ঢাকা, বুধবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

যাই ভেসে দূর দেশে: কবি ও কবিতার তর্জমা

জোহরা জামিলা খান  | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৭৫৯ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২১
যাই ভেসে দূর দেশে: কবি ও কবিতার তর্জমা

‘এক প্রবল বর্ষার দিনে প্যারিসে মৃত্যু হবে বৃহস্পতিবারে’-  হুবহু এই ঘটনা ঘটেছিল সিজার ভায়েহোর ক্ষেত্রে। মৃত্যুর কল্পদৃশ্য মনছবিতে এঁকে তিনি সত্যি সত্যিই গড়িয়ে যাচ্ছিলেন সেদিকে! হয়তো এলোকথন, যা কিনা কাকতালীয়- তবু মিলেও যায়! লেখক, কবি মোশতাক আহমদ অনূদিত ‘যাই ভেসে দূর দেশে’ পাঠ শুরু সিজার ভায়েহোর কবিতা দিয়ে; আগস্টের রাতে হারিয়ে যাওয়া ভাইয়ের চাঁদমুখ দেখার আকুতিতে।

কাজলা দিদিকে খোঁজার আকুতির অনুরণন যেন! পাতকুয়ো, চিলেকোঠা, ‘তুই’ সম্বোধনে মিগুয়েলের সাথে কথোপকথন- সব মিলে ঝুলে একই বিষণ্ন অনুভব জাগায়। দূরদেশি কবিতায় স্বদেশি প্রতিধ্বনি বাজিয়ে তোলাটা অনুবাদকের মুন্সিয়ানা।

জালালউদ্দিন রুমি পৃথিবীর সবচেয়ে প্রভাববিস্তারী কবিদের একজন। তিনি দারুণভাবে আলোড়িত করেছেন তাঁর চিন্তা ও দর্শন দিয়ে গোটা পৃথিবীকে। এখানে, মোশতাক আহমদ অনূদিত রুমির ‘জল ও চাঁদ’ কবিতা,
            ‘তোমার দিকে খুঁজে ফিরছি
            একটা পথ, শুধুই আমার;
            পথের সাঁকো নাড়াচ্ছি না
            জল যেমন চাঁদের দিকে
            স্বচ্ছ এবং স্থির। '

রুমিকে যত জানি, ততই মুগ্ধ হই।

এদিকে আফ্রিকার কবিতার সাথে বাংলা কবিতার কোথাও যেন অদ্ভুত রকমের মিল। তাদের আদি কবিতা মুখে মুখে রচিত; পরবর্তী সময়ে গেয়ে শোনানো, সুর লাগানো। যেন এ ভারতবর্ষেররই নানা বৈচিত্র্য-সমাহার দূরত্ব পেরিয়ে, ভাষা-উপভাষা, অগণিত আচার-কৃত্যে ফুটে ওঠে তাদের নানা বাঁকবদলে! তাদের সাহিত্যের মূল আকুতিতে মুক্তিকামী চিন্তা প্রবল হয়ে ধরা দেয়। বেঞ্জামিন মলয়েসির ‘ফাঁসির মঞ্চ থেকে’ কবিতায়- 
             ‘নিজেকে নিয়ে আমি গর্বিত...
             অত্যাচারের ঝড়-ঝঞ্ঝা শেষে
             আমার রক্তধারার বৃষ্টি নামবে
             আমার জীবনের সমূহ নির্জনতা
             উৎসর্গ করে আমি গর্বিত। ’

এ যেন আবার ঐ আমাদের সংগ্রামী ঐতিহ্যের সাথে আফ্রিকান কবিতার সমাপতন।  

অক্তাভিও পাজ- এর ‘নারী’, আর কোনো ক্লিশে নয়’ পাঠ করতে করতে তিনটি পঙক্তিতে দৃষ্টি থামে, পুনঃপাঠ হয় মনে মনে, ‘এই কবিতা সেই নারীদের জন্য/ যাদের সৌন্দর্য তাদের প্রীতি সম্ভাষণে, তাদের আচরণে; প্রসাধনচর্চিত চেহারায় নয়। ’ সাহিত্যে নোবেলজয়ী ল্যাটিন আমেরিকার অন্যতম কবির কবিতার কথা এ নগণ্য পাঠকের মনের সাথে মিলে যাবার ব্যাপারটি ভালো লাগায়। অনুবাদ যথার্থ; কিছু কিছু জায়গা তো দারুণ চুম্বকীয়! আর্জেন্টিনার কবি আলফোনসিনা স্তোর্নি। কথিত আছে, তিনি স্বেচ্ছায় সমুদ্রে ডুবে মৃত্যুবরণ করেছিলেন। 'উত্তরাধিকার' কবিতায় কারও গড়িয়ে পড়া একফোঁটা অশ্রুর ভার না-সইতে পারা, একফোঁটা নোনা বিষের স্বাদ... কবির অভিমানী, স্পর্শকাতর, বিষণ্নতায় ডুবে কবিতার আশ্রয়ে বাঁচার চেষ্টা মনে হচ্ছিল! আবার উত্তর আমেরিকান কবি রিচার্ড জোনসের 'ঘণ্টা'র প্রথমেই কবি আর ঘণ্টার কী এক অন্য একাকীত্ব অনুভবের মেলবন্ধন!
 
‘নির্জন টাওয়ারের ঘণ্টা
কবির মতোই ভাবছে বসে একলা ঘরে;'

‘উত্তর গ্রামদেশের কন্যা’ কবিতায় প্রিয় বব ডিলান লিখলেন,
               'উত্তর গ্রামদেশে মেলা দেখতে গেলে
               অস্থির বাতাস ঝাপটা দেবে চুলে---
               একদিন যাকে প্রকৃতই ভালোবেসেছিলাম
               সে কি এখনও থাকে ঐ জনপদে!'
               
হারিয়ে যাওয়া, আরাধ্য সেই কন্যার জন্য ডিলানের অনুভূতির খণ্ড খণ্ড মায়াগুলো খুব আপন, চিরচেনা যেন! তুষারঝড়ে, প্রবল শীতে ওই মেয়ের গায়ে কোট আছে কি না; চুলগুলো আগের মতো দীর্ঘ হয়ে দেহের দু'পাশে ঝরনার মতো নামছে কি না- এসব চিত্রকল্প পড়তে পড়তেই ভেসে ওঠে চোখে। উজ্জ্বল দিনে, অন্ধকার রাতে প্রার্থনা কিংবা কামনা করেছিলেন কবি সেই গ্রামীণ কন্যাকে। এ যেন 'কবিদের কোনো দেশ হয় না, নির্দিষ্ট কোনো ছক হয় না, ভাগ হয় না'- এ সত্যেরই প্রতিচ্ছবি।

'যাই ভেসে দূর দেশে' কেবল নানা ভাষায় লেখা কবিতার সাথে পরিচয় করিয়ে দেওয়া সহজপাঠ নয়; চেনা-অচেনা অনেক কবির রাইটিং স্টাইল ও সাইকি সম্পর্কিত নানা তথ্যও পেয়েছি এখানে। উন্নাসিক, বহুমাত্রিক প্রতিভাধর গিয়ম আপলিন্যারকে কী করে জানা হতো যদি দূরদেশের দীর্ঘ নৌ-যাত্রার কৌতূহলী সওয়ারি না-হতাম? একশ তিন বছর আগের কথা। আপলিন্যার তাঁর প্রথম কাব্য 'অ্যালকোহলস'র ফাইনাল প্রুফ দেখতে দেখতে সমস্ত যতিচিহ্ন মুছে ফেলেছিলেন। অন্তমিল নিয়ে তাঁর যুক্তি ছিল  লাইনের শেষে মিল দেখলে দৃষ্টি-আকর্ষণী ভঙ্গিতে কুকুরের লেজ নড়ার সাথে মিল খুঁজে পাওয়া! পনেরো বছর পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ছেপেছিলেন 'অ্যালকোহলস'।

কবি মোশতাক আহমদ বিচিত্র সব কাহিনিসহ অনুবাদ এমনভাবে সাজিয়েছেন আ্যপোলিন্যার ও অন্যান্যদের নিয়ে, বইয়ের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পড়াটা যেন একপ্রকার বাধ্যতামূলকই। পাঠ-প্রতিক্রিয়া দীর্ঘ হয়ে যাচ্ছে তাই ভেতরে ভেতরে এক দীর্ঘ পরিভ্রমণ শেষে হুট করেই চলে এলাম অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশে। কখনো  মনেও আসেনি স্লেজবাহিত কঠিন জীবন-যাপনকারী মানবকুলের কেউ কবি হতে পারেন! অবাক করা সুখপাঠ্য কবিতা লিখেছেন অ্যান্টার্কটিকার কবি ক্লেয়ার বেনন ও স্টিভ স্মার্ট।
              'যেখানে রাত্রি নেই সেখানে সময় কত?
              পা রেখেছো কি ঘড়িহীন শাদা জগতে?
              তুমি কি এখনও জেগে আছো বাপু, না কি স্বপ্নে অটল!'
              (মেরু অভিযান, স্টিভ স্মার্ট)
              
দক্ষিণ মেরুতেই যাত্রার সমাপ্তি। লেখক, কবি মোশতাক আহমদের দীর্ঘ দিনের পরিশ্রম এ অনুবাদগ্রন্থ। কবি ও কবিতা বাছাই, সাবলীল ভাষার অনুবাদ, রেফারেন্স উল্লেখ, পাতায় পাতায় ধারাবাহিকতা সব কিছুতেই গভীর যত্নের ছাপ। এ অনুবাদগ্রন্থ আরও সমৃদ্ধ হয়েছে  জাহানারা পারভীন, জি এইচ হাবীব, বদরুজ্জামান আলমগীর প্রমুখ  মতো বিদগ্ধ লেখকদের মুখবন্ধে।

যারা কবিতাপ্রেমী, যারা ডুব দিতে চান বিভিন্ন মহাদেশের কবিতায়, তারা বইটি পড়ার জন্য সংগ্রহ করতে পারেন। আশা করি, 'যাই ভেসে দূর দেশে' অবশ্যই পাঠক সমাদৃত হবে।  কবি মোশতাক আহমদকে আন্তরিক অভিনন্দন।

বই: যাই ভেসে দূর দেশে ( সকল মহাদেশের কবিতা) 
অনুবাদ: মোশতাক আহমদ
প্রচ্ছদ: নির্ঝর নৈঃশব্দ্য
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২১
প্রকাশক: চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন 
মুদ্রিত মূল্য: ৩০০ টাকা

প্রাপ্তিস্থান: নন্দন বইঘর (চট্টগ্রাম); চন্দ্রবিন্দু প্রকাশন ওয়েবসাইট ও মোমিন রোড আউটলেট (চট্টগ্রাম); 'ঘোড়াউত্রা-দেশলাই' বুকশপ (কনকর্ড অ্যাম্পোরিয়াম, কাঁটাবন, ঢাকা) এবং বইমেলা ২০২১।

বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২১
নিউজ ডেস্ক 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।