ঢাকা, শুক্রবার, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ১০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

নির্বাচিত উপন্যাস

কোলাহলে | এনামুল রেজা

প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী ও ঈদের বিশেষ আয়োজন | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৪২ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৫
কোলাহলে | এনামুল রেজা

“তোমার স্বপ্নের হাতে ধরা দাও—আকাশের রৌদ্র, ধুলো, ধোঁয়া থেকে সরে
এইখানে চলে এসো; পৃথিবীর পথে আমি বহুদিন তোমাদের কথা
শুনিয়াছি, তোমাদের ম্লান মুখ দেখিয়াছি—তোমাদের ক্লান্ত রক্তাক্ততা...
মিছে কেন ফেরো, আহা—পৃথিবীর পথ থেকে হে বিষণ্ণ হে ক্লান্ত জনতা
তোমার স্বপ্নের ঘরে চলে এসো—এখানে মুছিয়া যাবে হৃদয়ের ব্যথা
সন্ধ্যার বকের মতো চলে এসো,
বরম শাড়ির মত শান্ত পথ ধরে!”
—জীবনানন্দ দাশ


এবং মানুষের সীমাহীন নিঃসঙ্গতাই এক বিপুল কোলাহল।
—সার্বীয় কবি দেজান স্টোজেনোভিক

এক.
ঘটনা ঘটল ভরদুপুরে।

বৈশাখের এক প্রখর রৌদ্রময় সময়ে।
শহরের বাজার থেকে ফিরছিল আজমত আর তার বারো বছর বয়সী পুত্র মনি। তাদের যে ছোট্ট মুদি দোকান আছে, ওটার জন্য সদাই-পাতি কিনে। আজমতের দু’হাতে দুটো বড় বড় চটের ব্যাগ। মনির হাতে আরও একটা। সে একটা ব্যাগই বইছে হাঁচড়ে-পাঁচড়ে।

পুবপাড়ায় ঢুকতে একটা বিশাল মাঠ পড়ে। জলার মাঠ। বর্ষার সময় পানি জমে বিশাল জলাশয়ের মতো দেখায় বলেই হয়তো লোকের মুখে মুখে এই মাঠটা জলার মাঠ হয়ে গেছে। গোটা মাঠের কোথাও কোথাও ধু ধু বালি, কোথাও বা সবুজ ঘাসে ছাওয়া। পশ্চিম পাশে বিপুল এক শজনে গাছ। কে কবে গাছটা লাগিয়েছিল, সেটির বিত্তান্ত জানা যায় না। কিন্তু দেখে বোঝা যায়, প্রাচীন গাছ। সারা গা ভর্তি কালচে ছোপ ছোপ। গাছের এখানে-সেখানে জমে থাকা আঠা সিঁদুরের মতো লাল। শজনে গাছটায় কেউ কোনো দিন ফুল ধরতে দেখেনি। হয়তো একসময় ধরত, বয়সের কারণে আজ আর ধরে না।

তারা সবে জলার মাঠে পা দিয়েছে। পুত্রকে দেখে মায়া লাগল আজমতের। বেচারার বড় কষ্ট হচ্ছে ব্যাগটা বইতে। গলা নরম করে সে জিজ্ঞেস করল, ‘ব্যাগ নিতি কষ্ট হচ্ছে, বাপ?’

মনি জবাব না দিয়ে চোখ বড় বড় করে পশ্চিম দিকে তাকাল, ‘ও আব্বা, গাছে কী? ওই শজনে গাছে কী?’ তার কণ্ঠস্বরে ভয়, চোখে আতঙ্ক! পুত্রের আতঙ্কিত দৃষ্টি অনুসরণ করে আজমতও পশ্চিম দিকে তাকাল তাদের অদূরেই দাঁড়িয়ে থাকা শজনে গাছটির দিকে।

কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়া প্রাচীন শজনে গাছটি বেশ উঁচু। গাছের সবচেয়ে ওপরের মোটা যে ডালটা, ওটায় একটা লাশ আড়াআড়িভাবে ফেলে রাখা। ঘন সবুজ পাতার আড়াল থেকেও লাশটা দেখা যাচ্ছে। লাশটার মাথা নেই। মাথা যেখানে থাকার কথা, সেখান থেকে এখনও রক্ত পড়ছে! টাটকা লাশ নাকি?

মনি চুপচাপ বারান্দায় বসে আছে।
মনোয়ারা পানি ঢালছে আজমতের মাথায়। জলার মাঠ থেকে ফিরবার পর গা কাঁপিয়ে জ্বর এসেছে তার। মাঝে মাঝে সে চিৎকার করে উঠছে, ‘ভূত! ভূত! ও মনি রে, শিগগির যা, হুজুররে ডেকে নিয়ায়...হুজুররে ডেকে নিয়ায়!’

হুজুর মানে মসজিদের ইমাম সাহেব। তাঁকে ডাকতে লোক পাঠানো হয়েছে। তিনি এসে আজমতের গায়ে ফুঁ দেবেন। পানি পড়া খাওয়াবেন। ভয় পেয়ে জ্বর আসা খুব ভালো কথা নয়। পাড়া-প্রতিবেশীরা ভিড় করেছে এসে। আজমতের কলাপাতার বেড়া ঘেরা আঙিনাটি সেই ভিড়ে আশ্চর্য এক শোরগোলে পূর্ণ হয়ে ওঠে।
ঘণ্টাখানেকের মধ্যে ব্যাপারটা সারা গ্রামে চাউর হয়ে গেল।
জলার মাঠের শজনে গাছে গলাকাটা একটা লাশ ঝুলে আছে। আজমত আর মনি যখন ভরদুপুরে মাঠ পার হচ্ছিল, লাশটা নাকি হাত বাড়িয়েছিল তাদের দিকে। আরেকটু হলে হয়তো তাদের ধরেই ফেলত! মুণ্ডুহীন লাশ খুব ধীরে ধীরে কথা বলে উঠেছিল, ‘ভাই রে, বড় কষ্ট হচ্ছে রে...’

গ্রামের বাতাস অত্যন্ত গতিশীল হবার কারণেই এখানে সংবাদ হয়ে যায় গল্প। ছড়িয়ে পড়ে ওই বাতাসের চেয়েও দ্রুতবেগে। সেটির প্রমাণস্বরূপ জলার মাঠটা এই মুহূর্তে লোকে লোকারণ্য হয়ে আছে। আশপাশের চার-পাঁচটা গ্রামের লোকজন এসে জড়ো হয়েছে। শজনে গাছটার চারপাশে কোনো বেরিকেড দেয়া নেই। তবু কোনো এক অদৃশ্য বাধায় লোকজন ওটার ধারেকাছে যাচ্ছে না, নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই গাছের সবচেয়ে উঁচু ডালটির দিকে উঁকি মারার চেষ্টা করছে। এই অদৃশ্য বাধাটা কি ভয়?

গাছ থেকে লাশ নামানো হয়নি। পুলিশে খবর গেছে, তারা এসে নামাবে। গাছের ডালে লাশটা খুব অদ্ভুত ভঙ্গিতে ঝুলে আছে। রক্ত পড়া বন্ধ হয়েছে অনেকক্ষণ।

ইমাম সাহেব বললেন, চিন্তার কিছু নেই, জ্বর সেরে যাবে। দূষিত বাতাস লেগেছে। পড়া পানি দিয়েছেন, ওটা তিন বেলা খেতে হবে আল্লাহর নাম নিয়ে। সব ঠিক হয়ে যাবে। মনোয়ারার চিন্তা তা-ও কমছে কোথায়? তার বারবার মনে হচ্ছে, কী দরকার ছিল ভরদুপুরে জলার মাঠের ওপর দিয়ে বাড়ি ফেরার? এই গত বছর না আব্দুল হালিমকে ভূতে পেল? ভরদুপুরে সে শজনে গাছের ছায়াতে ঘুমিয়ে পড়েছিল সেবার। ঘুম ভাঙার পর থেকে লোকটা আর তার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে পায়নি কোনো দিন। সারা গ্রাম অর্ধ-দিগম্বর হয়ে সে ঘুরে বেড়াত। নিজের বউ-বাচ্চাকে চিনতে পারত না। তারপর একদিন আস্ত মানুষটা নিখোঁজ হয়ে গেল গ্রাম থেকে!

দুপুরটা শহরে কাটিয়ে বিকেলেই না হয় রওনা দিত আজমত! মানুষটাকে এই দীর্ঘ দশ বছরেও বুঝতে পারল না মনোয়ারা। কখনও কখনও খুব বুদ্ধিমান লাগে তাকে, আর মাঝে মাঝে বোকার হদ্দের মতো সব কাজ করবে আজমত!

‘মনির মা! ও মনির মা...এদিকে আয় না...পানি দিয়ে যা। গলা শুকায়ে গিছে...’ জড়ানো কণ্ঠস্বরে ভেতর থেকে আজমত ডাকছে। মনোয়ারা বারান্দায় বসে ছিল। ঘরের ভেতর ঢুকল। কলস থেকে কাঁসার গ্লাসে পানি ঢালতে ঢালতে সে খেয়াল করল, মনিকে দেখেনি অনেকক্ষণ। ‘বজ্জাতটা কই গেল? বাপটা অসুখে মরছে, তার কোনো হুঁশ নাই? কোনো চিন্তা নাই? তিন বেলা ধরে বজ্জাতটারে পিটানো দরকার!’

জহুর আলী নির্লিপ্ত মুখে শজনে গাছটার দিকে তাকিয়ে আছেন।
তেইশ বছরের পুলিশি জীবনে অভিজ্ঞতার ঝোলা তাঁর পরিপূর্ণ। খুন-খারাবির ঘটনায় এখন আর মন চিন্তায় অস্থির হয়ে ওঠে না। দুজন লোককে গাছে উঠিয়েছেন তিনি। মুখে গামছা পেঁচিয়ে খুব ধীরেসুস্থে কাজ করছে লোক দুটো। কড়া দুর্গন্ধ বেরোচ্ছে লাশ থেকে। জহুর আলী এই গন্ধটার সাথেও ব্যাপক পরিচিত।

সমস্যা হচ্ছে, লোকজন কমছে না। তারা জায়গাটায় একটা বাজার বসিয়ে ফেলেছে। একেকজন প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ছে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জনার গায়ে। তাদের উদ্দেশ্য মুণ্ডুহীন লাশ দেখা। এই এলাকায় খুন-খারাবি যে একেবারে হয় না তা না। তবে এমন ভয়াবহ ঘটনা নিকট অতীতেও ঘটেনি এখানে। লাশের একেবারে কল্লা গায়েব! জহুর আলী মাইক আনতে বাজারে লোক পাঠিয়েছেন। দুই নম্বর গেট বাজার থেকে বেশি সময় লাগার কথা না ফিরে আসতে। গাড়ি করে নগেন গেছে। গাধাটা এখনও কেন যে ফিরছে না! মাইক ছাড়া এত লোক সাইজ করা অসম্ভব।

লাশ নামিয়ে পুলিশ ভ্যানে ওঠাতে বিকেল সাড়ে পাঁচটার মতো বেজে গেল। সেকেন্ড অফিসার নগেন মাইকের ব্যবস্থা করতে পারেনি। একটা ছোট মাউথ স্পিকার দিয়ে সে চেঁচাতে লাগল—‘লোকজনকে ভিড় না করার জন্য বলা হচ্ছে...আপনারা অযথা ঝামেলা কইরেন না...ফাঁকা হন...ফাঁকা হন!’

লাশ নিয়ে পুলিশ ভ্যানটি থানার দিকে রওনা হলো। জহুর আলী ঠিক করলেন, আজমতের সাথে দেখা করবেন। তদন্তের কাজ যত দ্রুত এগোয় ততই ভালো। তাঁর সাথে নগেন আর দুজন সেন্ট্রি। আজমতের বাসা খুঁজে পেতে তেমন সমস্যা হলো না। সে পুবপাড়া বাজারের পরিচিত মুখ।

মনি অবাক হয়ে দেখতে পেল, একদল পুলিশ আসছে এদিকে।
তাদের ঘরের সামনে ছোট উঠোন। সে উঠোনের এক কোণে কলপাড়ের কাছে দাঁড়িয়ে রইল গম্ভীর হয়ে। সেকেন্ড অফিসার নগেন কাছাকাছি এসে বলল, ‘এই খুকা, এইডে কি আজমত হোসেনের বাড়ি?’
মনি জবাব দিল মাথা নেড়ে।
নগেন বলল, ‘উনি তুমার কে হন? তাঁরে ডাক দেও তো খুকা...ওসি ছার উনার সাথে কথা বলবেন...’

মনোয়ারা ঘরের ভেতর থেকেই কম্পিত স্বরে জিজ্ঞেস করল, ‘ও মনি, কিডা আইছে? কার সাথে কথা কচ্ছিস?’ খানিক বাদে সে নিজেই বেরিয়ে এলো মাথায় আধহাত এক ঘোমটা টেনে।

জহুর আলী জিজ্ঞেস করলেন, ‘আপনি আজমত হোসেনের স্ত্রী?’
মনোয়ারা মাথা নাড়ল, ঠিক খানিক আগে যে ভঙ্গিতে মাথা নেড়েছিল মনি।
জহুর আলীর গলাটা হঠাৎ করেই বেশ শীতল শোনায়। ‘তাঁর সাথে কথা বলার দরকার। তাঁকে ডাকেন। ’

আজমত বাইরে এলো, কোনো কথা বলতে পারল না। গায়ে প্রবল জ্বর তার। চোখ দুটো ঘোর রক্তবর্ণ হয়ে আছে। জহুর আলী বললেন, ‘কাল আমি আসব আবার সকালের দিকে। আপনি যেহেতু প্রথম লাশটা দেখেছেন, আরও অনেক কিছু আপনার চোখে পড়তে পারে। ’
আজমত কোঁ কোঁ স্বরে বলল, ‘বেশি কিছু তো দেখিনি, ছার। ’

জহুর আলী খানিকটা নরম হলেন। ‘আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন? ভয়ের কিছু তো নেই। পুরো ঘটনাটা আপনি শুধু বিস্তারিত বলবেন আমাকে। আচ্ছা, আমি কালও আসব না। আপনি পুরো সুস্থ হন, তারপর আসব। ’

মনোয়ারা ক্ষীণ স্বরে বলল, ‘এট্টু বসেন, ছার। চা খায়ে যান। এট্টু বসেন...’

জহুর আলী একটা কাঠের চেয়ারে বসে ছিলেন। উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘চা আরেক দিন খাওয়া যাবে। নগেন, চলো। ’

নগেনের চা খেতে ইচ্ছে করছিল খুব। এত দৌড়াদৌড়িতে তার গলা শুকিয়েছে বেশ। কিন্তু কিছু করার নেই। ওসি সাহেব কড়া মানুষ। এক কথা দুবার বলা তাঁর ধাতে নেই। তবু সে বলল, ‘ছার, ইনার সুয়ালডাও তো ঘটনার সময় সাথে ছিল। তারে কিছু জিজ্ঞেস করলেন না?’

জহুর আলী বললেন, ‘আগে বড় মানুষের কথা শুনি, এরপর ছোট। গালগল্প শুনে প্রথমেই সূত্র নষ্ট করার মানে নাই। ’ কথাটা বললেন বটে, তার পরও জহুর আলীর মনে হলো, ছোটরা দ্রুত ভয় পেতে পারে, আবার তাদের পর্যবেক্ষণ কখনও বা বড়দের চাইতেও তীক্ষ্ণ।

জলার মাঠ খানিক আগেই ছিল মানুষে মানুষে পূর্ণ।
লাশ সরিয়ে নেবার পর থেকেই লোকজন কমতে শুরু করেছিল। খবর পেয়ে কত দূর-দূরান্ত থেকেও চলে এসেছিল তারা! অথচ এখন আর কাউকেই দেখা যায় না চারপাশে। শোঁ শোঁ করে দক্ষিণে হাওয়া বইছে, বিশাল মাঠটাকে মনে হচ্ছে সীমাহীন ধু ধু কোনো প্রান্তর। আকাশের কোণে কালো রং জমাট বাঁধছে। ওগুলো কি কালো মেঘ? ঝড় উঠতে পারে। বোশেখি ঝড়ের তো কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই, যেমন ঠিক নেই মানুষের বাঁচা-মরার। সন্ধ্যা নামছে খুব ধীরে ধীরে। কালো ছোপ ছোপ দাগ পড়া প্রাচীন শজনে গাছটিকে এত জীবন্ত মনে হচ্ছে কেন, কে জানে?

ই-ম্যাগাজিন থেকে পুরো উপন্যাস পড়তে ক্লিক করুন। অথবা বাজার থেকে ম্যাগাজিনের হার্ডকপি সংগ্রহ করুন

বাংলাদেশ সময়: ১৬৪২ ঘণ্টা, জুলাই ২৩, ২০১৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।