ঢাকা, রবিবার, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

লালবাগ (পর্ব-১৩)

নভেরা হোসেন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ২, ২০২০
লালবাগ (পর্ব-১৩) নভেরা হোসেন

সুখ-দুঃখ, হাসি-কান্নার মিশেলে এই জীবন। একগুচ্ছ মুহূর্তের কোলাজ।

গল্প-উপন্যাস সেই মুহূর্তগুলো ধরে রাখার উৎকৃষ্ট মাধ্যম। পুরান ঢাকার লালবাগকে যেমন সময়ের ফ্রেমে বেঁধেছেন লেখক নভেরা হোসেন। ‘লালবাগ’ একটি নভেলা। এটি ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হবে বাংলানিউজের শিল্প-সাহিত্য পাতায়। নভেলাটি পড়তে পাঠক বাংলানিউজে চোখ রাখুন প্রতি শুক্রবার ও মঙ্গলবার।

১৩
লাইলী মাঝে মাঝে সোবাহানের সাথে দেখা করতে যায় কাশিমপুরের জেলখানায়। সোবাহান ঐখানে প্রথম প্রথম খুব খারাপ সময় কাটিয়েছে। জেলের পরিবেশ ভিন্ন এক জগৎ। এক জগতের মধ্যে অন্য আরেক জগৎ। জেলখানার ভেতরটা চালায় ওখানকার নেতাগোছের কয়েদিরা, সবার নম্বর দেওয়া আছে। ওখানে সবার পরিচয় নম্বর দিয়ে। প্রথম দিকে সোবাহানের কষ্ট হয়। টাকা-পয়সা নাই, খাবারের কষ্ট, শোয়ার কষ্ট। জেলের খাবার সোবাহান খেতে পারে না গন্ধ লাগে। ধীরে ধীরে লাইলী দালালের মাধ্যমে জেলের ভেতর সিগারেট, খাবার , টাকা-পয়সা পাঠাতে থাকে। ওখানে কিছুদিনের মধ্যে সোবাহান ফেন্সির কারবার শুরু করে দেয়। বাইরে থেকে দালালদের মাধ্যমে কিছু মাল এনে বিক্রি করে। এজন্য আবার অনেককে টাকা-পয়সা দিতে হয়, কিছু লাভ থাকে।

লাইলীকে দেখে সোবাহান অবাক হয়ে যায়। দিন দিন বোনটা কেমন সুন্দর হয়ে যাচ্ছে। দামি দামি পোশাক, চুল সুন্দর করে কাটা, গায়ের রংটাও কেমন বদলে গেছে, চোখে-মুখে একটা খানদানি ভাব। এই ভাবতো ওর আগে ছিল না। সোবাহান ভাবে লাইলী কী এমন চাকরি করে? এত পরিবর্তন। কিন্তু এই বোনই ওকে জেলের ভেতরে আরাম-আয়েশের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। টাকা-পয়সা লাগলে পাঠায়। বোনকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ইচ্ছে করে না।

সোবাহান জেলে দিন গুনতে থাকে কতদিনে ছাড়া পাবে এই অপেক্ষায় থাকে। মাঝে মাঝে শাবানের কথা মনে পড়ে। শাবান কি এখনও ওর কথা ভাবে? শুনেছে ভালো ঘরে বিয়ে হয়েছে। যখন শাবানের কথা মনে পড়ে সোবাহান অস্থির হয়ে ওঠে। কেমন করে শাবান ওর পর হয়ে গেলো? ও কি পারতোনা সোবাহানের জন্য অপেক্ষা করতে? কত স্বপ্ন ছিল ওকে নিয়ে! খবিরের জন্য সব আজ শেষ হয়ে গেছে। যে ফেন্সি নিজে কোনোদিন খায় নাই তা-ই ওর নেশা হয়ে গেছে। প্রথমে অনেকটা নিজের জন্য ভেতরে ফেন্সি আনা শুরু করে সোবাহান। পরে একটু একটু করে ব্যবসা শুরু করে। জেলের হতাশাময় জীবনে এই ড্রাগ ওদেরকে ঘুম পাড়িয়ে রাখে, কিছু সময় সব ভুলে থাকে। কিন্তু নেশার ঘোর কেটে গেলেই আবার অস্থির হয়ে ওঠে। সোবাহান রংজ্বলা ঘরে একটা তক্তপোশের ওপর শুয়ে শুয়ে জেল থেকে পালানোর কথা ভাবে। কিন্তু কখনও তার সে সুযোগ আসে না।

জেলে ঢোকার পর কিছুদিনের মধ্যে এক সেন্ট্রি এসে ওকে নিয়ে যায় একটা তালাবদ্ধ ঘরে। ওখানে আরও দুজন ছিল। সবাই জেলের দাগি আসামি। সোবাহান কিছু বোঝার আগেই সেন্ট্রি সোবহানকে নগ্ন করে ওর ওপর হামলে পড়ে। দুইজন পা দিয়ে চেপে সোবহানকে বলাৎকার করে। প্রথম কিছুদিন এটা চলতে থাকে। এই ঘটনায় সোবাহানের মাথা খারাপের মতো হয়ে যায়। কিছুদিন জেলের হাসপাতালে ভর্তি থাকে। হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর থেকেই ও ড্রাগে আসক্ত হয়।

মোস্তাক লাইলীকে নিয়ে মাঝে মাঝে কক্সবাজারে যায়। ওখানে মোস্তাকের বন্ধুর এক রিসোর্ট আছে। লাইলী মোস্তাকের সঙ্গ উপভোগ করে আবার মাঝে মাঝে অসহ্য হয়ে ওঠে। জেলখানার মতো লাগে। লাইলী ভাবে পুরো জীবনটাইতো একটা কয়েদখানার মতো। মা-দাদিরা এই যে ঘরের মধ্যে বছরের পর বছর, জিন্দেগি পার করলো, তারা তো একরকম কয়েদখানার মধ্যেই ছিল। কিন্তু কই তারা তো কোনোদিন ওই জেলখানা থেকে বের হতে চায় নাই। নাকি ওরাও এই চার দেয়ালে ঘেরা ঘর থেকে বাইরে যেতে  চাইতো। কিন্তু কোথায় যাবে তারা হয়তো তা জানতো না। গেস্ট হাউসে লাইলীর প্রথম প্রথম ভালোই লাগে কিন্তু বাড়ি থেকে ফোন আসলেই মোস্তাক অস্থির হয়ে চলে যায়। তখন মোস্তাকের জন্য অপেক্ষা করতে হয়। ওই মেয়েটিও থাকে ওর লেখা-পড়ার জন্য। কিন্তু মেয়েটাকে সহ্য করতে পারে না লাইলী। মোস্তাকের সাথে ওর শারীরিক সম্পর্কের কথা মনে হলে হিংস্র হয়ে ওঠে। মোস্তাককে শাস্তি দেয়ার জন্য মাঝে মাঝে গেস্ট হাউসে  যেতে রাজি হয় না লাইলী। তখন মোস্তাক খুব খারাপ ব্যবহার করে। ফোন করে গালাগালি করে, পুলিশের কাছে ধরিয়ে দেয়ার ভয় দেখায়। বাবলুর সাথে সব যোগযোগ শেষ হয়ে যাওয়ার পর মোস্তাকের সাথে বেশ ঘনিষ্ঠ একটা সম্পর্ক হলো কিন্তু মোস্তাক তো ওকে ভালোবাসে না। শুধু শরীরের জন্য ওর কাছে আসে। লাইলী না যেতে চাইলে মোস্তাক লোক পাঠায় ওকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। লাইলী বাধ্য হয়ে যায়। ওখানে নিয়ে গিয়ে অবাধ্যতার জন্য লাইলীর উপর তখন অমানুষিক নির্যাতন চলে। সিগারেট দিয়ে ওর গায়ে ছেঁকা দেয়, নিম্নাঙ্গে সিগারেটের ছেঁকা দেয়।

কোমর থেকে বেল্ট খুলে পিটায় আর চিৎকার করে হারামজাদি তোকে এত আরামে রাখলাম, এত সুখ-স্বাচ্ছন্দ দিলাম, তোর ভাইর জন্য টাকা দিলাম। আর তুই এখন আমারে ল্যাং মারতেছিস? বল আমাকে ছাড়া আর কার কার সাথে রাত কাটাইছোস এরমধ্যে? একদম দুই টুকরা করে ফেলব।

কেন এইসবের বিনিময়ে আপনি আমাকে দিনের পর দিন ভোগ করেন নাই? মাগনা সবকিছু দিছেন?
তোর এত বড় সাহস মুখে মুখে তর্ক করিস। জানিস তোর বাপসহ তোকে লালবাগ থেকে তাড়িয়ে দিতে পারি এখন।
লাইলী দাঁতে দাঁত চেপে মোস্তাকের অত্যাচার সহ্য করে। কখনও কখনও হাতের কাছে  যা পায় ছুঁড়ে মারে। একবার মোস্তাকের দিকে ফুলদানি ছুঁড়ে মেরে কপাল ফাটিয়ে দেয়। মোস্তাক লাইলীর প্রতি খুব রুষ্ট হয়ে পড়ে। প্রথমে ওকে যেমন যত্ন করতো তা আর থাকে না। মোস্তাক একবার এক বন্ধুকে নিয়ে আসে। দুজনে মিলে সারারাত লাইলীকে উপভোগ করে। ওই ঘটনার পর লাইলী গেস্ট হাউসে যাওয়া নিয়ে গড়িমসি করতে শুরু করে। মোস্তাকের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। সিম বদল করে। মোস্তাক ওকে নেয়ার জন্য লোক পাঠায়।

লালু শেখ ভয়ে সিঁটিয়ে থাকে। লাইলী তুই কেমন কাম করিস তোকে জোর কইরা নিতে আসে কেন?
লাইলী কোনো জবাব দেয় না। ফোন করে এলাকার কিছু মাস্তান ছেলেকে ডেকে নিয়ে আসে। ওরা এসে মোস্তাকের লোকদুটিকে চলে যেতে বাধ্য করে। লালবাগে আর দেখা গেলে জীবন থাকবে না বলে হুমকি দেয়। এই ঘটনায় মোস্তাক খুব খেপে যায়। লাইলীকে তুলে নিয়ে যাওয়ার জন্য গুণ্ডা ভাড়া করে।

লাইলী ভয়ে বাসা ছেড়ে এক খালার বাসায় গিয়ে থাকে ইংলিশ রোডে। খালার কাছে খবর পায় দুবাইয়ের এক দালাল মেয়েদের চাকরি দিয়ে দুবাই নিয়ে যায়। হোটেলে ওয়েটারের চাকরি। লাইলী কিছু টাকা দেয় দালালকে। পাসপোর্ট, ভিসা করে, খালা লাইলীর জামিন হয়।

সোবাহান জানে লাইলী দুবাই যাবে। যাওয়ার আগে একবার ভাইকে দেখতে আসে। ওর চেহারা দেখে সোবাহান অবাক হয়। কেমন যেন একটা বিধ্বংসী রূপ, সবকিছু ভেঙে তছনছ করে দেবে। বেশি কথা বলে নাই।

শুধু যাওয়ার সময় বলে ভাইজান তুমি জেল থেকে বাইর হইয়া তোমার এই শাস্তির প্রতিশোধ নিবা। আমরা কি শুধু মানুষের দাসি-বান্দি হওয়ার জন্য জন্ম নিছি? মাইর খাওয়ার জন্য জন্ম নিছি? দেশ ছাইড়া যাইতেছি, আব্বা একা। তুমি বাইর হইয়া তারে দেইখো। আমি টাকা পাঠামু, নূরীর মা আব্বারে দেখব, খালা আসবে মাঝে মাঝে। তুমি ভালো থাইকো ভাই। লাইলী চোখের জল মুছতে মুছতে চলে যায়, আর পেছনে ফিরে তাকায় না। বোনের জন্য সোবাহানের মনটা হু হু করে ওঠে। জেলের বদ্ধ ঘরে ওর নিঃশব্দ বিলাপ নীরবে চাপা পড়ে থাকে।

একদিন সত্যি সত্যি লাইলী দুবাই চলে যায়। লালু শেখ মেয়ের জন্য অনেক কান্নাকাটি করে। বৃদ্ধ বয়সে একা জীবন তাকে আরও বেশি নিঃসঙ্গ করে দেয়। লালু শেখ মনমরা হয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে থাকে। পুরানো আমলের সিন্দুক খুলে নানা জিনিস দেখে। একটা বেলজিয়ামের আয়না আছে দাদির। কী সুন্দর কারুকাজ করা চারপাশে, এখনও ঝকঝক করে। আয়নাটার দিকে চোখ পড়তেই নিজের বৃদ্ধ বয়সের ভাঙাচুরা গাল, শুভ্র চুল আর ঘোলা হয়ে আসা চোখের দিকে তাকিয়ে বিগত জীবনের স্মৃতিগুলো এসে ভর করে মনে। লালু শেখ সিন্দুকের মধ্যে তার হারানো জীবনকে খুঁজে পায়। ছেলে-মেয়ে দুটি দূরে চলে গেছে। আর কি কোনো দিন তাদের বুকে ফিরে পাবে সে? এসব ভাবতে ভাবতে লালু শেখ চোখের পানি ফেলে আর বিলাপ করতে থাকে।

দুবাইয়ে গিয়ে কিছুদিন লাইলী ভালোই থাকে। দেশে খালার কাছে টাকা পাঠায়। ফোনে বাবা-ভাইয়ের খোঁজ রাখে। রোখসানার কাছে জানতে পারে মোস্তাক হিংস্র বাঘের মতো ওকে খুঁজছে। কোনদিন দুবাই চলে আসে ওর খোঁজে কে জানে! হোটেলের কাজে অনেক খাটনি। সকাল সাতটা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত কাজ। কোনো বিরাম নাই। লাইলী তাও খুব নিরাপদ বোধ করে, নিজের জীবনকে সুরক্ষিত করতে পেরেছে ভেবে মনে শান্তি পায়। কিন্তু অতীত ওকে মোষের মতো তাড়া করে বেড়ায়। বাবলুর জন্য এখনও মন কাঁদে। মাঝে মাঝে বাবলুর নম্বরে ফোন করে দেখে বন্ধ। রোখসানার কাছ থেকে বাবলুর নতুন নম্বর নেয়। বাবলু ফোন ধরে বুঝতে পেরে আর কথা বলে না। লাইলী ওর কাছে একটা আতঙ্ক, লাইলীর সাথে আর কোনো যোগাযোগ রাখতে চায় না। । মোস্তাকের প্রতি লাইলীর ভেতরে জমা হওয়া রাগ, ক্ষোভ জেগে ওঠে মনে।

নভেরা হোসেন
জন্ম ২০ সেপ্টেম্বর ১৯৭৫, মাদারীপুর শহরে নানাবাড়িতে। শৈশব থেকেই ঢাকায় বেড়ে ওঠা। তিনি লেখাপড়া করেছেন ধানমন্ডির কাকলি উচ্চ বিদ্যালয়, বেগম বদরুন্নেসা সরকারি মহিলা কলেজ এবং নৃবিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। লিটল ম্যাগাজিনে লেখা শুরু করেছেন ২০০০ সালের পর থেকে। বিশেষত কবিতা, গল্প ও নৃবৈজ্ঞানিক লেখালেখি করেন। e-mail: [email protected]

আরও পড়ুন>> লালবাগ (পর্ব-১২)

বাংলাদেশ সময়: ১০২২ ঘণ্টা, অক্টোবর ০২, ২০২০
টিএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।