ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শিল্পে শিল্পী সেনা’র বৈরাগ্যভাব | সৈয়দ মাসুম রেজা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১২ ঘণ্টা, এপ্রিল ২, ২০১৬
শিল্পে শিল্পী সেনা’র বৈরাগ্যভাব | সৈয়দ মাসুম রেজা

শিল্প বিষয়টি মানব সভ্যতার উন্মেষের সঙ্গে সঙ্গে রূপ লাভ করেছে। সাধারণ অর্থে শিল্পকলা হলো, একজন চারুশিল্পীর রূপসৌন্দর্যবোধ দ্বারা অনুপ্রাণিত- একইসঙ্গে কায়িক ও মানসিক শ্রমনির্ভর সৃজনশীল কর্ম।

বাংলাদেশের শিল্পকলা চারুশিল্পী তৈরিতে কতোটা অবদান রাখতে পারছে সে আলোচনা ভিন্ন। আমি তুলে ধরতে চাই এমন একজন শিল্পীর শিল্পকর্মকে যা পরিণত হচ্ছে সম্পূর্ণ নিজ তাগিদে।

শিল্পী আসাদুজ্জামান সেনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের চিত্রকলা বিভাগ থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে ঢাকায় একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে শিল্পনির্দেশক হিসেবে কর্মরত। পেশাগত জীবনে কাজ করতে গিয়ে শিল্পী সেনা তার শিল্পীসত্ত্বাকে কাজে লাগিয়ে দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। খুব সাম্প্রতিক কালে সেনা তার প্রতিষ্ঠানের জন্য ক্যালেন্ডার তৈরি করতে গিয়ে কিছু চিত্রকর্ম তৈরি করেন যা বাণিজ্যিক চাহিদার সঙ্গে নান্দনিক বিষয়ের একটা সমন্বয় সাধন করেছে বলে মনে হয়। এই বিষয়ে শিল্পী সেনার সঙ্গে কথা বলে ভিন্নমাত্রার একটি অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেছি।

কথাপ্রসঙ্গে শিল্পী সেনা জানাচ্ছিলেন, আজকাল এ ধরনের কাজে দেখা যায়, পণ্যের প্রমোশন করার লক্ষ্যে তৈরি ক্যালেন্ডারের জন্য সাধারণত নৈসর্গিক দৃশ্য, ফুল বা সাধারণ কোনো স্থির ইমেজ ব্যবহৃত হয়। এখানে প্রাধান্য পায় শুধুই পণ্যের প্রসার বা বাণিজ্যিক ব্যাপারটা। এর মধ্যে শৈল্পিক বা নান্দনিক কোনো ছোঁয়া পরিলক্ষিত হয় না।

একজন শিল্পনির্দেশক হিসেবে কাজ করার ক্ষেত্রে নান্দনিকতার সমন্বয়ে পণ্যকে চিত্রকর্মের মধ্যে নিয়ে আসাটা শিল্পীর একটা তাগিদের বিষয় বলে মনে করেন শিল্পী সেনা।

সেই তাগিদ থেকেই ক্যালেন্ডারের জন্য এই চিত্রকর্মগুলো আঁকা। এর ফলে বাণিজ্যিক দিক থেকে যেমন প্রতিষ্ঠান লাভবান হলো, ঠিক তেমনি শিল্পীর কিছু নান্দনিক শিল্পকর্ম তৈরি হলো। প্রতিষ্ঠিত হলো একটি শিল্পীসত্ত্বা।

শিল্পীর শিল্পকর্মগুলো বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে প্রতিটি অভিব্যক্তিতেই উদাসী বা একাকীত্ব বা আনমনা- সর্বোপরি ব্যক্তির বৈরাগ্যভাব সুস্পষ্ট। অর্থাৎ বিষয়বস্তু হিসেবে বেছে নেওয়া হয়েছে মানুষের বৈরাগী মনকে যা ‘মন বিহঙ্গ’ নামে নামাঙ্কিত। অর্থাৎ আমাদের শত কর্মের শত ব্যস্ততার মধ্যেও মনটা একটা পাখির মতো আকাঙ্ক্ষিত কোনো মুহূর্ত বা ভালোলাগা-মন্দলাগার দোলাচলে দুলতে থাকে, এরই এক ধরনের বহিঃপ্রকাশ এই চিত্রকর্মগুলোতে আমরা দেখতে পাই।

‘মন বিহঙ্গ ২’ চিত্রে আমরা দেখতে পাই, একজন গ্রামের নারী টিউবওয়েল থেকে পানি নিয়ে বাসায় ফিরছেন এবং একটি পাখি উড়ে বেড়াচ্ছে। পাখিটিকে যদি আমরা তার মনের প্রতিরূপ হিসেবে কল্পনা করি তাহলে বুঝি, ওই নারীর মন, বিহঙ্গ হয়ে উড়ে বেড়াতে চায় কিন্তু দৈনন্দিন কাজের মাঝে বা জীবিকার তাগিদে হয়তো তা সম্ভব হয়ে উঠছে না। বাস্তবে সম্ভব না হলেও মন-তো মনে মনে উড়ে বেড়াতেই পারে।

‘মন বিহঙ্গ ৪’ চিত্রে একজন গ্রামীণ গৃহিণী চুলায় অ্যালুমিনিয়ামের পাতিলে ভাত রান্না করার ফাঁকে আনমনে বিরহে ডুবে রয়েছেন। হয়তো তিনি তার জীবনটা যেমন হওয়ার কথা ছিলো তেমনটা হয়ে ওঠেনি অথবা কোনোকিছু না পাওয়ার বিরহ তাকে বিমর্ষ করে তুলেছে।

‘মন বিহঙ্গ ৭’ চিত্রে দেখা যাচ্ছে, গ্যাসের চুলায় রান্নার অবসরে একজন মা তার সন্তানকে কোলে নিয়ে আদর করছেন।

‘মন বিহঙ্গ ১১’ চিত্রে একজন সদ্য বিবাহিতা রান্নাঘরে ফ্রাই প্যানে ডিম ভাজছেন কিন্তু তার দৃষ্টি রয়েছে আকাশের চাঁদের দিকে। সংসার জীবনে আবদ্ধ হয়েও তার চঞ্চল মন বৈরাগী হয়ে চাঁদের পানে ছুটে যেতে চায়।

‘মন বিহঙ্গ ১৫’ চিত্রে একজন বাবা তার সন্তানকে বাথ শাওয়ারে গোসল করাচ্ছেন কিন্তু তিনি আনমনা। পারিবারিক সামাজিকসহ অন্য অনেক দায়িত্ব মাথায় নিয়েও তিনি তার মনের জগতে ঘুরে বেড়াতে চান।

‘মন বিহঙ্গ ৮’ চিত্রে একজন আধুনিক সদ্য বিবাহিতা সংসারজীবনে এসে প্রেশারকুকারে রান্না চাপিয়ে হেডফোনে গান শুনছেন, তার অভিব্যক্তি বলে দিচ্ছে- তিনি বিরহের গান শুনছেন।

বিশ্লেষণ শেষে স্পষ্ট ধারণা পোষণ করা যায়, নিঃসন্দেহে চিত্রকর্মগুলোতে মানুষের অবচেতন বৈরাগ্যভাব ফুটে উঠেছে। প্রতিটা চিত্রকর্মেই পণ্যগুলো যেমন টিউবওয়েল, অ্যালুমিনিয়ামের পাতিল, গ্যাসের চুলা, ফ্রাই প্যান, বাথরুম শাওয়ার ও প্রেশারকুকার অঙ্কিত হয়েছে বাণিজ্যিক দিক বিবেচনা করে। সেই পণ্যগুলো ব্যবহারকারী সমাজের বিভিন্ন স্তরের অর্থাৎ গ্রামের ও শহরের মধ্যবিত্ত ও স্বচ্ছল পরিবারের নারী-পুরুষের ভেতরে লুকিয়ে থাকা অবচেতন মনের বৈরাগী রূপ অভিব্যক্তি দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

শিল্পী আসাদুজ্জামান সেনা চিত্রকর্মগুলো ক্যাসভাসের ওপরে অ্যাক্রেলিক রঙে এঁকেছেন। আর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হলো, চিত্রকর্মগুলোতে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য রীতির একটা সমন্বয় ঘটানো হয়েছে খুব সচেতনভাবেই। শিল্পী সেনার ভাষায়, পাশ্চাত্যের শিল্পী পাবলো পিকাসোর রীতির সঙ্গে আমাদের প্রাচ্যের শিল্পী নন্দলাল বসু ও যামিনী রায়ের কাজের রীতির সংমিশ্রণ ঘটানো হয়েছে। একটা কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতে গিয়ে এই ধরনের ক্যালেন্ডার তৈরির কাজে শুধুমাত্র পণ্যগুলোর ফটোগ্রাফ ব্যবহার করা যেতে পারতো। শিল্পী সেনা তার চারুকলা বিষয়ক উচ্চতর শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে বাণিজ্যিক একটি ক্যালেন্ডারকে শৈল্পিক ও নান্দনিক রূপ দিতে সক্ষম হয়েছেন শুধুমাত্র নিজের বৈরাগ্য তাগিদ থেকে বলেই আমি মনে করি। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার বিভিন্ন মানুষের বৈরাগী মন, বিরহী মন, একাকী মন বলে
একটা বিষয় থাকেই। তাই শিল্পী সেনার সাম্প্রতিক কালের ব্যক্তিগত শিল্পচর্চার বিষয়বস্তুও এই বৈরাগ্যভাব।

বাংলাদেশ সময়: ১১০৪ ঘণ্টা, এপ্রিল ০২, ২০১৬
এসএনএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।