ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

মীর মশাররফ হোসেন ও গাজী মিয়াঁর বস্তানী

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৪০৫ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৬
মীর মশাররফ হোসেন ও গাজী মিয়াঁর বস্তানী

বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল মুসলমান সাহিত্যিক। তার আগে অল্পক’জন মুসলিম সাহিত্যশিল্পীর প্রয়াস আমাদের লক্ষ্যগোচর হয়। মশাররফ মূলত গদ্যশিল্পী।

মীর মশাররফ হোসেন ও গাজী মিয়াঁর বস্তানী
ফজলুল হক সৈকত

মীর মশাররফ হোসেন (জন্ম: ১৩ নভেম্বর, ১৮৪৭ - মৃত্যু: ১৯ ডিসেম্বর, ১৯১২) বাংলা সাহিত্যের প্রথম সফল মুসলমান সাহিত্যিক। তার আগে অল্পক’জন মুসলিম সাহিত্যশিল্পীর প্রয়াস আমাদের লক্ষ্যগোচর হয়।

মশাররফ মূলত গদ্যশিল্পী। তার রচনায় তৎকালীন বঙ্গসমাজের একটি যথার্থ চিত্র পাওয়া যায়। সে যুগের শিক্ষাব্যবস্থা, মুসলমান জমিদারদের জীবন-প্রণালী, সংস্কার-বিশ্বাস, নারীর সামাজিক অবস্থান ও মর্যাদা, হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক, সমাজের প্রচলিত আইন ও অবিচার, দুর্নীতি ও হঠকারিতা তার সাহিত্যভাবনার এক বিশেষ অনুষঙ্গ। গাজী  মিয়াঁর বস্তানীও এর ব্যতিক্রম নয়।  

গাজী মিয়াঁর বস্তানী প্রথম খণ্ড ১৮৯৯ খ্রিস্টাব্দে (১৩০৬ সালের আশ্বিন মাসে) প্রকাশিত হয়। অবশ্য এর রচনাকাল ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দ। ১৩০৩ সালে ০২ অগ্রহায়ণ গাজী মিয়াঁ (মীর মশাররফ হোসেন) বগুড়ার সৈয়দ অলিওল্লার হাতে বস্তানীর পাণ্ডুলিপি প্রকাশের জন্য দেন, এরকম তথ্য পাওয়া যায়। এর দ্বিতীয় খণ্ড পুস্তকাকারে স্বতন্ত্রভাবে প্রকাশিত হয়নি। লেখকের আত্মজীবনী আমার জীবনীতে  (১৯০৮) দ্বিতীয় খণ্ডে প্রায় সম্পূর্ণাংশ প্রকাশিত হয়েছিল। আমার জীবনী বারো  খণ্ডে প্রকাশিত হয়। প্রতি খণ্ডের শেষ কয় পৃষ্ঠায় গাজী মিয়াঁর বস্তানীর দ্বিতীয় খণ্ড থেকে খানিকটা করে মুদ্রিত হয়েছিল। কিন্তু তার আত্মজীবনীও অসম্পূর্ণ থাকায় বস্তানীর দ্বিতীয় খণ্ডও সম্পূর্ণ প্রকাশিত হতে পারেনি। গাজী মিয়াঁর বস্তানীর ভূমিকায় (বিজ্ঞাপনে) বলা হয়েছে, বস্তানীর প্রায় দশ আনা অংশ প্রকাশ হইল। ছয় আনা পরিমাণ অবশিষ্ট রহিল। যদি কোন মহানুভব মহাজনের মনে ধরে আর সেই সর্বসিদ্ধিদাতা জয়জগদীশের কৃপা হয়, তবে অবশিষ্টাংশ প্রকাশের আশা করা যায়। গ্রন্থটিতে লেখক হিসেবে মীর মশাররফের নাম ছিল না। ‘স্বত্ত্বাধিকারী উদাসীন পথিক’ এই ছদ্মনামে গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। পরবর্তী গ্রন্থ বিবি কুলসুম থেকে জানা যায়, মশাররফ হোসেনই গাজী মিয়াঁ। মীর মশাররফের পরিণত বয়সের (আনুমানিক ১৮৮৪-১৮৯৪) অর্থাৎ দেলদুয়ার এস্টেটে অবস্থানকালীন ঘটনাবলী বস্তানীর অন্তর্ভুক্ত। ’

বাউলের অঞ্চল কুষ্টিয়ার সন্তান মশাররফ প্রথম জীবনে কাঙ্গাল হরিনাথের শিষ্য ছিলেন। গাজী মিয়াঁর বস্তানীতে উদাসী বাউলের জীবনদর্শনের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। এটি উপন্যাস জাতীয় রস-রচনা। কর্মজীবননির্ভর আত্মজীবনীমূলক এই রচনায় ব্যঙ্গরসের উপস্থাপন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। এ গ্রন্থে অনেক চরিত্রের সমাবেশ ঘটেছে, তবে কোনো একটি মূল ঘটনাকে কেন্দ্র করে কাহিনী ও চরিত্র আবর্তিত বা বিবর্তিত হয়নি। মূলত লেখক ব্যাখ্যার মধ্য দিয়ে তৎকালীন সমাজের অন্যায়-অবিচার, অনাচার-দুর্নীতি, সমাজের মানুষের নৈতিক অবক্ষয় ও বর্বরোচিত আচরণ চিত্রিত করেছেন। বঙ্কিমচন্দ্রের কমলাকান্তের দপ্তর (১৮৭৫) হয়তো মীর মশাররফকে অনুপ্রাণিত করেছিল। এছাড়া বিষয় ও প্রবণতা রূপায়ণে আলালের ঘরের দুলাল (১৮৫৭) এবং হুতোম প্যাঁচার নঁক্সার (১৮৬২-৬৩) সঙ্গে এ গ্রন্থের সাদৃশ্য রয়েছে। বস্তানীতে ঊনিশশতকের শেষপর্বের সামন্ত সমাজপতিদের নানান অপকর্ম ও ব্যাভিচার হাস্যরসের মাধ্যমে উপস্থাপিত  হয়েছে। সমাজের অসঙ্গতি চিহ্নিতকরণ এবং তাতে আঘাত হানাই ছিলো মশাররফের মূল কামনা। আর সে কারণেই ব্যক্তিজীবনের ছাপচিত্র হওয়া সত্ত্বেও বস্তানী বর্ণনায় লেখক যথেষ্ট নিরাবেগ ও নির্লিপ্ত থাকতে পেরেছেন। তবে গাজী মিয়া কমলাকান্তের মতো গভীর অন্তর্দৃষ্টির পরিচয় রাখতে সক্ষম হননি। গাজী মিয়াঁর বস্তানীর বিষয় ও অঙ্গসজ্জা সম্বন্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে অক্ষয় কুমার মৈত্রেয় লিখেছেন- 
গাজী মিয়াঁর বস্তানী একখানি বিচিত্র সমাজচিত্র, সুশোভিত, সুলিখিত উপন্যাস। ইহাতে নাই এমন রস দুর্লভ। কটু, তিক্ত, কষায়-অম্ল, অম্ল-মধুর, মধুর অতিমধুর যাহা চাও, তাহাই প্রচুর। অথচ সকল রসের উপর দিয়া কাতর করুণ রস উছলিয়া পড়িতেছে। গ্রন্থকার স্পষ্টবাদী হইলে শ্রুতিকটুদোষ পরিহার করতে পারেন না, স্পষ্টকথা সত্য হইতে পারে, সকল স্থানে সুমিষ্ট হয় না। সুতরাং গাজী মিয়াঁর কথা স্থানে স্থানে বড়ই কড়া হইয়াছে। তিনি দৃঢ় মুষ্টিতে কশাধারণ করিয়া সেখানে যাহার পৃষ্ঠে আঘাত করিয়াছেন, সেখানেই স্পষ্ট আঘাত ধ্বনি ফুটিয়া উঠিয়াছে। কাতর ক্রন্দনের সঙ্গে রক্তধারা ছুটিয়া ছিটকাইয়া পড়িয়াছে। বাঙ্গালীর পল্লীচিত্র ইংরাজ রাজ্যের লজ্জার বিষয়। পড়িতে পড়িতে মনে হয়, ইংরাজ রাজ্যের বাহিরে বিলাতি বার্নিস, ভিতরে টিনের পাতা, দেখিতে খুব জমকাল। আইন আছে, আদালত আছে, আপীলের পর আপীল আছে। কিন্তু বিচার নাই। এমন ভাষা, এমন ভাব, এমন কাহিনী বিন্যাস-কৌশল মুসলমান সাহিত্য সেবকদিগের মধ্যে এ পর্যন্ত কেবল বিষাদসিন্ধুর রচয়িতাতেই লক্ষিত হইয়াছে। (প্রদীপ, সম্পাদক: শ্রী বিহারীলাল চক্রবর্তী পৌষ ১৩০৮, পৃ. ৩৯-৪০)

গাজী মিয়াঁর বস্তানীতে মূলত পয়জারুন্নেসা, সোনাবিবি এবং মনিবিবি- এই তিন বিধবা নারী জমিদারের কাহিনী বিবৃত হয়েছে। গ্রন্থে বর্ণিত কাহিনীকে প্রধানত দু’টো ভাগে ভাগ করা যায়- ১. অরাজকপুরের জমিদার পয়জারুন্নেসা বা বেগম সাহেবা এবং ভোলানাথ বাবু বা হাকিম সাহেবের নানাবিধ ক্রিয়াকলাপের কাহিনী, ২. যমদ্বার গ্রামের দুই নারী জমিদার সোনাবিবি এবং মনিবিবির সংঘর্ষের বিবরণ। কাহিনীর দু’টি ধারাকে লেখক বিভিন্নভাবে সূত্রবদ্ধ করতে চেষ্টা করেছেন। অবশ্য দ্বিতীয় কাহিনীই প্রাধান্য লাভ করেছে শেষত। গ্রন্থের সূচনা হয়েছে পয়জারুন্নেসা ও ভোলানাথ বাবুর অন্তরঙ্গতার কাহিনী বর্ণনের মধ্য দিয়ে। ভোলানাথ বাবু প্রায়শই পয়জারুন্নেসার বাড়িতে যাতায়াত করেন। দ্বিতীয় হাকিম ভোলানাথ বাবু, উকিল, কোর্ট বাবু, জেলখানার ডাক্তার তাদের সঙ্গেও রয়েছে পয়জারুন্নেসার ঘনিষ্টতা। বিলাসী এই রমণী নানান কৌশলে ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদেরকে নিজের কব্জিবদ্ধ করে রাখতে পছন্দ করেন। তিনি স্বামীর প্রতি কখনই সহানুভূতিশীল ছিলেন না। ভেড়াকান্ত ওরফে ‘গাজী মিয়াঁ’কে তিনি যেমন ভয় করতেন, তেমনি তার ওপর আক্রোশও ছিলো সবচেয়ে বেশি। স্বামীর মৃত্যুর পর পয়জারুন্নেসা ভাইদের আনকূল্যে ‘সোসাইটি গার্ল’-এ পরিণত হন। তার জীবনের পরিণতি অত্যন্ত বেদনাদায়ক। যখন তার যৌবন ও ধন সম্পদ নিঃশেষিত হয়েছে, তখন তার সহচরীরা সবাই তাকে ত্যাগ করেছে নির্দ্বিধায়।  

যমদ্বারের দুই নারী জমিদার সোনাবিবি ও মনিবিবি। সোনাবিবির ছেলে জয়ঢাকের  সঙ্গে মনিবিবির মেয়ে ছিড়িয়া খাতুনের বিয়ে হয়েছে। শুধু তাই নয়, সোনাবিবির মা এবং মনিবিবির মা উভয়ে সহোদরা। আবার সোনাবিবির সহোদর মনিবিবির স্বামী এবং মনিবিবির সহোদর সোনাবিবির স্বামী। উভয়েই বিধবা। কিন্তু তাদের দ্বন্দ্ব-কলহের অবসান ঘটেনি; বরং সম্পত্তি দখল নিয়ে তাদের মধ্যে বিবাদ আরও জমরূপ ধারণ করেছে। মনিবিবির ভাষায়-
সোনাবিবি আমার চক্ষের বিষ। আমিও তাঁহার হৃদয়ের কাঁটা। যে চক্ষে আমি দেখি, সেও সেই চক্ষে আমাকে দেখে। সে যাতে সর্বস্বান্ত হয়, আমি তার চেষ্টা করি। সেও যথাসাধ্য আমার মন্দ কামনা করে। ... আমার ইচ্ছা ছিল মেয়ে দিয়ে তার পুত্রকে হাতে আনবো, আপন কায়দায় ফেলবো, যাতে বশ হয়, বাধ্য হয়, যাতে আমার মতে চলে, কার্য্য করে। তাই করবো। ... সেই ছেলের হাত দিয়েই মাকে দরুস্ত করবো। ... সোনাবিবিও আমাকে মনে মনে জব্দ করবার আশা করে ছেলের বিবাহে মত দিয়েছিলেন। লোকে ভাবল যে, চিরদিনের বিবাদ এই বিবাহেই মিটে যাবে। বিধাতার যা ইচ্ছা, তাই হল, বিবাদ আরও বেড়ে উঠলো। (চতুর্থ নথি) 

মনিবিবি এবং সোনাবিবির এই কলহে বেগম সাহেবা মনিবিবির পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। আর যমদ্বারের অন্য জমিদার চরিত্রহীন, স্বার্থপর সবলোট চৌধুরী এদের কলহে কলকাঠি নেড়ে আয়-উপার্জনের পথ সুগম করেছেন। সবলোট চৌধুরী অর্থ আর নারীর প্রতি ছিলেন প্রবলভাবে আকৃষ্ট। সন্ধ্যা হলেই নারীর সন্ধানে লোক পাঠিয়ে আগমন প্রতীক্ষায় প্রহর গুনতে থাকেন। প্রসঙ্গত লেখকের বর্ণনা উদ্ধৃত করা গেল-
দরজার নিকটে যাইয়া অর্দ্ধশরীর পর্যন্ত দরজার বাহির করিয়া দেখিতে লাগিলেন, কাহারও সাড়া শব্দ পাইলেন না। দরজার নিকট দাঁড়াইয়া বলিতে লাগিলেন, দেখত বেটা কি পাজি। রাত প্রভাত হয়ে যায় কোন খোঁজ খবর নাই। এরা নিজের লাভ নিয়েই ব্যস্ত, আমার দিকে আর কেউ ফিরে চায় না। (দ্বিতীয় নথি)

মনিবিবি স্বামীর প্রতি বিরূপ ছিলেন। অবজ্ঞা-অত্যাচারে তার স্বামী মৃত্যুমুখে পতিত হয়েছে। স্বামী জীবিত থাকতেই বাড়ির এক কর্মচারী লালআলুর সাথে মনিবিবির অবৈধ সম্পর্ক তৈরি হয়। মনিবিবি সম্পর্কে ভেড়াকান্তের মন্তব্য ‘লালআলু অধুনা মনিবিবির বাড়িতে সুখে আছে’। মনিবিবি এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে ভুগছিলেন এবং লালআলু তার সেবায় রত। অসুখের সময় তার মেয়েরা তাকে দেখাশুনা করতো না। এর মধ্যে ভিখারিণী মনিবিবির বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার আগে ভিখারিণী বলে যায় যে, মনিবিবির ব্যাধি চিকিৎসার বাইরে। পাপের শাস্তিস্বরূপ তাকে মরতে হবে। লোভী এবং নীতিজ্ঞানবর্জিত রমণী মনিবিবি কুষ্ঠরোগে আক্রান্ত হয়ে অশেষ যন্ত্রণা ভোগ করে মৃত্যুবরণ করেন।

সোনাবিবিও সংসারজীবনে সুখী ছিলেন না। স্বামীর মৃত্যুর পর বিষয়-সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের যথেষ্ট প্রয়াস তার মধ্যে লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু মনিবিবি জয়ঢাকের মাধ্যমে তার সম্পত্তি হস্তগত করতে উদ্যত। ফলে, মামলা-মোকদ্দমা ও ষড়যন্ত্র চলতে থাকে। গাজী মিয়াঁ ওরফে ভেড়াকান্ত ছিলেন সোনাবিবির মিত্রপক্ষ। সোনাবিবি ও মনিবিবির দ্বন্দ্ব-কলহের মধ্যে পড়ে বেগম সাহেবার চক্রান্তে সোনাবিবির সহায়ক ভেড়াকান্তকে হাজতবাস করতে হয়েছিল। দাগাদারী নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে সোনাবিবির  বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিলো।

গাজী মিয়াঁর বস্তানীতে বর্ণিত সমাজের অরাজকতা, মামলা-মোকদ্দমা, শঠতা আর প্রবঞ্চনাভরা। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যকার বিবাদ আর তাদের এই দুর্বলতার সুযোগে হাকিম-উকিল-পুলিশ-ধড়িবাজদের অর্থ-উপার্জনের মহোৎসব এ কাহিনীকে কৌণিক বিশ্লেষণে প্রাণবন্ত করেছে। আর যৌনাচার ও লাম্পট্যের চিত্র তৎকালীন সমাজের অর্থশালী পুরুষের মানসিকতার প্রতিচিত্র; রয়েছে নারীর ব্যভিচারের ছবিও। বস্তানী বর্ণনায় লেখক ক্ষেত্রবিশেষে নগ্নচিত্র অঙ্কন করেছেন, যা অশোভন এবং অশ্লীলতা দোষে দুষ্ট হয়ে পড়েছে। প্রকৃত অর্থে, মানুষের ঘৃণ্য আচরণের প্রতি ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের কষাঘাত করতে গিয়ে লেখক সংযম হারিয়েছেন কখনও কখনও। কোনো কোনো ক্ষেত্রে অবশ্য উপভোগ্য বিদ্রুপ পাঠককে আকৃষ্ট করে।

গাজী মিয়াঁর বস্তানী সর্বমোট ২৪টি নথিতে বিভক্ত। মূল গ্রন্থে রয়েছে ২০টি নথি। আর ৪টি নথি সংযোজিত হয়েছে মশাররফের আমার জীবনীতে (১৯০৮)। পরিশিষ্টে ‘বর্তমান মুসলমান সমাজের একখানি চিত্র’ নামে একটি কবিতা রয়েছে। ড. কাজী আবদুল মান্নান এ কবিতাটিকে বস্তানীর ২৪তম নথির শেষাংশ বলে মন্তব্য করেছেন। আর কবিতাটির বিষয় সম্পর্কে লিখেছেন-
অষ্টাদশ শতাব্দী থেকে মুসলমানদের চারিত্রিক অধঃপতনের সূযোগ গ্রহণ করে হিন্দু নায়েব গোমস্তারা কিভাবে মুসলমানদের সম্পত্তি আত্মসাৎ করেছিল, তার চমৎকার বিবরণ কবিতাটিতে পাওয়া যায়। (সাহিত্য পত্রিকা, শীত সংখ্যা, ১৩৬৫, বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়)।

মীর মশাররফ হোসেন গাজী মিয়াঁর বস্তানীতে অত্যন্ত- সংবেদনশীলতার সঙ্গে মানবমনের আর্তনাদ চিত্রায়ন করেছেন: যেনো বিবরণ তার নয়, আর্ত মানুষের কোনো অঘোষিত প্রতিনিধির সরব ঘোষণা। প্রকাশক শ্রী মমিনদ্দীন আহম্মদ ১৩০৬ সনের ১৫ আশ্বিন গ্রন্থের প্রকাশ সম্পর্কে (ভূমিকায়) লিখতে গিয়ে উদ্ধৃত করেছেন-
‘এদিন থাকিবে না’ এই প্রাচীন মহাকাব্যের প্রতিফলে কোন সময় এমন আসিবে- মুক্তকন্ঠে যাঁহারা বলিবার তাঁহারা বলিবেন যে, গাজী মিয়াঁ অতীতকালের একখানি বৃহৎ দর্পনের নমুনা রাখিয়া গিয়াছেন। আরও একটি আশ্চর্য্য কথা এই যে, বস্তানীর কথা যে শুনিবে, কোন না কোন কথায় সে বলিবেই, ‘আমারই কথা লইয়া গাজী মিয়াঁ আপন নথি দোরস্ত করিয়াছেন। ’

গাজী মিয়ার বস্তানীতে মশাররফ হোসেন সংকটের মধ্যে মানুষের যাতায়াত ও আবর্তন নির্দেশ করেছেন। নির্যাতিত মানুষের অগ্রগমণকে তিনি দেখতে সমর্থ হননি। তার চিত্রিত চরিত্রগুলো যাবতীয় সমস্যার বেড়াজালে আবদ্ধ। আর আর্তনাদের প্রতিভাস নির্মাণ করেছে তিনি। মূলত লেখক একটা বিশেষ সময়কে কাহিনীর ফ্রেমে ধরে ওই সময়ের জীবনচিত্রের স্বরূপ উদ্ঘাটনের চেষ্টা করেছেন। এক্ষেত্রে তার দেখার ভঙ্গি, অনুভবের প্রখরতা, আর উপস্থাপনের কৌশল পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বস্তানীতে চিত্রিত মশাররফ-অভিপ্রায় স্পষ্ট করতে কয়েকটি উদ্ধৃতি এখানে উপস্থাপন করা হলো-
১.    দেখুন, এই যে পর্দ্দা সম্মুখে ঝুলিতেছে। এই পর্দাই সর্বনাশের গোড়া, মান রক্ষার উপায়, সম্ভ্রম বজায় রাখবার সহায়- যত কারিগরি, যত চাতুরি ঐ পর্দ্দাই তার মূল। এখনই পরীক্ষা হবে, প্রত্যক্ষ প্রমাণ পাবেন। আমরা যে পর্দ্দানসীন, তার হাতে হাতে ফল দেখবেন। (পর্দ্দা টানিয়া ফেলিয়া)- এই নিন, কে কার ধার ধারে। পর্দ্দাখানা ফেলে দিলেই তো সাত খুন মাপ। গাড়ী হাকাচ্ছি, জোড়া জোড়া, জোড়া বেন্দে ছুড়ি হাকাচ্ছি, গড়ের মাঠে হাওয়া খাচ্ছি, খোলা বাতাসে, খোলা গাড়ীতে খুলে বসে আছি, উত্তপ্ত বক্ষে শীতল বাতাস লাগাচ্ছি। ইডেন গার্ডেনে হাঁটাহাঁটি ছুটাছুটি কচ্ছি। কান কথা ‘সেক হ্যান্ড’ কচ্ছি। মিস সেজে শিস দিচ্ছি। ঘরে এসে পর্দ্দা টানলেন, সব মিটে গেল। এমন সর্বদোষ অপহারী, মানসম্ভ্রম রক্ষাকারী পটাপটী পর্দ্দা আমাদের থাকতে আপনার চিন্তা কি? পর্দ্দারবাহিরে কিরূপ সাজা, আর মধ্যেই বা কিরূপ মজা, আজ দেখুন? ডাক মৌলবী সাহেবকে। ছোট হলেও হাকিম, বাপরে। তাঁকে কি ফিরান যায়।  (ষষ্ঠ নথি)
২.    ‘সময় অল্প’ কথা অনেক। তবে সেখানে মধুমাখা সুমিষ্ট বোল নাই, এয়ারের দল নাই, খোলা প্রাণ, গড়ের মাঠ নাই, দক্ষিণহস্তের ব্যাপার নাই, রস রসিকতা নাই, রূপচাঁদ রুধির নাই, তরতাজা মাছ নাই, অন্তর্ভেদী হা-হুতাশ নাই, আপেক্ষ নাই, হাসির তুফান, রহস্যের ঢেউ, আনন্দের লহরী নাই, সেখানে গাজী মিয়াঁ মরিয়া রহিয়াছেন। (সপ্তম নথি)
৩.    ‘গাজী মিয়াঁ’ বলেন, বঙ্গরাজ্যে কসাই তিন প্রকার। গরু-বাছুরের গলায় ছুরি দিয়া বাজারে মাংস বিক্রয় করে। সে আসল কসাই। দুই দলে বিবাদ বাঁধাইয়া দিয়া কোন এক পক্ষের পক্ষ সমর্থনকারী প্রিয় উকিল মোক্তার বাবু, যাহাদের আদৌ পসার নাই, তাঁহারা দ্বিতীয় শ্রেণীর কসাই। কোন মতের চিকিৎসা-শাস্ত্র শিক্ষা না করিয়া ঔষধ অস্ত্রের ব্যবস্থাকারী কবিরাজ ডাক্তার তৃতীয় শ্রেণীর কসাই। এ তিন শ্রেণীর মানবাকার পশুর হৃদয়ে দয়ার লেশ মাত্র নাই। সর্ব অস্ত্রের অগ্রভাগ গলায় দাবাইয়া অর্থ উপার্জন করাই ইহাদের প্রধান ধর্ম। (একাদশ নথি)

গাজী মিয়াঁর বস্তানীর ভাষা সাধুরীতির। আরবি, ফারসি শব্দের ব্যবহার রয়েছে অনেক। এসব শব্দ তৎকালীন হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের মধ্যেই প্রচলিত ছিল। যেমন- উকিল, মোক্তার, আমলা, মজুর, দরখাস্ত, বে-আক্কেল ইত্যাদি। এ গ্রন্থে কিছু ইংরেজি শব্দও ব্যবহৃত হয়েছে। যেমন- কোর্ট, পুলিশ, ইন্সপেক্টর, জজ, ডিসমিস ইত্যাদি। উনিশ শতকের শেষদিকে অভিজাতমহলে হিন্দি-উর্দুর ব্যবহার লক্ষ্যযোগ্য। বস্তানীর হাকিম সাহেবও হিন্দু-উর্দু ভাষায় কথা বলতে স্বচ্ছন্দ বোধ করেন। গ্রন্থটির ভাষা মূলত সাধুরীতির হলেও সংলাপ রচনায় লেখক কোথাও কোথাও কথ্যরীতির ভাষাকে অবলম্বন করেছেন।

বস্তানীতে মশাররফ জন-জীবনের রূঢ়-বাস্তবতাকে সাহিত্যিক রূপ দিতে গিয়ে অনেক প্রবাদ-প্রবচনের প্রয়োগ ঘটিয়েছেন। প্রবাদগুলো অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত, তীক্ষ্ণ ও  বুদ্ধিদীপ্ত। কয়েকটি প্রবাদ উদ্ধৃত করা হলো-
ক.    বসন্তের কোকিল, সুখের পায়রা (প্রথম নথি)
খ.    নাচতে বসে ঘোমটা কি (দ্বিতীয় নথি)
গ.    স্ত্রীলোকের মন রাজধানীর কেল্লা অথবা যাদুঘর (অষ্টাদশ নথি)
ঘ.    ঘসে মেজে রূপ আর ধরে বেন্দে পিরীত (দ্বিতীয় নথি)
ঙ.    নূতনে পোড়ে মন, পুরাতনে অযতন (তৃতীয় নথি)
চ.    কথা বাতাসের আগে ধায় (অষ্টম নথি)
ছ.    যেমন দেহছাড়া ব্যাধি নাই, তেমনি শত্রু ছাড়া শরীর নাই (নবম নথি)
জ.    হক কথায় মানুষ রুষ্ট, গরম ভাতে বিড়াল অসন্তুষ্ট (একাদশ নথি)
ঝ.    গাঁয়ের ফকির ভিক পায় না (বিংশ নথি)

গাজী মিয়াঁর বস্তানী মশাররফের সমাজ-সচেতেন শিল্পী মানসের অভিব্যক্তি প্রকাশের এক চমৎকার ক্যানভাস। লেখক সমাজ ও মানুষের অসঙ্গতি এবং বিচিত্র প্রবণতা চিত্রণে এ গ্রন্থে অনেকটাই নিরাবেগ তথা বাস্তবতা নিবিষ্ট। বলবার ভঙ্গি যেমন বিশেষ, তেমনি বিষয় উপস্থাপন-কৌশলও তাৎপর্যপূর্ণ। সমাজ ও মানুষকে দেখার এবং দেখাবার এক অনিন্দ্য কাঠামো দাঁড় করিয়েছেন মশাররফ তার গাজী মিয়াঁর বস্তানীতে।

বাংলাদেশ সময়: ১০০১ ঘণ্টা, নভেম্বর ১৩, ২০১৬
এসএনএস
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।