ঢাকা, রবিবার, ১৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ০১ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

কচ্ছপ ও জলদানো | আল ইমরান সিদ্দিকী

গল্প ~ শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১৫
কচ্ছপ ও জলদানো | আল ইমরান সিদ্দিকী

তিমখানা থেকে দুই দফায় মোট সাতটা কোরান শরীফ হাওয়া হয়ে গেল। এতিমখানার পূর্বদিকে, একটু এগিয়ে গেলে  যে দোকানগুলি আছে, তার কয়েকটিতে কোরান-হাদিসসহ বিভিন্ন রকম ধর্মীয় বইপত্র পাওয়া যায়।

আগরবাতি, তসবি, গোলাপজল, জায়নামাজ ইত্যাদি বিক্রির দোকানটার পাশে যে দোকানদারটা আছে, মানে যে চা-পান বিক্রি করে, সে একদিন এতিমখানার নাম নিয়ে প্রশ্ন তুলল, “ইসলামী নাম বাদ দিয়া এইডা কী রাখল, হিন্দু-ফিরিঙ্গি নাম!” অনেকের মনেও ঐ একই প্রশ্ন, নতুন নামের কারণে ধর্মগ্রন্থ এখানে থাকছে না। দোকানগুলির পশ্চিমে, এতিমখানার দিকে পা বাড়ালেই হাতের বায়ে বিশাল পুকুর, তারপর মসজিদ, হাতের ডানে অর্থাৎ মসজিদের ঠিক উল্টোপাশে সাদমান শাহ মাজার। আরও একটু এগিয়ে গেলে মাজার ও মসজিদের মাঝ বরাবর এতিমখানা। এতিমখানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মসজিদের বড় হুজুর মেসওয়াক করছেন সকালবেলা; ফজরের আগে একবার মেসওয়াক করেন আর নাস্তা খাবার পর আরও একবার। বড় কামেল লোক তিনি, দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তাবও পেয়েছিলেন কিন্তু এই জায়গাটা তার এত পছন্দ, তিনি ছেড়ে যেতে রাজি না। তার পরামর্শেই বাহারউদ্দিন এতিমখানার নাম পাল্টে ‘বাহার উদ্দিন শিশুসদন’ রাখা হয়েছে। হুজুর ভাবলেন, বাচ্চারা ঢুকতে ও বের হতে এতিমখানার নাম দেখবে আর তাদের বারবার মনে পড়বে তারা এতিম, দরকার কী? তার সাথে মসজিদ কমিটির লোকেরা একমত হয়ে নাম বদলে ফেলল। বছর সাতেক আগে এতিমখানাটা যেদিন প্রতিষ্ঠিত হলো, তার পরের দিন মাজারের পুকুরে বেশ কয়েকটি কাছিম দেখা গেল।

আজ এই সকালবেলায় একটি কাছিম দোকানের দিকটায় পুকুরপাড়ে ভেসে আছে। কুরবান আলী পুকুরপাড়ে দাঁড়িয়ে কাছিমটার দিকে তাকিয়ে কিছুক্ষণ পিঠ চুলকাল। তারপর অস্বস্তি নিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে সোজা এতিমখানার দিকে হাঁটা দিল। হুজুরও পুকুরের দিকে আসছিলেন মুখ ধুতে। “হজুর একটা কথা ছিল”—কুরবানের কথা হুজুর দাঁড়িয়ে শুনলেন। ধীরে ধীরে আশেপাশের লোকজনও শুনল কুরবানের কথা। এতিমখানার বাচ্চারাও শুনল, গতরাতে তিনটি ‘বুখারী শরীফ’, পাঁচ প্যাকেট তসবি ও দুইজোড়া ‘স্ত্রীর কর্তব্য’ উধাও হয়ে গেছে কুরবানের। দোকানের পেছন দিকের টিন একটু আলগা ছিল, সেটা ফাঁক করে কেউ নিয়ে গেছে। বেলা গড়ানোর সাথে সাথে চায়ের দোকানগুলিতে কেউ বসে টিভিতে বাংলা সিনেমা দেখল, সাদা লুঙ্গিপরা ভাণ্ডারীর দোকানে পেপার রাখা হয়। কেউ কেউ পেপার পড়ল, দেশের রাজনৈতিক অবস্থা, খুন-গুম নিয়ে টুকটাক আলাপের ফাঁকে ফাঁকে ধর্মীয় বইপত্র চুরির আলাপটাও মুখে মুখে ছড়াল। লোকজন বলবলি করছে, “জাহান্নামের প্রাণীটা কে?” আজকে গরম একটু বেশিই পড়েছে, পরিষ্কার আকাশ, রোদে ঝলমল করছে চারদিক। একটু দূরে ফুলের গাছ দিয়ে ঘেরা মাজারে তিনজন মহিলা প্রবেশ করল। মাজারের ভিতর-ফটকের বাইরে সিঁড়ির শেষ প্রান্তে বসে তারা মাজার জিয়ারত করল। সারাদিন ধরে করে কত মানুষ কত রকমের প্রত্যাশা নিয়ে আসে, এটা-সেটা মানত করে। মাজারের কাছে দাঁড়ালে দূরে চায়ের দোকানের পাশে সেলুনে বাজতে থাকা পুরানো দিনের হিন্দি গান কানে আসে না। দূরত্ব সামান্য তবু মাজার যেন সুনসান। দীর্ঘদিন এখানে থাকার কারণে সবাই যার যার মত করে মাজারের সাথে তার দূরত্ব মেপে নিয়েছে।



এতিমখানার বারান্দায় দাঁড়িয়ে মসজিদের বড় হুজুর মেসওয়াক করছেন সকালবেলা। ফজরের আগে একবার মেসওয়াক করেন তিনি আর নাস্তা খাবার পর আরো একবার। বড় কামেল লোক তিনি, দেশের বাইরে যাওয়ার প্রস্তাবও পেয়েছিলেন কিন্তু এই জায়গাটা তার এত পছন্দ, তিনি ছেড়ে যেতে রাজি না। তার পরামর্শেই বাহারউদ্দিন এতিমখানার নাম পাল্টে ‘বাহার উদ্দিন শিশুসদন’ রাখা হয়েছে। হুজুর ভাবলেন, বাচ্চারা ঢুকতে ও বের হতে এতিমখানার নাম দেখবে আর তাদের বারবার মনে পড়বে তারা এতিম, দরকার কী?



বিকালের আলো যখন মসজিদ লাগোয়া বিস্কুট ফুলের গাছ থেকে সরে গেছে, তখন হুজুর পুকুরপাড়ে বসে ভাবছেন, বাঁচা গেল এতিমখানার নাম নিয়ে ছড়ানো গুজবের হাত থেকে। এই প্রথম কোনো চুরির ঘটনা তাকে কিছুটা স্বস্তি দিল। কিন্তু অবাক হয়ে তিনি ভাবছেন, আল্লার কালাম চুরি করে কে! পেটের দায়ে নাকি নেশার দায়ে? এলাকার লোকজনদের অনেকে বিকাল হলেই বাচ্চা নিয়ে পুকুরপাড়ে চলে আসে। মাজারের চারপাশে কলাবতী গাছগুলিতে কী সুন্দর লাল ও হলুদ রঙের ফুল ধরেছে, সামনের দিকে বিস্কুট ফুল ও আরও কত রকমের দেশি-বিদেশি ফুলের গাছ; মন ভালো হয়ে যায়। সারাদিন প্রচণ্ড গরমের পর বিকালবেলা একটু বাতাস পাওয়া যায়। কিন্তু পুকুর পাড়টাই বাচ্চাগুলিকে সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে। কাছিমগুলিকে তারা খুব পছন্দ করে, আর বাচ্চারা আসলে কাছিমগুলিও যেন ব্যস্ত হয়ে ওঠে। পুকুরের সিঁড়ির খুব কাছে চলে আসে, বিশেষ করে বাচ্চা কাছিমগুলি। বাপ-ভাইয়ের সাথে আসা বাচ্চাদের আরও বেশি আনন্দ দিতে যেন অস্থির হয়ে ওঠে এতিমখানার বাচ্চারা। তারা কয়েকটা কাছিমের নামও দিয়ে দিয়েছে; এর মধ্যে একটির নাম ‘লাইলি’ আরেকটির নাম ‘মজনু’।

দিনকয়েক পরে আবদুল্লাহপুর ওভারব্রিজের ওপর যখন দ্বিতীয়বার উঠেছে তেহেরান মোল্লা, তখন টপটপ করে ঘাম পড়ছে তার কালো দাড়ি বেয়ে। বাস থেকে নেমে ব্রিজের অপর দিকে গিয়ে সে বুঝেছে, যে দোকানটা সে খুঁজছে, সেটার জন্য ব্রিজে ওঠার দরকার ছিল না, বাস থেকে  যে-পাশে সে নেমেছে, সেদিকেই ছিল দোকানটা। শুধু একটু এগিয়ে গেলেই হয়। দোকানের সামনে দাঁড়িয়েই সে সালাম দিয়ে দোকানদার তমিজউদ্দিনকে বলল, “আমারে মাজার মসজিদের বড় হুজুর পাঠাইছে, আপনারে জরুরি তলব করছে... আগে এক গ্লাস পানি খাওয়ান... বোতল থাকলে দেন, মুখ না লাগায় পানি খাই একটু। দোকানি হুজুর গোছের মানুষ। আরেক হুজুরের প্রতি তার আন্তরিকতার ঘাটতি নাই। আনারস খাচ্ছিল সে। আনারসের বাটি এগিয়ে দিয়ে বলল, “ভাই, আনারস নেন... আসেন আনারস খাই... আল্লার নেয়ামত... দ্যাখেন গরমকালের লগে মিলায়া কী সুন্দর আনারস উপহার দিছে... হুজুর কী কারণে তলব করছে কইছে কিছু?” তেহেরান মোল্লা না-সূচক মাথা নাড়িয়ে বলল, “শুকরিয়া ভাই, হাতে বেশি সময় নাই... এই পোলা কি আপনের?” দোকানের শোকেসের ওপর বাসানো চার বছর বয়সী ছোট বাচ্চাটার মাথায় হাত বুলিয়ে দোকানদার বলল, “হ, আমার পোলা, একটাই...পরপর তিনটা বাচ্চা আল্লায় নিয়া গিয়া পরে এরে দিছে... অর মায়ের বড় আদরের ধন... একজীবনে বহুত কষ্ট পাইছে বেচারী। ”

আনারস খাওয়া শেষ করে তেহেরান বলল, “ভাই, দোকানে আপনার লগে আর কেউ নাই, ডাইকা বসায় দিয়া চলেন যাই। ময়মনসিং গেছিলাম বড় বইনের বাড়ি। ফিরা টঙ্গি পর্যন্ত আইতে না আইতে হুজুরে ফোন দিয়া উত্তরায় আপনার এইহানে  নামতে কইল...। ” তমিজউদ্দিন বাচ্চার মুখ মুছে দিতে দিতে বলল, “না রে ভাই, লোক রাখনের ট্যাকা কই, আপনে পাশের দোকানে একটু বহেন, আমি দোকান বন্ধ কইরা বাচ্চাটারে ঘরে রাইখা আসি। সারাদিন বইসা থাকি, বিক্রিবাট্টা নাই। ” তারপর দোকান বন্ধ করতে করতে সে বলল, “মাজারে আবার কহন ওয়াজ মাহফিল হইব ভাই? গতবার ভালোই লাভ হইছে দোকান দিয়া, তয় আপনাগো মাজারের দোকানিরা আমার লগে যে ব্যবহারটা করছিল, সেইডা ভুলতে পারি নাই, রুজি-রুটি আল্লাহর হাতে”...

তেহেরান ও তমিজউদ্দিন ভরদুপুরে মাজারে এসে দ্যাখে  পুকুর পাড় সরগরম। চোর ধরা পড়েছে। পুকুরপাড়ে, সিঁড়ির ওপর ঝুঁকে থাকা যে চার-পাঁচটা কাঁঠালগাছ আছে, তার একটার সাথে চোর বাঁধা। “ও মাগো, আমি আর করুম না” বলছে চোর মাথা হালকা কাত করে, যেন ঘুমঘোরে কথা বলছে। অনেক মারধোর করার পর স্বীকার করেছে যে সে কিতাব চুরি করেছে। মারধরের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এও স্বীকার করেছে সে কিতাব কার দোকানে বিক্রি করেছে। ঘটনাস্থলে এসে ধর্মীয় বইপত্রের দোকানদার তমিজউদ্দিনের আর বুঝতে বাকি থাকলো না তার সামনে বিশাল বিপদ। কমিটির লোক দুই-একজন যারা এলাকায় উপস্থিত ছিল, তারা বিচার-সালিশ, চর-থাপ্পর দিয়ে বিষয়টার মীমাংসা করতে চেয়েছে কিন্তু কে শোনে কার কথা? দোকানের লোকজন কেউ কেউ জোর দাবি জানিয়েছে, ডাকা হোক তমিজকে, “অর চেহারাডা একবার দেহি। ” গাঁজাখোর ধর্ম বোঝে না, কিন্তু তমিজউদ্দিনের মতো লোক হুজুর মানুষ হয়ে কীভাবে চুরি করা কিতাব কেনে! ওয়াজ মাহফিলের সময় যে দোকানদারের সাথে তমিজউদ্দিনের প্রায় হাতাহাতির পর্যায়ে চলে গিয়েছিল, সে তমিজউদ্দিনকে দেখে বলে বসল, “গাঞ্জা খাইলে মাইনষে ধর্মের বই আর অধর্মের বইয়ের ফারাক বুঝে না, তুই তো বুঝস... কিনলি ক্যান? ধর্মের কলঙ্ক... টুপি-পাঞ্জাবীর ইজ্জত রাখস নাই!” তোপের পর তোপ, চড়-থাপ্পড়ের মুখে তমিজউদ্দিন প্রতিবাদ করার চেষ্টা করে বলল, “আমি তো জানি না ভাইজান এই লোক চুরি করছে; আমারে কইল মেঘডুবিতে সরকারি লোক আইসা অবৈধ দোকান ভাঙনের সময় দোকানি এই কেতাব তার কাছে রাখতে দিছিল। পরে বেইচা কয়টা টাকা দিয়া দরগায় চেরাগ জ্বালাইতে কইছে আর বাকিটা দিয়া বৌ-বাচ্চার মুখে ভাত দিতে কইছে। ”

“হারামজাদা মিছা কথা কস ক্যান?” তমিজউদ্দিনকে উদ্দেশ্য করে একজন এই কথা বলে চোরকে মারতে চলে গেল। আধবেহুঁশ অবস্থায় চোরও সায় দিল তমিজউদ্দিন জেনেশুনে কিতাব কিনেছে। তারপর বাপদায় দেয়া ছাড়া তমিজউদ্দিনের আর কোনো উপায় থাকল না। তর্কাতর্কি , চড়-থাপ্পড়ের এক পর্যায়ে সিঁড়ির জন্য বানানো সিমেন্টের মোটা-শক্ত ডাণ্ডার আঘাত তার বুকে এসে লাগলে ‘আব্বা’ বলে চিৎকার করে ধীরে বেহুঁশ হয়ে গেল তমিজউদ্দিন। লোকে মায়ের নাম নেয় প্রবল আঘাতে, ‘মা’ বলে ডাক ছাড়ে আর সে বাপকে স্মরণ করল। হতে পারে তার ছোট বাচ্চাটাকে সে স্মরণ করেছে। স্মরণ করে বেহুঁশ হয়ে গেল। পুলিশ আসলো, তমিজউদ্দিনের লাশ গাড়িতে তুলল। তারও আগে, আশেপাশের সব দোকান  সময়ের আগেই বন্ধ হয়ে গেছে।

পরের দিন থেকে এলাকার অনেক প্রভাবশালী লোকজনকে আর এলাকায় দেখা গেল না। দোষীদের পাশাপাশি অনেক নির্দোষ লোকও উধাও হয়ে গেল। কারণ ‘গং’ দিয়ে কেস ফাইল হয়েছে; কাকে ধরে আর কাকে না ধরে তার ঠিক নাই। গত তিন-চার দিনে পুলিশ কয়েকবার এসেছে, কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেছে। আজ বিকালে যখন বড় হুজুর পুকুরপাড়ে বিষণ্ণমুখে বসে আছেন, যখন সব দোকান বন্ধ, দূরে কলাবতী গাছগুলিতে খুব সুন্দর ফুল ধরে আছে— ভারী পাতা, ভারী কাণ্ড, ভারী ফুল—সহজে বাতাসের অস্তিত্বের জানান দেয় না। শুধু বিস্কুট ফুলের গাছ বাতাসে বেসামাল হচ্ছে থেকে থেকে। এতিমখানার বাচ্চারাও কেউ বের হয়নি। অথচ হুজুরের মনে হলো তমিজউদ্দিন যে জায়গাটায় মারা গেছে সেখানে একটা বাচ্চা দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, না কেউ নাই, মনের ভুল। তমিজউদ্দিনকে বাঁচাতে না পারায় নিজেকে খুব অপরাধী মনে হচ্ছে তার। বহুকাল পর হুজুর এমন সব বিকালের দেখা পেলেন যখন বাচ্চারা পুকুরের আশেপাশে আসে না, বাচ্চাদের চাচা-মামারাও কেউ আসে না। তারা পুকুর পাড় থেকে দূরে আছে। দূরে কথা ছড়াচ্ছে, খুনের ঘটনার পর থেকে নাকি মাজারের পুকুরে আর কাছিমগুলিকে দেখা যায় না।



বাংলাদেশ সময়: ১৪২৯ ঘণ্টা, অক্টোবর ৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।