ঢাকা, শুক্রবার, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ২৭ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

শহীদুল জহির ও ইব্রাহীমরা | ফজলুল হক সৈকত

প্রবন্ধ ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২০০ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৬
শহীদুল জহির ও ইব্রাহীমরা | ফজলুল হক সৈকত

শহীদুল জহির (জন্ম: ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৫৩; মৃত্যু: ২৩ মার্চ ২০০৮) বাংলা কথাসাহিত্যে একটি অপরিহার্য নাম। ‘পারাপার’ (১৯৮৫) নামে গল্পগ্রন্থ প্রকাশের মধ্য দিয়ে সাহিত্যে তার সরব প্রবেশ।

‘অতঃপর জীবন ও রাজনৈতিক বাস্তবতা’ (১৯৮৮), ‘সে রাতে পূর্ণিমা ছিল’ (১৯৯৫) প্রভৃতি উপন্যাসে তার শিল্পী মননের বিষয়াদি পাঠকের কাছে স্পষ্টতর হতে থাকে।

মৃত্যুর প্রায় আঠারো বছর আগে জহির লিখেছেন ‘আবু ইব্রাহিমের মৃত্যু’ (প্রথম প্রকাশ: নিপুণ, ০৮ জুন ১৯৯১; তার মৃত্যুর বছরখানেক পরে ২০০৯ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়)। কথানির্মাতা শহীদুল জহিরের ৮ম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধা জানানোর অভিপ্রায়ে তার আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু বইটি সম্বন্ধে আমার একটি ব্যক্তিগত পর্যবেক্ষণ (যদিও আমার বিশ্বাস পাঠ ও অনুধাবন কখনও কখনও কষ্টসাধ্য) পাঠকের জন্য পরিবেশন করছি।

জীবন আর মৃত্যুর অমোঘতা ও নির্মমতা বিবরণের প্রতি শহীদুলের বিশেষ ঝোঁক আমাদের নজরে আসে। মানুষের সুখ ও অসুখ কিংবা শান্তি ও শান্তিহীনতা এই কথাকারকে ভাবনাপ্লাবনে ভাসিয়েছে অনবরত। কাজের ফাঁকে অথবা নির্জন অবসরে তিনি মানুষের বিচিত্র স্বপ্নময়তা আর আশাভঙ্গের ব্যাপারাদির ব্যাখ্যা খুঁজেছেন আপন মনে। কখনও হয়তো কিছু নিশানা পেয়েছেন, কখনওবা চিন্তার (দুশ্চিন্তার নয়) মহাসমুদ্রে অবগাহন করেছেন ক্লান্তি আর হতাশার চাদর গায়ে দিয়ে। না পাওয়া কিংবা অনুধাবন করতে না পারার শীত ও দৌবর্ল্যও তাকে আক্রমণ করেছে সময়-অসময়ে। তবে বরাবরই একটি বিষয়ে শহীদুল জহির গভীরভাবে নিমগ্ন ছিলেন, তা হলো- চিন্তা আর স্বপ্নের দরদি দরোজার আবেগী অথচ সত্যনিষ্ঠ উন্মোচন। আবু ইব্রাহীমের মৃত্যু পাঠ ও কাঠামোর নিবিড় পাটাতনে প্রবেশ করলে লেখকের ওই মনোনিবেশের জায়গাটি ধরতে আমাদের কোনো কষ্ট পোহাতে হয় না।

কাহিনিটির নায়ক আবু ইব্রাহীম আদতে একজন অসুখী মানুষ। তবে সেটি তার ভেতরের খবর। বাইরে কিন্তু আবু ভয়ানক বুদ্ধিমান অভিনেতা; সংসারে এবং স্ত্রীর কাছে ও সামনে তার সরল হাসিমাখা মুখ সবসময়ই উদ্ভাসিত ছিলো। ভেতরে ভেতরে কেবল তিনি দু’টি ব্যর্থতা ও বিষণ্নতা পোষণ করে বেড়াতেন। একটি হলো প্রেমে পরাজয়; অন্যটি প্রথম যৌবনে অর্জিত ও লালিত রাজনৈতিক আদর্শ থেকে সরে আসার অপরিসীম গ্লানি। সম্ভবত এই অপ্রাপ্তির যন্ত্রণা আর আদর্শ-বিচ্যুতির দায়বদ্ধতা থেকে একরকম আপাত মৃত্যুর আভাস আবু ইব্রাহিম টের পেয়েছিলেন। গ্রন্থটির উৎসর্গপত্রে লেখা হয়েছে, ‘মানুষের মুত্যু অবশ্যই হয়, কিন্তু মৃত্যুর তাৎপর্য ভিন্ন। প্রচীন চীনে সিমা ছিয়েন নামে একজন সাহিত্যিক বলেছিলেন- মানুষের মৃত্যু অনিবার্য, কিন্তু তার তাৎপর্য হবে থাই পাহাড়ের চেয়েও ভারী বা বেলে হাঁসের পালকের চেয়েও হালকা। ’ এই অনুভবের সরল অনুসরণকারী হিসেবে, সংসারের সমূহ চলমানতা আর স্বপ্নময়তার ভেতরে প্রতিনিয়ত যে স্বাভাবিক মৃত্যুর বার্তা প্রবেশ করে, তার সত্যাসত্যকে ধারণ করে, তাই শহীদুল জহির নির্মাণ করেন জীবন, আনন্দ আর বেদনার অপার খেলার অপরিহার্যতার সৌন্দর্য। আবু ইব্রাহীমের মৃত্যুতে সেই সৌন্দর্যের সুবাস স্থাপিত হয়েছে শিল্পীর সরল-সাহসী অভিনিবেশের মাধ্যমে।

বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে সুন্দরী সহপাঠী হেলেনকে একনজর দেখার আকুলতা, তাকে পাবার আনন্দ, পূর্ণতা ও আপন-অস্তিত্বের অবসান-ইঙ্গিত এবং হারানোর মধ্য দিয়ে অন্য ভুবনে প্রবেশের যাবতীয় বিশ্বাস-অবিশ্বাসের দোলাচলে ভরপুর আবু ইব্রাহীমের স্বপ্নকালীন জীবন। হেলেনের রহস্যময়তা ইব্রাহিমকে মায়াজালে আবদ্ধ করেছিলো; আকাঙ্ক্ষা এবং যন্ত্রণার অতলেও ডুবিয়েছিলো। আবার হেলেনহীন জীবনে- দাম্পত্যভুবনে প্রবেশ করে হেলেনের অপ্রয়োজনীয়তাও তাকে সুখ সুখ অনুভবের জানালায় হাত বাড়াতে সহায়তা করেছে। স্ত্রী-পুত্র-কন্যা পরিবেষ্টিত সংসারে হেলেনকে তার আরাধ্য মনে হয়নি। সংসার যাপন করতে গিয়ে আবু ইব্রাহীম টের পেয়েছেন, হেলেনকে তিনি ভালোবাসেননি, পূজা করেছেন; হেলেনও ভালোবাসেননি ইব্রাহীমকে, তিনি চেয়েছিলেন কেবল বদান্যতা আর অশেষ শ্রদ্ধা। এবং দেবীদের মতোই পূজারিকে অবহেলা করেছিলেন হেলেন। ভালোবাসার সরল পাটিগণিতটি যে প্রায় সবক্ষেত্রে এরকমই, তা অনুধাবন করতে পারেন আবু ইব্রাহীম। এবং তিনি টের পান নারীর সাহচর্য বা উপস্থিতি পুরুষের কাছে নেহাতই একটি প্রয়োজনের ব্যাপার। আর কন্যা বিন্দুর সঙ্গে পার্কে বসে গল্প করতে গিয়ে ইব্রাহীমের মনে হয়েছে- তিনি বোধহয় প্রেম করছেন, যেমন এই পার্কে চাঁপাফুলগাছের তলায় বসে একসময় গল্পচ্ছলে প্রেম করেছেন কিংবা প্রেমচ্ছলে গল্প করেছেন আকাঙ্ক্ষিত দেবীপ্রতীম নারী হেলেনের সঙ্গে।

ক্ষীণতনু এই উপন্যাসটির প্রায় প্রথমদিকে কথাকারের একটি ঘোষণা পাঠকের নজর কাড়ে। জহির জানাচ্ছেন, ‘আসলে মানুষ কি কখনো পাগল হয়, অথবা পাগল না হয়ে কি মানুষ পারে? মমতা নিদ্রায় ফিরে যাওয়ার পর সে রাতে আবু ইব্রাহীম তার কোয়ার্টারের বারান্দায় দাঁড়িয়ে থেকে অনেক রাত পর্যন্ত নিদ্রিত ঢাকার উপর দিয়ে দূরাগত পাখিদের উড়ে যাওয়ার ধ্বনি শোনে। ’

গল্পকথক আবু ইব্রাহীমের জীবনসঙ্গিনীর নাম দেওয়া হয়েছে মমতা। লেখক মমতার চোখের আলো ও গ্রীবার ভঙ্গিতে একধরনের স্থিরতাও স্থাপন (প্রতিস্থাপন বলা চলে কি!) করেছেন অতি কৌশলে; যে স্থিরতার ওপর ভর করে নারী সংসার সমুদ্র পাড়ি দেয় হেইও হেইও বলে। আর এই রমণীর গলায় ঝগড়া করার মতো একটা স্বাভাবিক স্বর এবং শক্তিও জুড়ে দিয়েছেন- কিছুটা মাথা খাটিয়ে। স্বামীর যৌবনকালের প্রেম-বিষয়ে একটা সাধারণ ধারণা মমতা পেয়েছিলেন; সুযোগ পেলে খোঁচা মারতেও ভুল করেননি কখনও। কন্যাকে নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বদলে যাওয়া অলি-গলি আর পায়ের চিহ্নের স্মৃতি মাড়িয়ে, ভারী বাতাসের ভার পার হয়ে একদিন বাসায় ফিরে (ভেতরে ভেতরে পরাজিত) ইব্রাহীম যখন জানান- তিনি বিন্দুকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াবেন, তখন (ঠিক সেই সময় ইব্রাহীমের মৃত্যুর সব প্রস্তুতি মহানিয়ন্ত্রক বোধ করি ফাইনাল করে ফেলেছেন) স্ত্রী মমতার কণ্ঠের এক প্রকার প্রবল ঝাপটা পাঠকের মনে আছাড় খেয়ে পড়ে। সেই ক্ষোভের বিবরণটা এরকম, ‘মমতা তখন জানত না যে, আবু ইব্রাহীমের কোনো স্বপ্নই সফল হবে না, তার সব কথাই অর্থহীন থেকে যাবে, কারণ মৃত্যু বড় দ্রুত এসে তাকে স্বপ্নচারিতা থেকে অপসারিত করবে। তাই তখন মমতা শুভর বই-খাতা গোছাতে গোছাতে আবু ইব্রাহীমের কথা শুনে ঠোঁট টিপে বলে, তোমার যে কোনখানে লাগে আমি জানি। ’

হেলেনের প্রেমের স্রোতে প্লাবিত আবু ইব্রাহীম তার দিনলিপিতে আবেগ আর ভালোবাসার বিবরণ লিখে গেছেন। ডায়েরিতে লেখা তার ভালোলাগা-না লাগার তালিকা থেকে অবগত হওয়া যায় যে, মৃত্যু ও চাকরি তার বড় অপ্রিয় বিষয় ছিলো। কিন্তু নিয়তির বিধানমতে তাকে চাকরি করে জীবন-যাপন করতে হয়েছে আর হাঁসের পালকের চেয়েও হালকা এবং অতি তুচ্ছ এক মৃত্যুর গহীন অন্ধকারের ভেতরে তাকে পতিত হতে হয়েছে। ইব্রাহীমের ডায়েরির পাতায় পাতায় পাওয়া যায় গরিব ও পতিতদের অধিকার প্রতিষ্ঠার কথা, দূরাগত সামাজিক বিপ্লবের ইঙ্গিত এবং দয়া ও উপকার বিষয়ে নানান অভিমত। ভালোবাসতে শিখলে ভালোবাসা পাওয়া যায়- এসব কথাও আবুর জানা ছিলো। তবে অফিসের বস সিদ্দিক হোসেনের মানবপ্রীতিতে ইব্রাহীম মুগ্ধ হয়েছিলেন কিনা, সে কথা উদ্ধার করা যায়নি। কারণ, সিদ্দিক হোসেন ও আবু ইব্রাহীম ছিলেন পরস্পর ভিন্ন মেরুর মানুষ; তাদের অপরিহার্য বন্ধুত্বের ভেতর এক ধরনের চাঞ্চল্য ও রহস্যময়তা ছিলো।

আমরা জানি, সিদ্দিক হোসেন অর্থলোভী ও সুবিধাভোগী, আর ইব্রাহীম আত্মপীড়নবাদী- কাকের শহরে কম্প্রোমাইজ করতে না পারা এক ব্যথাহত কোকিল। তবে মমতার প্রেমে অন্তত সামান্যতম হলেও ইব্রাহীম মুগ্ধ হয়েছিলেন। মমতার চোখে ঠোঁট রেখে একবার অন্তত তিনি অনুভব করেছিলেন উষ্ণ জলস্রোতের নীরব ধারা; এবং স্ত্রীর দৈহিক স্থুলতা যে সর্বব্যাপ্ত নয়, সে বিষয়ে খানিকটা সংশয়মুক্তও হতে পেরেছিলেন। মমতা তার আপাত দরিদ্র স্বামীর উদারতা ও আধুনিকতা সম্বন্ধে বিশদ অবহিত ছিলেন। স্বামীর স্বগৃহীত দারিদ্র্য তিনি বিনা প্রতিবাদে মেনে নিয়েছেন এবং ইব্রাহীমও মমতার এই সহনশীলতায় সন্তুষ্ট হয়ে যাবতীয় অবসাদের ভেতরেও মনে মনে তৃপ্ত থেকেছেন। কিছুটা প্রাসঙ্গিক, অপাতসুখী- পার্কে বকুলগাছের তলায় বসে এবং পার্কের ভেতরে হেঁটে আনন্দ পাওয়া এই পরিবারের খবর নিতে, একটা সামান্য পাঠ-অংশ এখানে উপস্থাপন করছি,


‘কাজলিকে ঘরে রেখে তারা বের হয়, কলোনির লোকেরা তাদের হেঁটে যেতে দেখে। শুভ আর বিন্দু আবু ইব্রাহীমের দুহাত ধরে নৌকার গুণ টানার মতো করে টেনে নিয়ে যায়, মমতা কাঁধের উপর দিয়ে আঁচল ছেড়ে দিয়ে বুকের ওপর দুহাত বেঁধে একটু দূর দিয়ে হাঁটে; তার গোল মুখটা পরিতুষ্ট দেখায়। আবু ইব্রাহীমের ভালো লাগে, তার পিঠের ব্যথার কথা সে ভুলে যায়। ’


কিছু প্রবাদপ্রতীম বাক্য রচনা করেছেন শহীদুল জহির তার এই উপন্যাসে। পাঠকের জন্য কয়েকটি উদাহরণ হাজির করছি-
‘বিদেশে গেলে পরেই কেবল দেশের মর্ম বোঝা যায় এবং চেতনায় স্বদেশপ্রেম আবিষ্কৃত হয়।
‘বাইচা থাকা বড়ই কষ্ট!’
‘চাকরি কারো যায় না; গেলে এদেশে কারো চাকরি থাকত না। ’
‘ব্যবসা করার কথা প্রত্যেক চাকরিজীবীই ভাবে। ’
‘এখানে কোনো নিয়ম নাই, শৃঙ্খলা নাই। ’

কাহিনিটিতে পিতা ও কন্যার সম্পর্কের এক অনালোকিত রহস্যের প্রতি লেখক আমাদের মনোযোগ আকর্ষণ করেছেন। জলির-মমতা এবং ইব্রাহীম-বিন্দু- এ দু’টি পর্যায়ে গল্পের কাঠামোয় আমরা ওই রহস্যের অবতারণা হতে দেখি। পিতার স্নেহস্পর্শে কন্যার জ্বলে ওঠা এবং কন্যার সান্নিধ্যে বয়স্ক পিতার বিগত স্বপ্নের কাছে ফেরার অনুভূতিটুকু লাভ করতে পাঠকের নেহাত খারাপ লাগে না। আবার পিতা আবু ইব্রাহীম যখন ভাবেন, ‘তার কন্যাটি পৃথিবীর সব চাইতে মধুময়ী স্ত্রী হবে; একটি ঘর উদ্ভাসিত হবে, প্লাবিত হবে একটি পুরুষের জীবন’, তখনও পাঠক নিশ্চয়ই একধরনের পুলক অনুভব করে।

ইব্রাহীমের মৃত্যুর পর তার স্ত্রী কবরের কাছে ও ওপরে গজিয়ে ওঠা ঘাসের কাছে মমতা বিনিয়োগ করেছেন কিছুকাল। কিন্তু, সামাজিক নিরাপত্তার কারণেই বোধহয়, পরিবারের লোকজনের অনুরোধ ও চাপে অল্পকাল পরে তিনি বিয়ে করেন। এ বাস্তবতাকে পাঠকের সামনে লেখক শহীদুল জহির, উপন্যাসটির সমাপ্তিলগ্নে, হাজির করেছেন, ‘কবরস্থানের কবরের কথা আমরা এভাবে ভুলে যাই; সেখানে নির্মেঘ আকাশে চাঁদ হেসে উঠে, ছুঁচোর চিৎকারে বাতাস মুখরিত হয়, সারারাত ধরে পাখা ঝাপটাতে ঝাপটাতে পেঁচা ওড়ে। ’

আবু ইব্রাহীম জানতেন কোনোকিছুই আসলে পুরোপুরি ব্যর্থ হয় না- না প্রেম, না ঘৃণা। সে কারণেই বোধহয়, কিংবা কে জানে বিনা কারণেও হতে পারে, মাঝে মাঝে তিনি বিষণ্নতার ভেতরে জেগে-ওঠা ক্রোধকে অতিযত্নে প্রশমিত করেছেন। আবু ইব্রাহীম বিলীনপ্রায় ঐশ্বর্যভরা আভিজাত্যের প্রতীক এক নাগরিক পুরুষ। কিন্তু লোকটি এক অনিবার্য পতনের মুখে পড়ে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হন। অফিসে একটি বড়ো কাজের অর্ডার পেতে একটি ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধি ইব্রাহীমকে ঘুষ দেন, নানানভাবে প্রভাবিত করেন, ভয় দেখান। রূপনগরে একটি জমি কেনার জন্য ইব্রাহীমের টাকার দরকারও ছিলো। গ্রামের বাড়ি থেকে জমি বিক্রি করে কিংবা শ্বশুরের কাছ থেকে টাকা সংগ্রহের ব্যাপারে স্ত্রী মমতার সঙ্গে আলাপও হয়। ঘুষের টাকা ব্যবহারের কথাও হয়তো ভাবেন তিনি; কিন্তু ঘুষ দেওয়া লোকটিকে তিনি কাজ দিতে পারেন না- নীতির কাছে আপস করতে পারেন না বলে।
 
প্রকৃত অর্থে আবু ইব্রাহীম নিয়তির ঘেরাটোপে আটকে-পড়া গ্রিক ট্র্যাজেডির অসহায় নায়কের মতোই পতনের দিকে ধাবিত হয়েছেন অনিবার্যভাবে। অবশ্য ইব্রাহীম মাঝে মধ্যে দালানের ফাঁক দিয়ে চাঁদ দেখলে জোছনায় ভেসে যাবার মতো স্বপ্নের প্রত্যাশায়ও ভাসেন। কখনও কখনও স্ত্রী মমতার ভারী নিঃশ্বাসও তাকে জেগে থাকতে অনুপ্রেরণা যোগায়। মানুষের অবজ্ঞা আর প্রলোভনের শিকার আবু ইব্রাহীম অবশেষে পতন থেকে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে ছিনতাইকারীর চাকুর আঘাতে নিহত হন। কিন্তু আবু ইব্রাহীমের সমূহ পতনের গতি অবলোকন করতে গিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, লোকটি হয়তো মরেননি- তাকে মেরে ফেলা হয়েছে। খালিদ জামিল, যিনি টাকার বিনিময়ে অন্যায়ভাবে কাজটি পেতে চেয়েছিলেন- যাকে ইব্রাহীম সহায়তা করেননি, সেই খালিদই কি ভাড়াকরা লোক দিয়ে মেরে ফেলেছেন সৎ ও কতর্বনিষ্ঠ সরকারি অফিসার আবু ইব্রাহীমকে! ইব্রাহীমের মুখে লেগে থাকা বিষণ্নতা, নিষ্কম্প স্থিরতা কিংবা হতাশা বা স্পৃহা দেখে সে তথ্য অনুসন্ধান করাটা আমাদের পক্ষে অত্যন্ত কঠিন এবং একপ্রকার অসম্ভবই বটে! ইব্রাহীমরা বোধকরি সবসময় আমাদের চেনাজগতের বাইরে রয়ে যান এভাবেই। পতনের মুখ থেকে সমাজকে, রাষ্ট্রকে, ব্যক্তিকে বাঁচাতে গিয়ে প্রখর-চেতন ইব্রাহীমরা নিজেরাই পড়ে যান অপ্রতিরোধ্য পতনের অন্ধকার গলিতে। দৃশ্যত ইব্রাহীমরা পরাজিত হন বটে, কিন্তু কালের কাঁটাতার পেরিয়ে তাদের বোধ-স্বপ্ন, মিশন-ভিশন উত্তরকালের অনিবার্য প্রবাহে সম্প্রসারিত হয়।



বাংলাদেশ সময়: ১০৩৬ ঘণ্টা, মার্চ ২৩, ২০১৬
এসএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।