ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাহরাইন

ঝুঁকি নিয়েই মরছে বাংলাদেশিরা

জাকারিয়া মন্ডল ও মোসাদ্দেক হোসেন সাইফুল | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ১০, ২০১৫
ঝুঁকি নিয়েই মরছে বাংলাদেশিরা ছবি : বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

বাহরাইন ঘুরে: অহেতুক ঝুঁকি নেওয়ার প্রবণতাই বাহরাইন প্রবাসীদের অকাল মৃত্যুর অন্যতম কারণ বলে মনে করেন দেশটিতে বসবাসরত বাংলাদেশিদের অনেকে। একই অভিমত পারস্য উপসাগরীয় এই ছোট্ট দ্বীপরাষ্ট্রে বাংলাদেশ দূতাবাসেরও।



সরেজমিন অনুসন্ধানে জানা গেছে, রাস্তা পারাপারে অসতর্কতার কারণে বাংলাদেশিরা যেমন দুর্ঘটনার শিকার হন, তেমনি গাদাগাদি করে থাকায় অগ্নিকাণ্ড বা অন্য কোনো দুর্ঘটনায় দলগত মৃত্যুর কবলে পড়েন।

bahrain_mohidul_Islamএছাড়া কর্মক্ষেত্রে ঝুঁকিপূর্ণ কাজে বেপরোয়া হওয়ারও একটা ক্ষতিকর প্রবণতা কাজ করে বাংলাদেশিদের মন ও মগজে। কন্সট্রাকশন ফিল্ডে উঁচু কোনো ভবনে ওদের অনেকেই কাজ করে সেফটি বেল্ট ছাড়া। নিয়ম থাকলেও মোটেই হেলমেট চড়াতে চায় না মাথায়। ইঞ্জিনরুমে বিকট শব্দে কানে তালা লাগার জোগাড় হলেও ব্যবহার করে না ইয়‍ার লক।

বাহরাইনে কাজের চাপ ও দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুর হার তাই বাংলাদেশিদেরই বেশি।

পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত খবর বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, গত সোয়া দুই বছরে অন্তত ৩৫ জন বাহরাইনপ্রবাসী বাংলাদেশি অপমৃত্যুর শিকার হয়েছেন।

এদের মধ্যে এক কমিউনিটি ফ্ল্যাটে অগ্নিকাণ্ডে ১৩ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। উম আল হাসাম অঞ্চলে পিকআপ ও ট্রলারের সংঘর্ষে নিহত হন মোহাম্মদ রুবেল। জুফেরে একটি নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করার সময় নিহত হন আলম মিয়া। হিদ শিল্প এলাকায় আল-কোবাইসি নামে একটি সিমেন্ট ও কংক্রিট মিক্সিং ফ্যাক্টরিতে দুর্ঘটনায় নিহত হন চাঁদপুরের বিল্লাল হোসেন মিয়া ও শরীয়তপুরের ইউনুস শিকদার। আদলিয়ায় নির্মাণাধীন ভবন থেকে পড়ে মারা যান নির্মাণশ্রমিক মজিদ।  

রাজধানী মানামার এক বাড়িতে অগ্নিকাণ্ডে প্রাণ হারান মোশাররফ হোসেন ও জালালসহ আরো এক বাংলাদেশি। উম আল হাসামে প্রাইভেটকার চাপায় মৃত্যু হয় আবুল বাশারের। মানামা থেকে ২০ কিলোমিটার দূরে এক বাড়িতে বৈদ্যুতিক শর্ট-সার্কিট থেকে অগ্নিকাণ্ডে ১০ বাংলাদেশি শ্রমিক নিহত হন।


Bahrainbahrain_Nasimযদিও দুর্ঘটনায় অন্য দেশের অভিবাসীদের তুলনায় বাংলাদেশিদের মৃত্যু বেশি হয় বলে মানতে নারাজ বাংলাদেশ দূতাবাস।

দূতাবাসের শ্রম কাউন্সেলর মহিদুল ইসলাম তাই বলেন, এখানে প্রতি মাসে গড়ে ৫ থেকে ১০ বাংলাদেশির মৃত্যু হয়। বেশিরভাগই ন্যাচারাল ডেথ।

২০১৩ সালে ১০১ জন ও ২০১৪ সালে ৮৭ জন বাংলাদেশির মৃত্যু হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, বেশিরভাগ হার্ট অ্যাটাক। এখানকার বাংলাদেশিরা খাবার বেছে খায় না। তাই কার্ডিয়াক অ্যারেস্টের কবলে পড়ে।

তবে দুর্ঘটনাজনিত অপমৃত্যুর বাস্তবতা স্বীকার করে মহিদুল ইসল‍াম বলেন, বাংলাদেশিরা রিস্কি জব (ঝুকিঁপূর্ণ কাজ) বেশি করে। অবৈধদের মধ্যে এই রিস্কি জব করার প্রবণতা বেশি। তারা সেফটি গিয়ার ব্যবহার করতে চায় না। হেলমেট ব্যবহার করতে চায় না। সেফটি বেল্ট ব্যবহার করতে চায় না। তাদের বক্তব্য, এগুলো নিয়ে নাকি কাজ করা যায় ‍না। ইঞ্জিন রুমে ইয়ার লক ব্যবহার করতে চায় না। কানে নাকি তালা লেগে যায়। ওদের হাজার বলেও কাজ হয় না। আমরা kafayat_ullah_mollahJoynal_abedinBahrain_shafiবুঝাতে পারি না। তাই দুর্ঘটনায় বা ওয়ার্কস্টেশনে মৃত্যু হয়। কখনো কখনো সাগরেও দুর্ঘটনা ঘটে।

আহলি ইউনাইটেড ব্যাংক বাহরাইনের ডেপুটি ম্যানেজিং ডাইরেক্টর সাফকাত আনোয়ার বলেন, লো স্কিলড লেবাররাই বেশি দুর্ঘটনার শিকার হন। বাংলাদেশ থেকে অনেক আনস্কিলড লেবার এখানে আসেন। তাদের ইনকাম কমও। আবাসস্থল ভালো নয়। বাসস্থানের প্রপার মেইনটেন্যান্স নেই। একরুমে ১৫/১৬ জন থাকেন। আগুন লাগলে একসঙ্গে অনেকের মৃত্যু হয়।

তিনি বলেন, রাস্তা পারাপারে ডিসিপ্লিন না মানায় দুর্ঘটনায়ও বেশি পড়েন বাংলাদেশিরা। জেব্রা ক্রসিং মানেন না বলে পথচারী বাংলাদেশিরা দুর্ঘটনায় বেশি পড়েন।  

ন্যাশনাল ফিশ ও প্যাসিফিক গ্রুপের এমডি শফি উদ্দিন বলেন, বাংলাদেশিরা অনেক খামখেয়ালি স্বভাবের হন। তাদের আবাসস্থলের পরিবেশ ভালো না। এমন পরিবেশ থেকে উত্তরণের জন্য দূতাবাস থেকে যদি বলা হয়, ১ হাজার টাকা বেশি দিয়ে থাকো- কেউ তা শুনবে না। এখানে সবাই সিসটেম ভালো বুঝে না, বুঝতেও চায় না।

লিন্নাস গ্রুপ চেয়ারম্যান জয়নাল আবেদিন বলেন, সচেতনতার অভাবেই দুর্ঘটনায় মৃত্যু বেশি হয় বাংলাদেশিদের। বাংলাদেশিরা নিজেদের আবাসস্থলেরও পরিচর্যা ঠিকমতো করতে চায় না। রাস্তায় প্রায়শই অসতর্ক থাকে বলে দুর্ঘটনায়ও পড়ে বেশি।  

Mohammad_AyubM_A_Karimবাংলাদেশ সমাজ সভাপতি ফজলুর করিম বাবলু বলেন, মধ্যপ্রাচ্যের মধ্যে বাহরাইন ঘনবসতি এলাকা। অনেকে বাইসাইকেল নিয়ে গলি থেকে সড়কে এসে দুর্ঘটনায় পড়েন। বাংলাদেশিরা ঝুঁকি নেয় বেশি, তাই মৃত্যুহারও বেশি। কেনো ভবনে কাজ করার সময় তারা সেফটি উইপন ইউজ করে না। উপর থেকে পড়ে মারা যান।

বাংলাদেশ স্কুল অ্যান্ড কলেজ বাহরাইনের চেয়ারম্যান কেফায়েত উল্যাহ মোল্লা বলেন, দুর্ঘটনায় মৃত্যুর ঝুঁকি বেশি। কন্সট্রাকশন সাইটগুলোতে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘাট। মোটরসাইকেলে করে যারা হোম ডেলিভারির কাজ করেন তারাও দুর্ঘটনায় পড়েন।

বাহরাইন ফিন্যান্স কোম্পানির (বিএফসি) মার্কেটিং অ্যান্ড সেলস অফিসার মাজহারুল ইসলাম বাবু জানান, তারা অনেকে দুশ্চিন্তায় থাকেন। কেউ কেউ অনেক দিন ধরে দেশে ফিরতে পারেন না। চিন্তায় চিন্তায় হার্ট অ্যাটাক হয়। আর অ্যাক্সিডেন্ট তো আছেই।  

Majharul_islam_babuanamul_haq_sarkarবাহরাইন বিএনপির সেক্রেটারি প্রকৌশলী এনাম‍ূল হক সরকার এনাম বলেন, কন্সট্রাকশন সাইটে বাংলাদেশিরাই বেশি। আর এ খাতেই দুর্ঘটনা বেশি। অনেকেই মরুভূমির প্রখর রোদে কাজ করতে করতে মাথা ঘুরে পড়ে যান। এখানে প্রতি ৭ মিনিটে একটি করে দুর্ঘটনা ঘটে। বাংলাদেশিরাও অনেক দুর্ঘটনা ঘটান বা দুর্ঘটনার শিকার হন।

টেলিকমিউনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার নাসিম আহমেদ বলেন, বাংলাদেশিরা সেফটির (নিরাপত্তা) ব্যাপারে অজ্ঞ। আর এখানে অনেক বাংলাদেশি বাইসাইকেল চালান। এতে দুর্ঘটনা বেশি ঘটে। কনসট্রাকশন সাইটেও দুর্ঘটনা ঘটে।

বেসরকারি এক কোম্পানির বিক্রয় কর্মী মোহাম্মদ আইয়ুব বলেন, অনেক বাংলাদেশি জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। যেমন- বিল্ডিং কনসট্রাকশন বা ওয়ার্কশপে কাজ করেন। আর এসব কাজে ঝুঁকি তো থাকেই।

বাহরাইন যুবলীগ সভাপতি এমএ করিম বলেন, বাংলাদেশিদের দুর্ঘটনা বেশি। অনেকেই মোটরসাইকেল চালিয়ে হোম ডেলিভারি দেন। এতে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বেশি থাকে। তবে কেবল বাংলাদেশ নয়, ইন্ডিয়ার কেরালা ও অন্ধ্র প্রদেশের লোকজনও দুর্ঘটনায় পড়েন।

বাংলাদেশ সময়: ২২২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২২, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।

বাহরাইন এর সর্বশেষ