ঢাকা, মঙ্গলবার, ১৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ০০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

বইমেলা, লেখকের অধিকার ও ডিজিটাল বাংলাদেশ | ফজলুল হক সৈকত

বিশেষ রচনা ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৬
বইমেলা, লেখকের অধিকার ও ডিজিটাল বাংলাদেশ | ফজলুল হক সৈকত

ফেব্রুয়ারি জুড়ে বাংলা একাডেমির প্রাঙ্গণে বইমেলাকে ঘিরে চলে বাঙালির প্রাণের উৎসব। অফিসিয়াল নাম ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ হলেও আমরা একুশে বইমেলা বলতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি।

লেখক-প্রকাশক-ক্রেতা-পাঠক-আয়োজক আর মিডিয়ার অংশগ্রহণে অত্যন্ত আকর্ষণীয়রূপে মাসজুড়ে চলতে থাকে এই বইমেলা। আইন-শৃঙ্খলাবাহিনীকেও বিশেষ তৎপর থাকতে হয়। পাশাপাশি দর্শকের (যারা ক্রেতা নন) উপস্থিতিও থাকে চোখে পড়ার মতো। এককথায়, বাংলা একাডেমিকেন্দ্রিক বইমেলা দিনেদিনে আমাদের জাতীয় উৎসবে পরিণত হয়েছে—আন্তর্জাতিক পরিসরেও ছড়িয়ে পড়েছে এর পরিচয় ও গ্রহণযোগ্যতা।

বইমেলাকে ঘিরে নানান আয়োজন ও আলোচনার মধ্যে সম্প্রতি স্থান করে নিয়েছে লেখকের অধিকার বা রয়্যালিটির প্রসঙ্গ। ব্যাপারটি পুরনো হলেও প্রকাশনা শিল্পের ব্যাপ্তি ও উৎকর্ষের সাথে সাথে এর না-বলা কথাগুলো প্রকাশ হতে থাকে। প্রচারমাধ্যমের বিস্তার এবং কথা বলা ও লেখার স্বাধীনতার পরিপ্রেক্ষিতের অগ্রগতিও নিশ্চয় জায়গা করে দিয়েছে। লেখকরা জানাতে শুরু করেছেন রয়্যালিটি না-পাবার কথা; প্রকাশকের অসহযোগিতার কথা। অতিসম্প্রতি বাংলা একাডেমি কয়েকজন লেখকের লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতে, প্রথমবারের মতো, একটি বড়মাপের প্রকাশনা-সংস্থাকে স্টল বরাদ্দ দিতে কিছুটা বিলম্ব করে; এতে প্রকাশনাজগৎ, লেখকসমাজ এবং মিডিয়াভুবনে সাড়াও পড়ে খানিকটা।



প্রকাশনা শিল্পের সাথে জড়িত সকলস্তরের শ্রমিক ও কর্মীরা তাদের পারিশ্রমিক পান; প্রকাশকরা পান লভ্যাংশ—তাহলে লেখককেও এই শিল্পের একশ্রেণির শ্রমিক বা অংশীদার ভাবলে ক্ষতি কোথায়? অন্ততপক্ষে এই বৃহৎ শিল্পটির প্রাথমিক পর্যায়ের কাজটি তো লেখকরাই সম্পন্ন করে থাকেন। মেধা-মনন আর শ্রম দিয়ে যে লেখক তাঁর সৃজনশীল বা গবেষণাধর্মী গ্রন্থপ্রণয়নের কাজটি সম্পন্ন করছেন, তার অধিকার ও মর্যাদাকে খাটো করে দেখার কোনো উপায় কিংবা যুক্তি থাকতে পারে না। আমাদের মনে হয়, বাংলাদেশে কৃষকরা যেমন বঞ্চিত—পায় না তাদের ন্যায্য অধিকার ও পণ্যমূল্য; লাভবান হয় মজুদদার এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা, তেমনই প্রকাশনা জগতেও শস্যফলানো কৃষকতুল্য লেখক পান না তাঁর সম্মান ও সম্মানী; লাভবান হন প্রকাশক, মধ্যস্বত্বভোগী ও প্রেসের মালিক; কাগজ-ব্যবসায়ী কিংবা প্রচ্ছদশিল্পীও পেয়ে থাকেন কাঙ্ক্ষিত মুনাফা



সৈয়দ মুজতবা আলীর ‘বই কেনা’ রম্যপ্রবন্ধের কথা হয়ত আমাদের অনেকেরই মনে আছে। বাঙালির বইকেনার প্রতি উদাসীনতার কথা প্রকাশ করতে গিয়ে তিনি জানিয়েছেন—বইয়ের দাম কমানো হয় না বলে বিক্রি বেশি হয় না; আবার যথেষ্ট পরিমাণে বিক্রি হয় না বলে প্রকাশকরা বইয়ের মূল্য কমাতেও পারে না। —প্রাবন্ধিকের ওই মন্তব্যে একদিকে যেমন বাণিজ্যপরিস্থিতি ও প্রবণতার কথা আছে, তেমনই রয়েছে প্রকাশক ও বই ক্রেতার মধ্যে (আড়ালে) বিরাজমান দ্বন্দ্বের চিত্র। আর বর্তমানে প্রকাশক-ক্রেতার দ্বন্দ্ব ছাড়িয়ে তা দাঁড়িয়েছে লেখক-প্রকাশক দ্বন্দ্বে। আজকের কথা হলো : লেখক বলেন প্রকাশকের বিক্রি ভালো, অন্যদিকে প্রকাশক বলেন লেখকের বইয়ের এককপিও বিক্রি হয়নি। আমাদের বিনীত প্রশ্ন হলো—যদি বই বিক্রি না হয়, তাহলে মেলায় লক্ষ লক্ষ ক্রেতা লক্ষ লক্ষ বই কেনেন কাদের কাছ থেকে?  আর প্রকাশকরাই বা মেলায় স্টল বরাদ্দ নেওয়ার জন্য দৌড়ঝাঁপ শুরু করেন কেন? বছরের পর বছর তারা ব্যবসা টিকিয়ে রাখছেন কিভাবে?

আর, বোধকরি একারণেই, স্বচ্ছতার প্রশ্নটিও সামনে এসে দাঁড়ায়; আমাদেরকে নতুন করে ভাবতে হয় প্রকাশনা শিল্পের অবস্থা, লেখক-প্রকাশক সম্পর্ক কিংবা লেখকের প্রাপ্য রয়্যালিটি নিয়ে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, লেখক-প্রকাশক দ্বন্দ্ব ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। অথচ সারাদুনিয়ায় সভ্যতা ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতি সাধিত হয়েছে অকল্পনীয়ভাবে। এখনো কেন লেখক-প্রকাশকের মধ্যে প্রকাশিত ও বিক্রিত বইয়ের সংখ্যা এবং প্রাপ্য ও প্রদেয় রয়্যালিটির অর্থ (টাকা) বিষয়ে কাঙ্ক্ষিত স্বচ্ছতা প্রতিষ্ঠিত হলো না, তা বিস্ময়ের ব্যাপার। এবং এক্ষেত্রে প্রকাশকদের আগ্রহের অভাবই যে বেশি দায়ী তা অনুমান করা যায়। কেবল ভাবি, প্রকাশনা-সংস্থার কাছে লেখকরা—তাদের চিন্তাশক্তি ও সৃজনসামর্থ্য জিম্মি হয়ে পড়ছে না তো!

বাংলা একাডেমি যেহেতু সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি অধিদপ্তর হিসেবে কাজ করে, তাই লেখক অধিকার সংরক্ষণ ও তত্ত্বাবধান বিষয়ে একটি স্বতন্ত্র শাখা এখানে থাকতে পারে। অবশ্য প্রকাশকের অধিকার ও মর্যাদার প্রসঙ্গটিও আসে সঙ্গতকারণেই; কারণ অধিকার কিংবা অভিযোগ কখনো একপাক্ষিক হতে পারে না। দুই পক্ষের বক্তব্য, মতামত, অভিযোগ, আপত্তি—সবই বিবেচনায় রাখতে হবে পর্যবেক্ষণের দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান, সংঘ বা ব্যক্তিকে। আমরা জানি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বর্তমান মহাজোট সরকারের অন্যতম প্রত্যয় হলো ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলা। বলতে দ্বিধা নেই ধারণাটি যথেষ্ট জনপ্রিয়তা পেয়েছে; সরকার যে অনুযায়ী অগ্রসরও হচ্ছে। আমাদের মনে হয়, প্রকাশনা শিল্পেও এই ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রায়োগিক বাস্তবায়ন সম্ভব। প্রত্যেক প্রকাশকের নিজস্ব ওয়েবসাইট প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি বাধ্যতামূলক করা যায়; তাতে তাদের প্রকাশিত গ্রন্থের বিবরণসহ বিক্রি-সংক্রান্ত তথ্যও পরিবেশিত হলে অধিকতর স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা যেতে পারে।

এটা খুবই আনন্দের ব্যাপার যে, বইমেলা চলাকালে প্রতিদিন একাডেমি প্রাঙ্গণ থেকে নতুন প্রকাশিত বইয়ের তথ্য (বইয়ের নাম, লেখকের নাম, প্রকাশক, মূল্য) ইত্যাদি মাইকের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। সম্ভবত তাদের ওয়েবসাইটেও দেওয়া হয় এ সকল তথ্য। পাশাপাশি যদি প্রতিদিনের বই বিক্রির প্রকাশনাভিত্তিক বিবরণ পরের দিন বইমেলার ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়, এবং তা স্থায়ীভাবে সংরক্ষণ করা হয়, তাহলে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে অনেকটা সহায়তা করা সম্ভব। এছাড়া সারাবছর যে সকল প্রতিষ্ঠান বই ক্রয় করে, যেমন: শিক্ষা মন্ত্রণালয়, সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়, শিক্ষা অধিদপ্তর, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্র, পাবলিক লাইব্রেরি, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা—তাদের নিজস্ব ওয়েবসাইটে প্রতিবছর ক্রয়কৃত বইয়ের বিস্তারিত তালিকা প্রকাশ করতে পারে।

লেখক-প্রকাশকের মধ্যে চুক্তিপত্র স্বাক্ষরের ব্যাপারে প্রচলিত নীতিমালা থাকলেও এ ব্যাপারে শিথিলতা বা অবহেলা রয়েছে। আমাদের মনে হয়, জাতীয় গ্রন্থকেন্দ্রের মাধ্যমে সার্টিফাইড প্রতিষ্ঠানকেই (চুক্তিপত্র এবং রয়্যালিটি প্রদান সংক্রান্ত যথেষ্ট তথ্য সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান) কেবল স্টল বরাদ্দ দেওয়া এবং বিভিন্ন পর্যায়ে বই ক্রয়ের ব্যাপারে বিবেচনা করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে জনসচেতনতা সৃষ্টি ও বৃদ্ধির জন্য দরকারি প্রচারেরও ব্যবস্থা করা যেতে পারে; তাহলে যারা বই কিনবেন, তারাও জানতে পারবেন লেখক-প্রকাশকের গ্রহণযোগ্যতা, প্রচার ও স্বচ্ছতা। বই-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে স্বচ্ছতার বিষয়টিকে কৌশলে এড়িয়ে বইয়ের বাজারকে কেবল ব্যবসাকেন্দ্রে পরিণত হতে দিলে, তা জাতির জন্য ক্ষতিকর হবে—এ বিষয়ে বোধকরি সকল সচেতন মানুষ একমত হবেন। প্রকাশক বন্ধুরা ভাববেন না, লেখাটি আপনাদের বিরুদ্ধে। জাতির সৃজনশীল-চিন্তার লালন ও বিকাশ এবং জ্ঞানচর্চার বিরাট জগৎসহ সাহিত্য-শিল্পভুবনে আপনাদের অবদান অনস্বীকার্য। কোনো কোনো প্রকাশক কিংবা কোনো কোনো লেখকের ক্ষেত্রে প্রকাশকরা রয়্যালিটির ব্যাপারে অনেকটাই আন্তরিক ও স্বচ্ছ (বিশেষ বিশেষ পরিস্থিতিতে অধিক স্বচ্ছও বটে!)। কিন্তু মনে রাখতে হবে, বিষয়টি কেবল হাতেগোনা পাঁচ-দশটি প্রকাশনা সংস্থা আর নামকরা জনাদশেক লেখকের অধিকার ও মর্যাদার ব্যাপার নয়; এখানে জাতি এবং দেশের সম্মান ও অগ্রগতির প্রশ্ন অতি-অবশ্যভাবে জড়িত।

প্রকাশনা শিল্পের সাথে জড়িত সকলস্তরের শ্রমিক ও কর্মীরা তাদের পারিশ্রমিক পান; প্রকাশকরা পান লভ্যাংশ—তাহলে লেখককেও এই শিল্পের একশ্রেণির শ্রমিক বা অংশীদার ভাবলে ক্ষতি কোথায়? অন্ততপক্ষে এই বৃহৎ শিল্পটির প্রাথমিক পর্যায়ের কাজটি তো লেখকরাই সম্পন্ন করে থাকেন। মেধা-মনন আর শ্রম দিয়ে যে লেখক তাঁর সৃজনশীল বা গবেষণাধর্মী গ্রন্থপ্রণয়নের কাজটি সম্পন্ন করছেন, তার অধিকার ও মর্যাদাকে খাটো করে দেখার কোনো উপায় কিংবা যুক্তি থাকতে পারে না। আমাদের মনে হয়, বাংলাদেশে কৃষকরা যেমন বঞ্চিত—পায় না তাদের ন্যায্য অধিকার ও পণ্যমূল্য; লাভবান হয় মজুদদার এবং পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা, তেমনই প্রকাশনা জগতেও শস্যফলানো কৃষকতুল্য লেখক পান না তাঁর সম্মান ও সম্মানী; লাভবান হন প্রকাশক, মধ্যস্বত্বভোগী ও প্রেসের মালিক; কাগজ-ব্যবসায়ী কিংবা প্রচ্ছদশিল্পীও পেয়ে থাকেন কাঙ্ক্ষিত মুনাফা। আরেকটি কথা, অতিপ্রাসঙ্গিক না হলেও প্রাসঙ্গিক, বাংলাদেশে পত্র-পত্রিকায় যারা লেখালেখি করেন, তাদের অনেকের ক্ষেত্রেও সম্মানী পাওয়া-না-পাওয়ার অভিজ্ঞতাটা অন্তত আনন্দের নয়। অনেকেরই হয়ত জানা আছে—জাতীয় পর্যায়ের অনেক পত্রিকার বিনিয়োগ ও ব্যবসা ভালো, তাহলে লেখককে কিছু সম্মানি দিলে এমন কী ক্ষতি?

শুনতে পাই সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় না-কি গত চার/ পাঁচ বছর ধরে বই কেনে না; আবার কোনো কোনো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থাগারেও জমেছে কয়েক বছরের বইয়ের জন্য বরাদ্দকৃত টাকা। আমলাতান্ত্রিক জটিলতা বা রাজনৈতিক কারণে তৈরি হতে পারে এসব জটিলতা। এসবেরও নিরসন প্রয়োজন। প্রকাশকদের বইয়ের যথাযথ বিপণনের জন্যও সরকারসহ সকল দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিকে আন্তরিকতার সাথে এগিয়ে আসতে হবে।

মনে রাখতে হবে, একটি জাতি বা রাষ্ট্রের অগ্রগতির জন্য কেবল ব্যবসায়িক উন্নতি সাধন করলেই চলে না—তার জন্য শিল্পসাহিত্য ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা এবং তার যথাযোগ্য প্রতিপালন প্রয়োজন। আর এই সৃজনশীল ও মননশীল ধারাটিকে বাঁচাতে হলে দরকার সম্মান-সম্মানী এবং পৃষ্টপোষকতার বিষয়গুলো বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করা।



বাংলাদেশ সময়: ১৬৪৯ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৫, ২০১৬
টিকে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।