ঢাকা, বুধবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ০১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কামাল চৌধুরীর কবিতা

ছন্দের বাগানে অক্ষরের পুষ্প

ফারুক আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২১
ছন্দের বাগানে অক্ষরের পুষ্প

শুরুটা হোক কবির পঙক্তি দিয়ে, ‘ভোর; অসংখ্য পেনিকেলের ডাকে মুখরিত ভোর/ঘুমন্ত সিংহকে জাগিয়ে দিয়ে ক্যামেরার চকিত নেত্রপাতের মতো ভোর/হিপোপুলের পাশে দাঁড়িয়ে দেখা জলহস্তীর ক্রীড়াময় ভোর/পর্যটকের গাড়ি চাপা-পড়া মৃত হায়েনার চারপাশে/শোকার্ত হায়েনাদের করুণ ও ক্রুদ্ধ চোখের মতো ভোর

আক্রান্ত করার মতো একসারি চিত্রকল্পের এই কবিতার শিরোনাম ‘মাছাইমারা’, কবি কামাল চৌধুরী, কাব্যগ্রন্থের নাম ‘উড়ে যাওয়া বাতাসের ভাষা’। এটা উল্লেখিত বইয়ের শুরুর দিকের কবিতা নয়।

তবু এটাকে প্রথমে টেনে আনার কারণ, কাব্যগ্রন্থের শুরু বা শিরোনাম কবিতার দুর্ভেদ্যতা। শুরুর এই দুর্ভেদ্যতার কারণে পাঠক হিসেবে আমাকে এ বইয়ে কবির বানানো যে অনুপম জগত, সে জগতের উপমা-চিত্রকল্প, বোধে প্রবেশের আগে একটা দেয়াল ভাঙতে হয়েছে। এই দেয়াল আপাত কঠিন অথবা দুর্ভেদ্যও বলা যায়। বইয়ের শিরানাম কবিতা, একইসঙ্গে প্রথম কবিতাও ‘উড়ে যাওয়া বাতাসের ভাষা’য় প্রবেশ করতে গিয়ে এ কবিতা একাধিকবার পাঠ করতে হয়েছে। সে পাঠের প্রথমদফা, এমনকী দ্বিতীয় দফায়ও মনে হয়েছে, কবিতাটি এলোমলো কিছু শব্দ-উপমার ছড়িয়ে পড়া ছাড়া আর কিছু নয়। কিন্তু ধীরে ধীরে আবিষ্কার করা গেল, বইটার প্রবেশ পথ আসলে এই কবিতা। অথবা বলা যায় বইয়ের একটি ইঙ্গিত, সারাৎসার।  

এটা কাব্যগ্রন্থের দ্বিতীয় কবিতা 'স্বপ্ন'-র ক্ষেত্রের বলা যায়। এই দুটি কবিতা আপাত দুর্ভেদ্য, এলোমেলো, কিন্তু এ দুটা মিলে পুরো বইয়ের বা একইসঙ্গে কবির সৃজনজার্নির একটা ইঙ্গিত রয়েছে। সৃজনজার্নি, একইসঙ্গে জীবনের একটি গতিপ্রবাহের গল্পও তাতে পাওয়া যায় বৈকি। একইসঙ্গে এই দুটা কবিতা হয়ে উঠেছে কবিতার কবিতা, তেমন দুর্ভেদ্য বা নিখুঁত করে তোলার চেষ্টা, একইসঙ্গে এলোমেলো এক বির্নিমাণ, যেমনটা বোদলেয়ার, যেমনটা আর্তুর র‌্যাঁবো’র কবিতায় পাওয়া যায়। তবে এটা নয় যে বইয়ের অন্য কবিতাগুলো কম গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এখানে, শুরুতে একটা যুগপৎ সংকট এবং মুগ্ধতা ছড়িয়ে রেখেছেন কবি। সংকটটা এমন যে, এই দেয়াল পার হয়ে অনেকেই বইয়ের আস্বাদন নিতে অনাগ্রহী হয়ে উঠতে পারেন। আর মুগ্ধতা আবিষ্কারের, যখন কবিতা দুটির ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হবে। তখন মনে হবে সুত্র আবিষ্কার করা গেল। নানা পথ-উপপথের সন্ধান একেঁ এঁকে উন্মোচিত হওয়ার মতো ব্যাপার।  

যাহোকে, আলোচনা শুরু করা হয়েছে যে কবিতা দিয়ে, তার শিরোনাম ‘মাছাইমারা’। এর উপজীব্য আফ্রিকা। কবিতায় আফ্রিকা প্রসঙ্গ এলে খুব স্বাভাবিকভাবেই মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথের ‘আফ্রিকা’র কথা। রবীন্দ্রনাথ এ কবিতায় যেন পুরো একটি মহাদেশের দৃশ্য এঁকেছেন। আমাদের এই দূরের পৃথিবী থেকে দেখা চোখে তাই মনে হয়। একটি কবিতায় বিস্ময় আর বোধের এক সাঁকো তিনি রচনা করে গেছেন যেন। রবীন্দ্রনাথের 'আফ্রিকা' যেমন একটি উৎকৃষ্ট কবিতা হয়ে উঠেছে আমাদের সামনে, তেমনি ‘মাছাইমারা’। শত বছর পর এক নতুন কবির দেখা আরেক আফ্রিকাকে পাওয়া যাবে এখানে। নতুন ভাষায়, নতুন নানা দৃশ্যের সমারোহে আমরা যেন আফ্রিকার একটা সকালকে মাখিয়ে নিই আমাদের চোখে। বইয়ের অন্য কবিতার তুলনায় এটা বৃহৎ, একইসঙ্গে আফ্রিকা উপমহাদেশের মতো বহুবর্ণিল দৃশ্যের এক সমাহার এখানে প্রোথিত হয়েছে।

এই কবিতার মতো দেশ বা স্থান নিয়ে বইয়ে আরো কিছু কবিতা রয়েছে। যেমন ‘ক্লঁদ মনের বাড়ি ও বাগান’, ‘ক্লঁদ মনের সঙ্গে এক দুপুর’। এ দুটা কবিতায়ও নির্দিষ্ট স্থান, এক সৃজনশীল মানুষের প্রতি মুগ্ধতা ইত্যাদি অনুষঙ্গ টেনে এনেছেন কবি। কিন্তু পুরো বইয়ে ‘ক্লঁদ মনের বাড়ি ও বাগান’ এই একটি কবিতাকে মনে হয়েছে কবিতাকে আঁটোসাটো বাঁধনে আটকে ফেলার যে চেষ্টা, সেটা মাত্রার অংকে বা শব্দের যথাযথ ব্যবহারে, এখানে তার পতন ঘটেছে। আরেকটি কবিতা ‘মার্চ’ সেটার ক্ষেত্রেও এমনটা বলা যায়। যেন শেষ পর্যন্ত কবিতার মতো নয়, কিছু শব্দের কবিতা হয়ে ওঠার চেষ্টাটুকু পথ হারিয়েছে।

একজন কবির সব কবিতা তো অনুপম হবে না, মুগ্ধজাগানিয়া হবে না। তবে এখানে পথ এলোমেলোর দিকে গেছে। তো যাক না হয় একটি বা দুটি কবিতায়। আমরা বরং অন্য আরেকটি কবিতা পাঠ করি। এটাও ‘উড়ে যাওয়া বাতাসের ভাষা’ কাব্যগ্রন্থের। বলা যায় বইটির চতুর্থ কবিতা, শিরোনাম, ‘শেষরাতের ট্রেন’; এটা শুরু হলো এভাবে, ‘শেষরাতের ট্রেন থেকে নেমে গেছে/প্রাচীন উপকথার নায়িকারা/তাদের শাড়ির রঙে জেলেপাড়ার টেরাকোটা/সেখানে শিল্পীর হাতে ক্রমাগত ফুটে উঠছে/জাতিস্মর মাটিকন্যা- ভোরবেলাকার স্মৃতি, স্বপ্ন, কোলাহল’। এই যে কয়েকটি পঙক্তি দেওয়া হলো। এরপর আর কী বলার আছে। বরং বলা যায় এভাবে পরিক্রমণ করতে গেলে দেখা যাবে একের পর এক পঙক্তি ধরা দিচ্ছে, নানারঙে, নানারূপে এই কবির কবিতায়। ধরা যাক ‘নির্জন গ্রন্থাগার’, ধরা যাক ‘নায়াগ্রা: মেইড অব দ্য মিস্ট’। এরকম প্রায় প্রতিটি কবিতায় চিত্রকল্প, উপমা, শব্দের ব্যবহারে কবিতার এক জগৎ তৈরি হয়েছে। যা আমাদের নিয়ে যায় নতুন নতুন কম্পিত হওয়া পাঠে।

এখানে কামাল চৌধুরীর একটি কাব্যগ্রন্থের কয়েকটি কবিতার আলোচনা মাত্র। তাও বিভিন্ন কোণ থেকে নয়, খুব সাধারণ পাঠের বোধ থেকে একটি আলোচনার অবতারণা করা হলো। ২৮ জানুয়ারি ২০২১-এ তিনি ৬৪ বছর পূর্ণ করলেন। ৬৫ বছরে এসে তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের সংখ্যা ১০-এর অধিক, হিসেবে খুব বেশি নয় আবার কমও নয়। ১৯৮১ সালে প্রকাশিত প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘মিছিলের সমান বয়সী’ প্রকাশের পর দীর্ঘ বিরতি শেষে আবার যে যাত্রা, সে কাব্যযাত্রায় নিজেকে ভেঙেচুরে নতুনভাবে আবিষ্কারের ক্রমাগত চেষ্টা প্রবলভাবে দেখা যায় কবির কবিতায়। একইসঙ্গে দেখা যায়, নিজের কবিতাকে আরো নিখুঁত করে তোলার ক্রমাগত চেষ্টা তিনি করে যাচ্ছেন। ফলে এভাবে একটা সময় কম আলোচিত থাকা এই কবি দিন দিন ঔজ্জ্বল্য ছড়াচ্ছেন পরিণত বয়সে, নির্মাণ করছেন পরিণত কবিতার এক সরোবর। তাঁর এই কাব্যযাত্রা চিত্রকল্পের-উপমার এক মোহন যাত্রা হোক। যথাযথ ছন্দের বাগানে অক্ষরের দল হয়ে উঠুক একেকটি দারুণ পুষ্প সে কামনা সামনের দিনগুলোতে।

বাংলাদেশ সময়: ২০৩০ ঘণ্টা, জানুয়ারি ৩০, ২০২১
নিউজ ডেস্ক

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।