ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বাংলানিউজকে ব্রততী

‘কবিতা বেছে নেওয়াটা খুব জরুরি’

আবৃত্তি ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৩২৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৬
‘কবিতা বেছে নেওয়াটা খুব জরুরি’ ছবি: শুভ্রনীল সাগর-বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম

গত তিন দশক ধরে যারা আবৃত্তি চর্চায় ছিলেন, আছেন বা থাকবেন- তারা আবৃত্তিশিল্পী ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায়কে জানেন, জানতে হবে ও জানা উচিত! কবিতা তার সন্তান। মেঘে মেঘে সেই সন্তানের বয়স প্রায় ত্রিশ।

কিন্তু স্নেহ-মমতা সেই সদ্যোজাতের মতো।

বাংলাদেশ আসা এই নিয়ে পাঁচ-ছয়বার হলো। গত ২৫ মার্চ ডার্ড গ্রুপের আমন্ত্রণে ‘দুই পারের কানাকানি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে আবৃত্তি করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জীবনানন্দ দাশ, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত ও শামসুর রাহমানের প্রায় ১৫টি কবিতা।

অনুষ্ঠান শেষে কবি, কবিতা, আবৃত্তি, পাঠ প্রভৃতি নিয়ে কথা হয় তার সঙ্গে। বাংলানিউজের পক্ষ থেকে কথোপকথনে অংশ নেন শুভ্রনীল সাগর।

বাংলানিউজ: আবৃত্তি কি শিল্প?
ব্রততী: নিশ্চয়ই। না হলে এতো মানুষ এই মাধ্যমটা নিয়ে বেঁচে আছেন কী করে। হাজার হাজার মানুষ- বাংলাদেশ ও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় প্রচুর ছেলেমেয়ে আবৃত্তির চর্চা করে। যারা নাটক চর্চা করেন তাদের বেসিক তৈরি ও নিজেদের প্রশিক্ষিত করতে গেলে আবৃত্তি চর্চাটা বাধ্যতামূলক।

বাংলানিউজ: চর্চার কথা তো আমরা জানি কিন্তু কবিতা, চিত্রকলা, নাট্যকলা, নৃত্যকলা যেমন মৌলিক শিল্প- আবৃত্তিকেও কি সেরকম মৌলিক শিল্প বলা যাবে?
ব্রততী: নিশ্চয়, বাচিক শিল্প। কথা বলা তো একটা আর্ট। সুন্দর বলে কথা বলা একটা আর্ট। আমরা বলি, বাচিক শিল্প। আবৃত্তি এর মধ্যে অন্যতম।

বাংলানিউজ: তাহলে ‘কবিতা পাঠ’ আর আবৃত্তির মধ্যে কী পার্থক্য?
ব্রততী: পার্থক্য আছে। আমার পারফরম্যান্স সেই পার্থক্যটা করে দেয়। কবিতা পাঠ হলো, দেখে বলা। নাটক পাঠ বা বাচিক অভিনয় যখন হয় সেটা পাঠ হয়। কিন্তু আবৃত্তিটা আমি বরাবরই না দেখেই বলে এসেছি, আমার নিজের বলতে সুবিধা হয়। আমার মনে হয়, না দেখে বললে শ্রোতা বা দর্শকদের সঙ্গে অনেক ভালো সংযোগ স্থাপিত হয়।

বাংলানিউজ: সেক্ষেত্রে এই যে দীর্ঘক্ষণ একনাগাড়ে বলে যাওয়া, এক কবিতা থেকে অন্য কবিতায় যাওয়া- এ বিরাট ব্যাপার। আলাদা করে বলতে হয়, আপনার স্মৃতিশক্তি অসাধারণ!
ব্রততী: এটা একটা অভ্যাস। দীর্ঘসময় ধরে এই মাধ্যমটার সঙ্গে জড়িয়ে আছি আর মানুষের ভালোবাসা পেতে গেলে, নিজেকে পেশাদারিত্বের সেই চূড়ান্ত জায়গাটায় রাখতে গেলে এই চাপ-স্ট্যামিনা-নিষ্ঠা থাকতেই হবে। কারণ, টানা প্রায় ৩০ বছর হয়ে গেলো এই পেশাটার সঙ্গে আমি জড়িয়ে, সিঁড়ি ভেঙে উঠেছি, সেটার জন্য এই পরিশ্রমগুলো তো করতেই
হবে।

বাংলানিউজ: আপনি কলকতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির ছাত্রী, আবৃত্তির দিকে কীভাবে আসা ও পরবর্তীতে পেশা হিসেবেই নেওয়া…
ব্রততী: ছোটবেলা থেকে বাবা বাড়িতে অনেক রেকর্ড আনতেন। সেখানে শম্ভু মিত্র, কাজী সব্যসাচীদের রেকর্ড থাকতো। সেসব শুনতে শুনতেই আমি বড় হয়েছি। বুঝি না বুঝি তাদের উচ্চারণগুলো, শব্দের থ্রোয়িংগুলো আমার কানে লাগতো। আমি শুনে শুনে সব মুখস্থ করে ফেলতাম। গান-নাটকও শোনা হতো বাড়িতে। আমার একটা বিশেষ টান ওই কবিতার সাথে হয়ে গিয়েছিলো। এই যে ছোটবেলা থেকে কানটা তৈরি হয়ে গিয়েছিলো, পরে যতো বড় হয়েছি মনটা তৈরি হয়ে যায়। কবিতাকে ভালোবেসে ফেলি। সেটা কবে বেসেছি বলতে পারবো না কিন্তু কোথা দিয়ে যেনো সেটা রক্তের সঙ্গে মিশে গেছে। এ কারণে পড়াশোনা-ভালো চাকরি যাই করেছি, সবসময় একটা ছটফটানি ছিলোই যে কবিতা পড়া হচ্ছে না, কবিতার সঙ্গে থাকা হচ্ছে না। আর এই যে মঞ্চে ওঠা, দর্শকদের যে আশীর্বাদ, তাদের হাততালি এক অন্য আনন্দ তৈরি করে। দর্শকদের সঙ্গে সরাসরি একটা সংযোগ তৈরি হয়। সে আপনি যতোই রেকর্ড বের করুন, টেলিভিশনে খবর পড়ুন কিন্তু তাতে দর্শকদের পালসটা পাওয়া যায় না। যে কারণে মঞ্চে ওঠার একটা আলাদা আনন্দ সবসময় আছে, সব হতাশা দূর করে দেয়।

বাংলানিউজ: ‘আবৃত্তির কবিতা’ বলে কি আলাদা কোনো কবিতা আছে?
ব্রততী: কিছু কিছু কবিতা আছে। কবিতাটা যখন লেখা হচ্ছে তখন সেটা প্রিন্ট মিডিয়ামে। এবার প্রিন্ট মিডিয়াম থেকে আপনি সেটাকে মঞ্চে আনছেন, সেটা আলাদা মিডিয়াম। সত্যজিৎ রায়ের উদাহরণ দেই, যখন উনি রবীন্দ্রনাথের কোনো কাহিনিকে সিনেমা করছেন; ধরুন, ‘ঘরে বাইরে’, এটা তো প্রিন্ট আকারে ছিলো মানে লেখা আকারে। তিনি যখন ফিল্ম মিডিয়ামে আনলেন তখন তার কিছু ‘চেইঞ্জেস’ করতে হয় এবং সেই সিলেকশনটা পরিচালককে করতে হবে। সেই গল্পটা আমি নেবো যেটা আমি ছবিতে ভালোভাবে প্রকাশ করতে পারবো। এটা কিন্তু পরিচালক তার ব্যক্তিগত মুন্সিআনা দিয়ে বুঝে নেবেন। এতো গল্পের মধ্যে ঘরে বাইরে কেন? ভিস্যুয়াল এলিমেন্ট ও বিভিন্ন কারণে তার হয়তো মনে হয়েছে, এটা ফিল্মে ভালোভাবে ফুটিয়ে তোলা যাবে। কবিতার ক্ষেত্রেও তাই, সব কবিতা কিন্তু মঞ্চে পড়ার নয়, কিছু কিছু কবিতা খুব স্ট্রাইক করে যায়। মনে হয়, এটা খুব মঞ্চোপযোগী। এটাকে এই মাধ্যমে ট্রান্সফার করা যায়। জীবনানন্দের অনেক কবিতা আগে অনেকে পড়তেনই না। আমি তো আজ দু’টো পড়লাম।



ভাবো, এই হোয়াটসঅ্যাপ-ফেসবুক প্রজন্মের কাছে ‘আট বছর আগের একদিন’ কবিতার কী মূল্য আছে! নেই তো! কিন্তু তাদের যদি সেইভাবে বলার মতো করে বোঝানো যায় যে, একটি মানুষ জীবনে সব পেয়েছে। আমরা যেমন এখন সবকিছু পাওয়ার দিকে ছুটি। ভোগবাদী সমাজ হয়ে গেছে। যাই দেখছি, পেতে হবে! কিন্তু পাওয়ার পরও মানুষের কিছু জায়গা থাকে, সবকিছু পেয়েও মানুষের কিছু অতৃপ্তি থাকে এবং এই অতৃপ্তির জন্যই আট বছর আগের একদিনের সফল মানুষটি আত্মহত্যা করে। এগুলো জীবনের অন্য দর্শন, অন্য পথ খুলে দেয়। এই যে কবিতাটি বেছে নেওয়া, আরও অনেক কবিতা কিন্তু বেছে নেওয়া যেতো কিন্তু সেটা হয়তো এই সময়ে কমিউনিকেট করতো না। কবিতা বেছে নেওয়াটা খুব জরুরি।



বাংলানিউজ: এই বেছে নেওয়ার ক্ষেত্রে দেখা যায় পোস্টমডার্ন কবিতাগুলো ‘আবৃত্তিযোগ্য’ হয়ে উঠছে না। মানে ঘুরেফিরে সেই পঞ্চাশ-ষাট-সত্তর-আশির দশকের কবিতাগুলোই চলছে..
ব্রততী: না না, তা নয়। আজ আমার সিলেকশনে অনেক কবিতাই ছিলো কিন্তু কিছু কিছু কবিতার এতো অনুরোধ ছিলো যে সেগুলো আবৃত্তি করতে হলো। আমি আজ শক্তি, সুনীল, পূর্ণেন্দু, জয় দা-দের কবিতা আবৃত্তি করিনি।

বাংলানিউজ: আপনি যাদের নাম নিলেন তারা তো সবাই ওইসব দশকেরই..
ব্রততী: আমি নতুনদের কবিতাও পড়ি। আজ যারা আমাকে এনেছেন তাদের বিশেষ কয়েকটি কবিতার অনুরোধ ছিলো। সেগুলো পড়তেই সময় শেষ হয়ে গেলো। আমার একক হলে আমি দুই-আড়াই ঘণ্টা আবৃত্তি করি। তখন আরও ভালো করে সিলেকশন করা যায়।

বাংলানিউজ: বাংলাদেশের কবিতা চর্চা নিয়ে কিছু বলেন…
ব্রততী: বাংলাদেশে কিন্তু প্রচুর ছেলেমেয়ে আবৃত্তি চর্চা করেন, অনেকগুলো গ্রুপ আছে। চট্টগ্রাম বোধনের ২৫ বছর পূর্তিতে আমার একক অনুষ্ঠানের আয়োজন তারা করেছিলেন। অনেকগুলো গ্রুপের কাজকর্ম সম্পর্কে আমি ওয়াকিবহাল। আমার মনে হয়েছে, তাদের চর্চা সবই ঠিক আছে কিন্তু পারলে আমার অভিজ্ঞতাও তাদের সঙ্গে শেয়ার করতাম। বর্তমান সময়োপযোগী প্রেজেন্টেশন কেমন হওয়া উচিত সে বিষয়ে টিপস দিতাম। একটা কবিতা একভাবে না ভেবে আরও নানাভাবেও যে ভাবা যায় সেটা বলতাম। উচ্চারণ বা তাদের বলার মধ্যে যে সুরটা থাকে, সেই সুরটা একটু অন্যভাবে বলা যায়। এটা আমার অনেকদিনের ইচ্ছে। কখনও যদি কেউ সেভাবে আয়োজন করে তাহলে আমার অভিজ্ঞতাগুলো শেয়ার করতে চাই।

বাংলানিউজ: ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ থেকে বলছি, বাংলাদেশে যারা আবৃত্তি চর্চা করেন বা কবিতা পড়েন তাদের অনেকের মধ্যে কিছু প্রবণতা দেখা যায় যেমন, কবি ও কবিতার চেয়ে নিজেকে বড় করে তোলা বা দেখানো। নেহাত না নিলেই নয় তাই কবির নামটি নেন। আজ আপনি প্রত্যেক কবির নাম যেভাবে শ্রদ্ধাভরে নিলেন, তাদের সম্পর্কে ও যে কবিতাটি পড়ছেন সেটা সম্পর্কে দু-তিন মিনিট যে বললেন, এতে কবি ও কবিতা শ্রোতার মাথায় গেঁথে যায়- এটা এখানে কম দেখি…
ব্রততী: এটা তো একদমই ভুল চর্চা।

বাংলানিউজ: পশ্চিমবাংলায় আবৃত্তি চর্চার কী অবস্থা?
ব্রততী: সেখানেও ভালো অবস্থা। আমার নিজেরও ‘কাব্যায়ন’ নামে একটি গ্রুপ আছে। সেখানে এক হাজারের মতো শিক্ষার্থী। তিন-চার বছর থেকে পঁচাত্তর বয়সী, বিরাট কর্মযজ্ঞ। শুধু কলকাতা নয়, এর বাইরেও আমাদের শাখা আছে। বিরাট কবিতা পরিবার।

বাংলানউজ: অনেক ধন্যবাদ আপনাকে।
ব্রততী: বাংলানিউজ ও তোমাকেও অনেক ধন্যবাদ।


বাংলাদেশ সময়: ১৩০৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৭, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।