ঢাকা, বুধবার, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ ডিসেম্বর ২০২৪, ০৮ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

স্ত্রৈণ | অমিতাভ পাল

গল্প / শিল্প-সাহিত্য | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫৩৬ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৫
স্ত্রৈণ | অমিতাভ পাল

বউকে নিয়ে বেশ গর্বই ছিল লোকটার। পাত্রী পছন্দের দিন থেকেই শুরু এই গর্বের এবং সে ভেবেছিল চিরকাল এটাকে ধরে রাখবে।

সেই মতো শুরুও করেছিল জীবন-যাপন এবং রাস্তায় যখন সে বউকে নিয়ে বেরুতো তখন সেই গর্বের আভা ক্যালেন্ডারে আঁকা দেবতার মাথার চারপাশের আলোক ছটার মতো তার শরীরের চারপাশে ছড়িয়ে থাকত। অবশ্য একটা দিকের একটা সামান্য অংশ ছাড়া—কেননা সেই সামান্য অংশে সেই সময় উপস্থিত থাকত তার বউ। এই উপস্থিতি ছিল একটা সার্চলাইটের মতো জ্বলজ্বলে, ফলে আলোকছটায় রঙিন এই চলমান দম্পতিকে মনে হতো কোনো রাত্রীকালীন সার্কাসের তাঁবু।

বস্তুত সার্কাসই দেখাত তারা—তবে আমাদের বাংলাদেশে যেভাবে সার্কাসকে ঋণাত্মক কোনো প্রদর্শনী হিসাবে গণ্য করা হয়—তা না, বরং এক চমৎকার শারীরিক কসরতের সুষমায় উদ্ভাসিত কোনো রুশ সার্কাসের মতোই ছিল সেই ক্রীড়া। রাস্তায় উপস্থিত প্রতিটি দর্শক তার স্বাদ নিত। মেয়েটির শারীরিক সৌন্দর্যকে তারা চাখত কোনো স্বনামখ্যাত দোকানের বিরানীর মতো আর লোকটি যেন সেই টেবিলেই অনাবশ্যকভাবে উপস্থিত একটা নিরামিষ তরকারির বাটি—যাকে সরিয়ে রাখতে পারলেই তারা বাঁচে।

কিন্তু সরিয়ে রাখা যেত না কেননা লোকটা তার বউকে ভালোবাসত, পছন্দ করত বউয়ের সঙ্গ, ফলে শহরের লোকদের কাছে সে পরিচিত হলো এমন এক স্ত্রৈণ হিসাবে যাকে দেখলেই দিনটা খারাপ যাবে বলে মনে করত কুসংস্কারে ভরা মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধিরা। অথচ তার দিনগুলি ছিল চমৎকার এক নতুন সূর্যের রোদে ভরা চিরহরিৎ বনের মতো এবং সেখানে তারা দুইজন বাস করত সেই পাখি দম্পতির মতো—যারা কেবল ভালোবেসেই নীড় বাঁধে। অবশ্য এর ফলে এই কথাও মনে হতে পারে যে, শহরের বাকি দম্পতিদের মধ্যে কোনো প্রণয় আর নেই এবং তাদের দিনগুলি কাটছে নিতান্তই এক ইস্পাত কারখানায় বিশাল কোনো ব্লাস্ট ফার্নেসের গনগনে উত্তাপের মধ্যে—কিন্তু এটা ভাবা বোধ হয় অনুচিতই হবে, কারণ শিশুদের বিদ্যালয়গুলিতে এখনো পর্যন্ত প্রতিটি ভর্তি মৌসুমের শুরুতে যথেষ্ট ভিড় চোখে পড়ে।



মেয়েটির শারীরিক সৌন্দর্যকে তারা চাখত কোনো স্বনামখ্যাত দোকানের বিরানীর মতো আর লোকটি যেন সেই টেবিলেই অনাবশ্যকভাবে উপস্থিত একটা নিরামিষ তরকারির বাটি—যাকে সরিয়ে রাখতে পারলেই তারা বাঁচে।
কিন্তু সরিয়ে রাখা যেত না কেননা লোকটা তার বউকে ভালোবাসত, পছন্দ করত বউয়ের সঙ্গ, ফলে শহরের লোকদের কাছে সে পরিচিত হলো এমন এক স্ত্রৈণ হিসাবে যাকে দেখলেই দিনটা খারাপ যাবে বলে মনে করত কুসংস্কারে ভরা মধ্যবিত্ত সমাজের প্রতিনিধিরা।



লোকটার অবশ্য এইসব ভাবনার প্রয়োজন ছিল না খুব একটা, কারণ তার রয়েছে ভালোবাসার ধন। মুগ্ধতার গভীরতম পর্যায়ে মনযোগের যে বরফ জমে ওঠে—তা ছিল তার প্রতিদিনের জলখাবার। যে রাস্তা দিয়ে সে হাঁটত কিংবা বেড়াতে যেত যে পার্কে—সমস্ত কিছুকেই তার মনে হতো তার জন্য তৈরি। ফলে শহরের দম্পতিদের মধ্যে প্রণয়ের অভাব বা শিশু বিদ্যালয়গুলিতে ভর্তি মৌসুমের ভিড়ই ছিল বরং তার চেয়ে নিঃসঙ্গ—যদিও তারা দলবহুল।

দম্পতিরা যদি সত্যিকারের প্রেমিক হয়েই যায় তাহলে তাদের গল্প হয় অফুরন্ত এবং কোনো ছোট গল্পের পরিধিতে সেইসব গল্পকে আঁটানো কখনোই সম্ভব হয় না যেহেতু, তাই সে চেষ্টা এখানেই পরিত্যাজ্য হলো।

তো সুখে কালাতিপাত করা এই দম্পতি একদিন যখন শহরের রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে তখন লোকটির এক বন্ধুর সঙ্গে তাদের দেখা হলো। বন্ধুটি অনেকক্ষণ মনযোগ দিয়ে তাদের দেখল এবং দীর্ঘ সেই পর্যবেক্ষণ শেষে লোকটিকে একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে তার কানে ফিসফিস করে বলল তার বউ নাকি তার চেয়ে লম্বা।

এটি একটি খুবই ছোট বাক্য, ট্রেন শৃঙ্খলায় যার শুধু ৫/৬টি শব্দ ওয়াগন আছে। অথচ এই রকম ছোট্ট একটি ট্রেন যে একটি বিরাট যোগাযোগ ব্যবস্থার সবকিছু ওলট পালট করে দিতে পারে বন্ধুটির সঙ্গে কথা বলার পর মুহূর্তে লোকটিকে না দেখলে কেউ বিশ্বাসই করত না। মনে হচ্ছিল ছোট ওই ট্রেনটা কোনো ব্যস্ত শহরের লেভেল ক্রসিংয়ে পৌঁছানোর পরপরই কোনো যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে অচল হয়ে পড়েছে। এবং শহরটার যে রাস্তা এই লেভেল ক্রসিংয়ের আওতাধীন—তার যানজট আর কোনোদিনই জটিলতা হারাবে না।

বন্ধুর কথা শেষ হবার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই লোকটা তার ভ্রমণ শেষ করে ফিরে গেল বাড়িতে। এই ভ্রমণের শুরুতে যারা তাদের বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে দেখেছিল—তারা যদি এখন তাদের এই প্রত্যাবর্তনকে দেখত তাহলে যে দৃশ্যটি স্পষ্ট হয়ে উঠত তাদের চোখে, তা হলো—একটা বস্তাকে কেউ টানতে টানতে নিয়ে যাচ্ছে কোথাও। অথচ কিছুক্ষণ আগেও ওই বস্তাটিকে মাথা থেকে মাটিতে নামানোর কথা ভাবতে পারত না তার স্বত্বাধিকারী পাছে তাতে ময়লা লেগে যায়। তবে কারো কারো চোখে পড়ে গিয়েছিল লোকটির প্রত্যাবর্তন। ফলে এখন তাহলে কী হলো—এই ভাবনায় জর্জরিত ওই দর্শনার্থীরা তাদের মগজের ক্ষেতে বুনে দিল গুজবের বীজ এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই সমস্ত কালো মাটি সবুজ করে দিয়ে গজিয়ে উঠল অঙ্কুরের ঝাঁক। কেউ কেউ পাটশাকের মতো চারাগুলিকেই তুলতে শুরু করে দিল কাসুন্দি মাখিয়ে খাবার লোভে আর বাকিরা অপেক্ষা করল সরকারি গুদামে পাট বিক্রির পর প্রাপ্ত টাকাগুলিকে বারবার গুনে তৃপ্তি পাবার আনন্দের।

এইসব তো পাড়া প্রতিবেশি আর শহরবাসির কথা। কিন্তু লোকটা—যে তার বউকে ভালোবাসত, পছন্দ করত বউয়ের সঙ্গ, এমনকি স্ত্রৈণ পর্যন্ত হতে যার আপত্তি ছিল না মোটেও, সে এখন কী করছে? পাটশাক তুলে ফেলা চাষীরা নিজেদের কর্মদোষে কিছু দেখতে না পেলেও সেইসব অপেক্ষারত বাকিরা সবুর সম্বন্ধীয় প্রাচীন একটি আপ্তবাক্যের কল্যাণে দেখল লোকটা আবার বেরিয়ে এসেছে বাড়ি থেকে একা এবং হন্তদন্ত করে ছুটে যাচ্ছে কী যেন একটা করতে।

ঘণ্টাখানেক পরে যখন লোকটাকে আবার ফিরতে দেখা গেল বাড়িতে, অর্থাৎ সবুরকারী যাদের চোখে মুদ্রিত হলো নিজের বাড়ির অভিমুখে যাওয়া লোকটার পায়ের ছাপ, তারা দেখল এবার লোকটার হাতে একটা কাগজের ব্যাগ, বাদামী, আর সেই ব্যাগের বুকে পিঠে লাল অক্ষরে লেখা ‘বাটা’ শব্দটি। খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে কোনো কিছু দেখা যাদের অভ্যাস—তারা এক নজরেই বুঝে ফেলবে ব্যাগটিতে জুতা আছে। কিন্তু কেন? পাড়া প্রতিবেশিরা ভাবল বাড়িতে লোকটা নিশ্চয়ই প্রতিদিন বউকে জুতাপেটা করে এবং প্রতিদিনের এই কর্মের ফলে নিশ্চয়ই এতদিন ধরে ব্যবহৃত জুতা জোড়া ছিঁড়ে গেছে, আর তাই এই পাদুকা সংগ্রহ। এইবার বোঝা গেছে কেন লোকটার এত বউ সোহাগের ঘটা। জুতার দাগ যেন বস্ত্র বেষ্টনীর বাইরে না বেরিয়ে আসে সেইজন্যই সবাইকে দেখিয়ে দেখিয়ে এত ভালোবাসার গান বাজানো। ব্যাটা আমাদের মতোই—এই শান্তি নিয়ে তারপর ঘুমাতে গেল উৎকণ্ঠিত প্রতিবেশির দল।



বউয়ের সঙ্গে নিজের উচ্চতার ঘাটতিটুকু মেপে দেখে জুতা কিনে আনার পর সেটাকে পরে এখন বউয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। আর তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে স্টিলের আলমারিতে লাগানো একটা প্রমাণ মাপের আয়না। সেটাতে চোখ বুলিয়ে বারবার সে যাচাই করে দেখছে উচ্চতার ঘাটতি মিটল কিনা। মনে হচ্ছে মিটে গেছে কিন্তু তবুও ঠিক সন্দেহটা যাচ্ছে না। চতুর্থ কাউকে দেখালে হতো—নিরপেক্ষ একটা মতামতের জন্য। অবশ্য সবাই এইসব ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ পর্যন্তই যায় কিন্তু তার ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ যে আয়নাটা সেটা তো তারই কেনা, ফলে তার মন খারাপের কথা ভেবে আয়নাটা হয়ত মিথ্যা সান্ত্বনাও দিতে পারে।



এদিকে লোকটার বাড়িতে আজ কোনো নিদ্রাসুখ নেই। বউয়ের সঙ্গে নিজের উচ্চতার ঘাটতিটুকু মেপে দেখে জুতা কিনে আনার পর সেটাকে পরে এখন বউয়ের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সে। আর তাদের পাশে দাঁড়িয়ে আছে স্টিলের আলমারিতে লাগানো একটা প্রমাণ মাপের আয়না। সেটাতে চোখ বুলিয়ে বারবার সে যাচাই করে দেখছে উচ্চতার ঘাটতি মিটল কিনা। মনে হচ্ছে মিটে গেছে কিন্তু তবুও ঠিক সন্দেহটা যাচ্ছে না। চতুর্থ কাউকে দেখালে হতো—নিরপেক্ষ একটা মতামতের জন্য। অবশ্য সবাই এইসব ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ পর্যন্তই যায় কিন্তু তার ক্ষেত্রে তৃতীয় পক্ষ যে আয়নাটা সেটা তো তারই কেনা, ফলে তার মন খারাপের কথা ভেবে আয়নাটা হয়ত মিথ্যা সান্ত্বনাও দিতে পারে।

অন্যদিকে বউ বেচারী কিছুতেই বুঝতে পারছে না তার ভালোমানুষ স্বামীটার কী হলো। একবার মিনমিনিয়ে জিজ্ঞাসাও করে ফেলেছিল অকস্মাৎ এই ঋতু পরিবর্তনের কারণ কী। কিন্তু প্রশ্ন শোনার পর সেই ভালোমানুষ স্বামী যখন গনগনে দুই চুলার একটা গ্যাসস্টোভের মতো চোখের উত্তাপ ছড়িয়ে তাকাল তার দিকে, বউয়ের মনে হলো এইরকম একটি প্রশ্নের জবাব না জেনে মরে গেলেও জীবন খুব একটা অপূর্ণ থাকবে না। কিন্তু তারপরও মেয়েদের কৌতূহল বলে একটা জিনিস নাকি পৃথিবীতে আছে যা ঈশ্বরের পরে একমাত্র অমর বস্তু হিসাবে বিবেচিত, সেটা বেঁচে রইল এবং তাকে ক্ষুধার্ত না রাখার জন্য বউটি ঠিক করল এখন থেকে নীরব পর্যবেক্ষণের পথেই সে হাঁটবে।

তা হাঁটুক—তবে লোকটার চতুর্থ কাউকে খুঁজে না পাওয়ার অস্বস্তি ততক্ষণে একটা স্ফীতির জন্ম দিয়েছে যে এক্ষুণি আবার বউকে নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়বার ইচ্ছা হচ্ছিল তার। কিন্তু রাত তখন প্রায় এগারটা, ফলে সে বাধ্য হলো পরের দিনের অপেক্ষায় থাকতে।

সেই অপেক্ষা যখন মধ্যরাত পার করে আরেকটু এগিয়ে গেছে পরবর্তী সকালের দিকে—তখন হঠাৎ লোকটার অস্বস্তি খুঁজে পেল স্বস্তির ঘাট। এক্ষেত্রে দিকদর্শনের ভূমিকা নিয়েছিল গণিত এবং সমস্ত ঝড় ঝঞ্ঝা ভেদ করে দাঁড়িয়ে থাকা একটা লাইট হাউজের মতো লোকটাকে সে দেখিয়ে দিল মাপন পদ্ধতির জাদুকরী সামাধান। খুব সহজ এই সমাধানের শরীরের ভিতরে রয়েছে যোগ আর বিয়োগ নামক এমন দুই কল-কব্জা যারা প্রজেক্টরের ভিতর থেকে উৎসারিত চলচ্চিত্রের মতো বের করে দিতে পারে বউয়ের সঙ্গে লোকটির উচ্চতার ঘাটতি এবং জুতার উচ্চতার সেই ঘাটতি পূরণ করার ক্ষমতা সম্বন্ধীয় বৈজ্ঞানিক যথার্থতার স্বরূপ। ফলে লোকটির জীবনে নেমে এলো ভালোবাসার প্রশান্তি এবং বউয়ের মনে হলো রান্নার কাজ শেষ করে সেই রাতে প্রতিবেশিরা যদি ঘুমাতে না যেত তাহলে লোকটার বাড়ি থেকে ভেসে আসা সেই শব্দগুলি শুনতে পেত, যা চিরকাল ধরে শুনে আসছে নির্জন রাত আর ছটফট নিঃসঙ্গতার অবিবাহিত বেদনা।

পরদিন সন্ধ্যায় আবার শহরের রাস্তায় বউকে নিয়ে বেড়াতে বের হলো লোকটা। এখন তাকে দেখাচ্ছে সেই রাজকুমারের মতো, চিরকাল যে সাত সমুদ্র তের নদীর দুর্গমতা আর ডাইনী এবং রাক্ষসদের ষড়যন্ত্রের জাল টপকে হরণ করে নিয়ে এসেছে সেই ঘুমন্ত সুন্দরীকে—যে কেবল তার আহ্বানেই জাগে এবং জেগে উঠেই তার সব নিদ্রাজনিত ইতিহাসকে পেছনে ফেলে বেরিয়ে আসে রাজকুমারের সাথে।

লোকটার বউকেও এখন দেখাচ্ছিল ঠিক রাজকুমারীরই মতো। সৌন্দর্যে, দীর্ঘ নিদ্রার বিহ্বলতায়, স্বামীকে অনুসরণে। তারা হাঁটছিল পাশাপাশি—লোকটা চাইছিল পৃথিবীর সব মানুষকে জানিয়ে দিতে তাদের দীর্ঘতার অনুপাত আর মেয়েটা—রাজকুমারকে অনুসরণ করা ছাড়া আর কিছুই যেন জানা নেই এই রাজকুমারীর।

রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে আবার তাদের দেখা হয়ে গেল সেই বন্ধুর সাথে, আগেরদিন সন্ধ্যায় যে লোকটাকে কানে কানে জানিয়ে দিয়েছিল বউয়ের সঙ্গে তার উচ্চতার ঘাটতির কথা আর সেই কথাগুলি লোকটাকে দুমড়ে, মুচড়ে, ঠেলে ঢুকিয়ে দিয়েছিল এমন একটা কৌটার মধ্যে যেখানে আড়ষ্টতা ছাড়া আর কোনো ভাড়াটেই থাকে না। কিন্তু এখন তো ঘাটতিজনিত দুর্বলতা নেই ফলে বন্ধুর সামনে দাঁড়াতেই নিজেকে তার মনে হলো একটা আকাশ ফুঁড়ে দেয়া স্তম্ভের মতো—যেই স্তম্ভকে জায়গা দিতে পারে—এমন কৌটার অস্তিত্ব কোথাও নেই।

ঝকমকে হাসি নিয়ে নতুন ঘড়ির মতো মুখ করে সে হাজির হলো বন্ধুর সামনে—পাশে রূপসী চাঁদের মতো বউ—তার সূর্য আস্তিত্ব আলোক উচ্চতার চেয়ে কিছুটা ছোট। বন্ধু কিছুক্ষণ অপলকে দেখল তাদের। তারপর কোনো কথা বলার আগেই আবার তার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেল কিছুটা দূরে এবং আবার বলল সেই একই কথা যা গত সন্ধ্যায় তাকে শুনতে হয়েছিল।

সাথে সাথেই দপ করে নিভে গেল হাজারটা সার্চ লাইট। সূর্য পরিণত হলো ব্ল্যাকহোলে। লোকটার পায়ের নিচে এতক্ষণ ধরে স্থির উচ্চতা নিয়ে গর্বিতভাবে অবস্থান করছিল যে জুতাজোড়া—তাদের হিল যেন গলে মুছে আবার তাকে নামিয়ে আনলো ওই পুরানো উচ্চতায়। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা বউয়ের মাথাটা ততক্ষণে পৌঁছে গেছে প্রকৃতদের কাছাকাছি।

আবার তাদের ভ্রমণ শেষ হয়ে গেল। আবার একটা বিরক্তির বস্তাকে টানতে টানতে সে ফিরে গেল বাড়িতে। আবার দর্শনার্থীদের মগজের ক্ষেতে গজালো গুজবের অঙ্কুর। আবার কেউ কেউ দ্রুত খেয়ে ফেলল পাটশাক—কেউ অপেক্ষা করল সবুরের। শুধু এইসব অসংখ্য আবারের ভিড়ে নতুন এমন দুই একজনের জন্ম হলো—যারা প্রতিদিনকার ঘটনা হিসাবে গ্রহণ করল ব্যাপারটাকে এবং অভ্যাসের সিল মেরে তাকে ফেলে দিল মনযোগের টেবিল থেকে পরিত্যক্ততার বাস্কেটে।

সেই রাতে প্রতিবেশিরা ঘুমাতে গিয়েও জেগে উঠল একটা প্রবল চিৎকারে। তারপর চিৎকার অনুসরণ করে লোকটার বাড়িতে গিয়ে তারা দেখল রক্তের রঙে রঙিন সম্পূর্ণ লাল একটা ছবি। ছবিটাতে আঁকা লোকটা তার বউয়ের পায়ের দুই ইঞ্চি কেটে ফেলেছে বটির এক কোপে।



বাংলাদেশ সময়: ১৫৩৫ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ৫, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।