ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ২৬ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শিল্প-সাহিত্য

সুমন সরদারের কবিতা প্রসঙ্গে

নাসির আহমেদ | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৬৫৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৫, ২০২৪
সুমন সরদারের কবিতা প্রসঙ্গে

কবি সুমন সরদারের কবিতার সঙ্গে আমার পরিচয় অনেক দিনের, কম করে হলেও প্রায় ত্রিশ বছর। এই কালপরিসরে পেশাগত কারণে তার কবিতা যেমন বহুবার পড়েছি এবং উপলব্ধির চেষ্টা করেছি, তেমনই একটা মূল্যায়নও মনে মনে তৈরি হয়েছে।

তার কবিতা সম্পর্কে আমার উপলব্ধি (ভূমিকা) লেখার অনুরোধ এলে সানন্দে তা গ্রহণ করেছি। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করতে হয় যে, সুমন সরদারের চল্লিশতম জন্মবার্ষিকীর প্রাক্কালে হামিদ রায়হান সম্পাদিত ‘উত্তরপুরুষ’—এ আমি তার কবিতা নিয়ে মন্তব্যধর্মী একটি ছোট্ট রচনা লিখেছিলাম। তার ‘কবিতা সংগ্রহ’—এর মুখবন্ধ বা ভূমিকা লেখার  মুহূর্তে সে কথাও মনে আসে। এ কারণেই যে, ওই লেখার মধ্যে কবি সুমন সরদারের সাহিত্য রুচি ও কাব্যবৈশিষ্ট্য সম্পর্কে কিছুটা আলোকপাত রয়েছে। আমি তাকে বিশেষিত করেছিলাম ‘অলৌকিকের ঘরসংসার-পিয়াসী’ কবি বলে।

সুমন সরদার যেহেতু কবি, সুতরাং তার জীবনের এই সন্ধিক্ষণ তার কবিতাকেও একটা নতুন জীবনবীক্ষায় উজ্জীবিত করবে, নতুন পথ দেখাবে। আশা এই কারণে যে, সুমন নিষ্ঠাবান এবং পরিশ্রমীও। নিরন্তর কবিতার ছন্দ, ভাষা আর নির্মাণকৌশল নিয়ে ভাবেন। সেই ভাবনার পরিচয় তার কবিতায় উৎকীর্ণ।  

ভালো কবিতায় নির্মিতির বিষয়টি সবসময়ই ছিল। যে কারণে সুমনের প্রথম আত্মপ্রকাশে যে তীব্র রাজনৈতিক সচেতন কবির উচ্চকিত প্রত্যক্ষ উচ্চারণ, তা অনেকটাই পথ বদল করেছে ‘বিপন্ন বসবাস’—এ। ‘বিপন্ন বসবাস’ তাকে কবিতার রহস্যসন্ধানী করেছে, করেছে কিছুটা জটিল পথের অভিসারীও। কিন্তু ‘আগুন রঙের ডানা’য় এসে আমরা আরেক সুমনকে পাই, যিনি সহজ আর জটিলের মধ্যবর্তী একটি পথ নির্মাণের চেষ্টায় নিরন্তর শ্রমরত। যাত্রা শুরুর মাত্র এক দশকের মধ্যেই তার কাব্যগ্রন্থ ‘তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়’ (বাংলা ভাষার প্রথম ইন্টারনেট গ্রন্থও এটি; URL: www.netblitzink.com/book/) আরও একধাপ অগ্রসর করেছে তার সেই অনুসন্ধানী কবিমানসকে। একজন কবির নিরন্তর ‘হয়ে ওঠা’র যে সাধনার কথা শ্রদ্ধেয় কবি-সম্পাদক আহসান হাবীব প্রায়শই বলতেন, সেই তারুণ্য ধরে রাখার প্রচেষ্টাই কবিকে নতুন কবিতা লেখায়। সুমনের কবিতা সচেতনভাবে পড়লে যে কেউ স্বীকার করবেন নিজেকে অতিক্রমের মননশ্রমে নিরন্তর রক্তাক্ত হচ্ছেন তিনি।

এমনকি গত কয়েক বছর তার যে-সব কবিতা পত্র-পত্রিকায় পড়েছি, সেখানেও তিনি নতুন কিছু যুক্ত করতে সচেষ্ট।  ছন্দের কবিতা তখনই সফল, যখন কবি ছন্দকে একেবারে মুখের ভাষার কাছাকাছি নিয়ে যেতে পারেন।  
এইখানে মৌনতা ভীষণ মৌনতা তাইতো চলে যাই দেউড়ি পথে
হয়ে গেছে বড় দেরি পরেছি পায়ে বেড়ি স্বপ্ন ভেঙেচুরে মেলার ভোরে
দেখা হবে আসো যদি পেরিয়ে কাল—নদী নিজেকে বেঁধে নিয়ে বায়ুর ডোরে
একসাথে এক বাড়ি তবেই যেতে পারি আরেক জীবনের আকাশ রথে!
(এইখানে মৌনতা/মানবযাত্রা)

সুমন সরদার তার প্রথম কাব্য সংগ্রহ প্রকাশ করছেন সাহিত্যের দীর্ঘপথ পরিক্রমণের পর। কবিতার পাশাপাশি তিনি লিখেছেন ছোট ও বড়দের জন্য উপন্যাস, টিভিনাটক, প্রবন্ধসহ নানাবিধ রচনা। গত কয়েক বছর নিয়মিত লিখছেন গান। তবে সময়ের বিবেচনায় বলতেই হবে কবি হিসেবে সুমন স্বল্পপ্রজই বটে। আরও একটি কথা এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, কবি মূলত দুই ধরনের। এক. সহজাত প্রতিভার, দুই. মননশীলতার চর্চায় সৃজনশীল হয়ে ওঠা। সুমনকে আমার শুরু থেকে দ্বিতীয় ধারার কবি মনে হয়েছে। ব্যাপক পঠনপাঠনে তার মননশীলতার দিকটি অধিকতর উজ্জ্বল।
অধীত জ্ঞান আর অনুভূতির সফল মিশ্রণেই হতে পারে উৎকৃষ্ট কবিতা। সুমন মননশীল বলেই কবিতাকে নির্মিতির দিকে নিয়ে গেছেন সচেতন প্রয়াসে।  

জনপ্রিয় কবিতা বলতে যা বোঝায়, তা সম্ভবত সুমনের অন্বিষ্টও নয়। যে কারণে তার কবিতা নিবিষ্ট মনোযোগ দাবি করে। মর্মার্থ উন্মোচন করে নিতে হয় সতর্ক পাঠের মধ্যদিয়ে। কেননা সুমনের অধিকাংশ কবিতাই প্রতীকী।  
অক্ষরবৃত্ত ছন্দে সুমন সহজ স্বচ্ছন্দ এবং কাব্যসংগ্রহের অধিকাংশ কবিতাই ঐ ছন্দে রচিত বলে উদ্ধৃতিতে যাওয়ার প্রয়োজন বোধ করছি না। বরং তার কবিতার বিষয় ভাবনা এবং অলঙ্কার প্রয়োগ নিয়ে কিছু লেখা দরকার। বিষয়ের দিক থেকে যাপিত জীবনের প্রায় সব অনুষঙ্গই সুমনের কবিতায় উপস্থিত। যেমন, প্রেম, সৌন্দর্য চেতনা, প্রকৃতি মনস্কতা, সমকালীন রাজনীতির আলো ও অন্ধকার দিক, ভাষা—চেতনা, মহান মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধবিরোধী অন্ধকার সময়, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী, বিজ্ঞানচেতনা, এমনকি মৃত্যুচেতনাও তার কবিতার বিষয় হয়েছে। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে অনেক কবিতা লিখেছেন সুমন। কিন্তু অধিকাংশই প্রতীকী।  
প্রতীক এবং চিত্রকল্প আধুনিক কবিতার প্রধান চারিত্র্যলক্ষণ বললে বেশি বলা হয় না। কারণ কবিতায় বক্তব্য সরাসরি বললে তা বিবৃতির মতো মনে হয়। কোনো কিছু রূপক বা চিত্রকল্প করে বললে তা পাঠকের মনে ধাঁধা তৈরি করে, রূপকটি উন্মোচনের জন্য ভাবতে হয়। এবারে সুমন সরদার—এর রূপক ও প্রতীকধর্মী কবিতার দিকে দৃষ্টিপাত করা যাক:
কাগজের নাও নিয়ে খেলতে খেলতে
বড় হতে হতে...
বড় হতে হতে...
নিজেই এখন কাগজের নাও হয়ে ভেসে যাই
ছুঁতে পারলাম না আজও স্বপ্নকে...
(স্বপ্নাবিষ্ট চেতনার ধ্বনি—৯/ স্বপ্নাবিষ্ট চেতনার ধ্বনি)

আবার এমন চিত্রকল্পও রয়েছে তার কবিতায়, যেখানে মিথেরও ব্যবহার রয়েছে একই সঙ্গে।  
এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মিথ বা পুরাণ মাইকেল মধুসূদন দত্ত, রবীন্দ্র-নজরুল থেকে হালআমলের কবি পর্যন্ত কবিতায় ব্যবহার করছেন।
সুমনের কবিতায় হিন্দুপুরাণের প্রয়োগই লক্ষণীয়। চিত্রকল্পময় একটি উদ্ধৃতি :
শুধুই মেঘমালা আকাশ ভেঙেচুরে বর্ষে গর্জনে
এ বেলা মালী এসে ও বেলা বসে থাকে,
নিজের সঞ্চয়ে যতনে দুধবাটি ফেলবে কর্ষণে
কোথায় দেবযানী? লুকিয়ে কোন বাঁকে?
(মালীর চোখে ঘুম/তবু তুমি দাঁড়িয়ে অনড়)।

সুমন সরদারের কাব্যের এই আলোকপাত তাকে চেনার জন্য নতুন পাঠকের উদ্দেশেই তুলে ধরা। যদি এই আলোচনা থেকে কবিকে পাঠক সামান্যও উপলব্ধি করতে পারেন, তা হলেই শ্রম সার্থক বিবেচনা করা যাবে। সুমন সরদারের কাব্যপথ আরও প্রসারিত হোক, এই শুভকামনা।

বাংলাদেশ সময়: ১৬৫৩ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ০৫, ২০২৪

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।