ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

এভিয়াট্যুর

কমিশন বাণিজ্যের বলি দেশীয় বৈমানিকরা

ইশতিয়াক হুসাইন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২৯ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৪
কমিশন বাণিজ্যের বলি দেশীয় বৈমানিকরা ছবি: সংগৃহীত

ঢাকা: একের পর এক বিদেশি বৈমানিক নিয়োগের মচ্ছব চলছে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সে। আর বিদেশি বৈমানিক নিয়োগের কমিশন বাণিজ্যের বলি হচ্ছে দেশীয় বৈমানিকরা।



বিমানে বৈমানিকদের শূন্য পদে দেশীয়দের নিয়োগ না দিয়ে বিদেশিদের চুক্তি ভিত্তিক নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। এতে চাকরির সুযোগ ও পদোন্নতি বঞ্চিত হচ্ছেন দেশীয়রা। বর্তমানে রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী এয়ারলাইন্সে ১০ জন বিদেশি বৈমানিক রয়েছেন। এ মাসেই নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে আরো প্রায় ১০ জন বিদেশিকে। বিমান সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।   

অনুসন্ধানে দেখা গেছে, একজন বিদেশি বৈমানিককে বেতন হিসেবে দিতে হচ্ছে মাসে কমপক্ষে ১২ হাজার মার্কিন ডলার। সর্বোচ্চ ১৬ হাজার মার্কিন ডলার পাচ্ছেন কেউ কেউ। এছাড়া হোটেল, খাওয়া, ট্রাভেলসহ বিভিন্ন সুবিধা মিলিয়ে তার পেছনে খরচ ১৮ হাজার মার্কিন ডলার। এর সঙ্গে প্রতি মাসে দু’টি টিকেট দিতে হয়।

অন্যদিকে একজন বাংলাদেশি বৈমানিক পাচ্ছেন ৮ হাজার ডলার। বিদেশি বৈমানিককে চার সপ্তাহ কাজ শেষে দুই সপ্তাহের ছুটি দিতে হয়। তিন মাসে ছুটি দিতে হয় এক মাস। বর্তমানে ৬টি বোয়িং ৭৭৭ এর জন্য ৪২ সেট বৈমানিক প্রয়োজন। একজন ক্যাপ্টেন ও একজন কো-পাইলট বা ফার্স্ট অফিসার নিয়ে একটি সেট। সে হিসেবে ৬টি বোয়িং এর জন্য প্রয়োজন ৮৪ জন বৈমানিক। আগামী বছর বিমানে যুক্ত হবে আরো দু’টি বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজ। এর পর বিমানের বহরে যোগ হবে বোয়িং থেকে কেনা চারটি ৭৮৭ উড়োজাহাজ। এসব উড়োজাহাজ চালাতে বিমানের প্রয়োজন হবে আরো শতাধিক বৈমানিক।

সদ্য অবসরে যাওয়া বোয়িং ৭৭৭ বৈমানিকদের সাত হাজার ডলারে চাকরির প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ট্যাক্স এক হাজার ২০০ ডলার দেশীয় বৈমানিকদের দিতে হবে। এই প্রস্তাবে রাজি হননি দেশীয় বৈমানিকেরা। বিমানের একাধিক সূত্রে জানা গেছে, বিদেশি বৈমানিক নিতেই দেশীয়দের কম বেতনের প্রস্তাব করা হয়েছে। মূলত কমিশন বাণিজ্যের লোভেই দেশীয়দের নিরুৎসাহিত করছেন বিমানের গুটিকয়েক কর্মকর্তা।

নিয়োগ পাওয়া অধিকাংশ বিদেশি বৈমানিকই বয়স্ক। কারণ বিদেশে অবসরের বয়সসীমা ৬৫ বছর। বাংলাদেশে এই বয়সসীমা ৫৭ বছর।  

বিমানের একজন বৈমানিক নাম না প্রকাশের শর্তে বাংলানিউজকে বলেন, দেশীয় বৈমানিকদের যে পরিমাণ অর্থ দেওয়া হয় তার প্রায় দ্বিগুণ অর্থে বিদেশি বৈমানিক নিচ্ছে বিমান। আর বিমানে কর্মরত দেশীয় বৈমানিকদের অবহেলা করা হচ্ছে। কমিশন বাণিজ্যের বলি হচ্ছে দেশের বৈমানিকরা।

দেশীয় বাণিজ্যের বলি শুধু অবসরে যাওয়া বৈমানিকরাই হচ্ছেন না, তরুণ বৈমানিকরাও হচ্ছেন। বিমানে নিয়োগ পেয়েও উড়োজাহাজ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় ট্রেনিং দেওয়া হচ্ছে না এদের।

বিমানের একাধিক কর্মকর্তা জানান, বিদেশি বৈমানিকদের কাগজে কলমে যে অর্থ দেওয়ার কথা বলা হয় তা দেওয়া হয় না। এর মধ্যে একটি অংশ কমিশন হিসেবে বিমানের কিছু কর্মকর্তাকে দিতে হয়। বৈমানিক প্রতি কমিশন দুই থেকে তিন হাজার মার্কিন ডলার।  

বোয়িং ৭৭৭ এর বৈমানিক তৈরিতে খরচ বিমানের প্রায় ৭০ লাখ টাকা। এদের অনেককেই দেড় থেকে দুই বছর চাকরি না করতেই অবসরে যেতে হয়েছে। ২০১১ সাল থেকে এ পর্যন্ত এরকম ১৪ জন বৈমানিককে অবসরে পাঠানো হয়েছে।  

এদিকে বৈমানিক সংকট সত্ত্বেও তিন বছর ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে বিমানের ৮ ক্যাডেট বৈমানিককে।

সূত্র জানায়, ২০১০ সালে বিমান ১০ জন ক্যাডেট বৈমানিককে নিয়োগ দেয়। ওই সময় আরো ১০ জন বৈমানিককে নির্বাচিত করে রাখা হয়। প্রয়োজন হলে তাদেরও নিয়োগ দেওয়া হবে -এমন শর্ত ছিল বিমানের।  

নিয়োগ পাওয়া ১০ জনকে ৬ মাসের ট্রেনিং করানো হয়। শুধু সিমুলেটর ট্রেনিংসহ দুই মাসের ট্রেনিং হলেই এরা ফার্স্ট অফিসার হিসেবে নিয়োগ পেতেন। সেই অবস্থায় ১০ জনের মধ্য থেকে ৪ জনকে সিমুলেটরে পাঠানো হয়। এদের মধ্যে দুইজন ফেল করেন। বাকি দুইজন উত্তীর্ণ হয়ে এরই মধ্যে বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজে ফার্স্ট অফিসার হিসেবে ফ্লাইট পরিচালনা করছেন। দু’জন ফেল করেছে। বাকিরাও ফেল করবে এই অযুহাত দিয়ে বাকিদের আর সিমুলেটর ট্রেনিংয়ে পাঠানো হয়নি।

বিমানের একজন বৈমানিক বাংলানিউজকে বলেন, বিমানের বৈমানিকদের এ ধরনের ফেল করার নজির নতুন নয়। পরবর্তীতে তারা পরীক্ষায় সফলভাবে উত্তীর্ণ হয়ে বিমানে চাকরি করছেন। অথচ পরীক্ষা দেওয়ার আগেই এরাও ফেল করবে- ধরনের ঠুনকো অযুহাতে ৮ বৈমানিককে তিন বছরের বেশি সময় ধরে বসিয়ে রাখা হয়েছে। তারা প্রতি মাসে বেতনও পাচ্ছেন। কিন্তু অজানা কারণে তাদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে না।      

বিমানের বক্তব্য
বিমানের ফ্লাইট অপারেশন পরিচালক ক্যাপ্টেন ইশরাত আহমেদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে বাংলানিউজকে তিনি বলেন, স্বল্প সময়ের মধ্যে দেশীয় বৈমানিক তৈরি সম্ভব হচ্ছে না বলে বাধ্য হয়েই আমরা বিদেশিদের নিয়েছি। তবে এখানে কোনো ধরনের কমিশন বাণিজ্যের সুযোগ নেই। কারণ, আমরা কোনো ব্যক্তির সঙ্গে যোগাযোগ করি না। এজেন্টের মাধ্যমে যোগাযোগ করে বৈমানিক নিয়োগ দেই।

তিনি বলেন, এখন যেসব বিদেশি বৈমানিক রয়েছেন, আগামী ডিসেম্বরের মধ্যেই তাদের সংখ্যা শূন্যতে নামিয়ে আনা হবে। এ সময়ের মধ্যে বিমানের ৮ জন ক্যাডেট বৈমানিক এবং এক হাজার ঘণ্টা ফ্লাইং আওয়ারের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন বেশকিছু বৈমানিকের ট্রেনিং শেষ হবে।    

বাংলাদেশ সময়: ১০১৮ ঘণ্টা, আগস্ট ১৪, ২০১৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।