়, এ র‌্যালি তারই একটি ক্যাম্পেইন। বাংলাদেশে থেকে এ র‌্যালিতে ছয়জন অংশ নেন। মাজেদুল সেই ছয়জনের একজন। এ এক বিরল সৌভাগ্য ও অভিজ্ঞতা। মোট ৮০ জন যাত্রীর মধ্যে তিনজন নারীও ছিলেন।  

মোটরযানে চড়ে এরকম একটি রাষ্ট্রীয় সফরে চারটি দেশে ভ্রমণের অভিজ্ঞতাই তুলে এনেছেন নয়ন। তিনটি দেশের রূপ-বৈচিত্র্যই তুলে এনেছেন একজন পর্যটকের চোখে। মাজেদুল নয়ন যখন চেন্নাই এক্সপ্রেসের কথা বলেন, অথবা কথা বলেন অবেহেলিত বিহারবাসীদের নিয়ে, তখন তিনি ভুলে যাননি আমার দেশের মানুষের কথা। তার প্রায় প্রতিটি বর্ণনার মধ্যেই কোনো না কোনোভোবে উঠে এসেছে আমার দেশের কথা, দেশের মানুষের কথা। লেখক তার প্রথম লেখাটির নাম দিয়েছেন ‘ওই তো বাংলাদেশ’। এখানে তিনি বলেছেন, ‘এর আগে নিজের দেশটাকে এতোটা অনুভব করিনি। বুকের মধ্যে হুহু করে ওঠেনি’। একই লেখায় লেখক বলেন, ‘আমাকে ভারতীয় ভেবেই আগরতলাবাসী বলে উঠলেন, ওইতো বাংলাদেশ। চোখে পানি আসলো। হ্যাঁ, ওটাই আমার দেশ’। লেখকের ছোট এই কয়েকটি বাক্য পড়ে আমার চোখও কেন যে ঝাপসা হয়ে গেলো বুঝি না। কণ্ঠরুদ্ধ হয়ে গেলো। এটাই কি তবে দেশেপ্রম? কারণে-অকারণে দেশের জন্য, মানুষের জন্য চোখে জল আসা, বুকের মধ্যে হু হু করা? 

লেখকের পুরো বইয়ে দেখেছি দেশের প্রতি তার অকৃত্রিম দরদমাখা অনুভুতি। আর সবকিছু বাদ দিলেও এটুকুই কি যথেষ্ট নয়? তারওপর অন্যদেশের রূপ-বৈচিত্র্যতো রয়েছেই।  

বইয়ে লেখক কোনো ‘ভূমিকা’ বা ‘মুখবন্ধ’ লেখেননি। তিনি সরসারি ভ্রমণকাহিনীতে চলে গেছেন। সাধারণত, ‘ভূমিকা’য় বইটিকে কী থাকবে, কাদের কাছে কৃতজ্ঞ, কারা প্রুফ দেখেছেন, ভুল-ত্রুটি মার্জনীয় ঘরানার কিছু কথা থাকে। লেখক সে সবের ধার ধারেননি। কিন্তু পুরো বইতেই ছড়িয়ে  রয়েছে তার সেসব কথা। তাই ভিন্ন করে আর সে কথায় যাননি।

কিন্তু প্রথমেই যে সমকালীন রাজনীতি ও বিশ্বপ্রেক্ষাপটের সঙ্গে বইটির যে সম্পর্কহীনতার কথা বলেছিলাম, বইটি পড়ে সে ধারণা পাল্টে গেলো এবং এখানে লেখকের সঙ্গে আমি পুরোপুরি সহমত নই। লেখক যখন যে দেশ ভ্রমণ করেছেন তখন তুলে এনেছেন সে দেশের সমসাময়িক রাজনীতি। কিন্তু কোনোকিছুই অপ্রাসঙ্গিকভাবে তুলে আনেননি। যখন কোনো স্থানে গাড়ি থেকে নেমেছেন, তখন হালকা করে সেখানকার একটু ইতিহাস-ঐতিহ্য বর্ণনা করেছেন। সেই সঙ্গে মানুষের সাথে কথা বলে বুঝতে চেষ্টা করেছেন, তারা আমাদের সম্পর্কে কী ভাবে, আমাদেরকে কী চোখে দেখে ইত্যাদি।  
  
লেখক বইটি উৎসর্গ করেছেন বাংলাদেশর অনলাইন নিউজপোর্টালের জনক আলমগীর হোসেনকে। কেন এ উৎসর্গ তারও জবাব পেলাম লেখার পরতে পরতে। কীভাবে একজন সম্পাদক তার স্নেহের ছায়ায় আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে রাখেন তার একজন সহকর্মীকে। কীভাবে ২০ দিনের সফরের প্রতিটি গতিবিধির প্রতিমুহূর্তের খোঁজখবর রাখেন একজন সম্পাদক। লেখক এক জায়গায় বলেছেন, ২৮ নভেম্বর শনিবার দুপুর নাগাদ বাংলাদেশ সীমান্তে প্রবেশ করে সিম চালু করতেই এডিটর-ইন-চিফ আলমগীর ভাইয়ের ফোন। বললেন, ‘রাইডার ওয়েলকাম টু বাংলাদেশ’। কিন্তু বিস্ময়টা ওখানেই যখন দেখি এ সফরে লেখকের সঙ্গে তিনিও যে একজন ছায়া-সঙ্গী। সবারই তিনি তাই। কিন্তু এতেই বা বিস্ময় কেন? অভিভাবকরা তো এমনই হন।  

পুথিনিলয় থেকে প্রকাশিত বইটি মেলার ৩১২-৩১৩ নম্বর স্টলে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) পাওয়া যাচ্ছে। মেলা চলাকালীন ২৫ শতাংশ কমিশনে বইটি পাওয়া যাবে ১৩৫ টাকায়।  

বাংলাদেশ সময়: ১৩২৯ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৭
এসএনএস

** সীমান্তঘেঁষা ভারত-ভুটানের ভ্রমণকাহিনী 'উইথআউট বর্ডার'

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।